এতদিন ধর্ম নিয়ে, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে, বিশেষ করে ধর্মগ্রন্থের কোনো অনুবাদিত বাণী নিয়ে তর্ক করে দেখেছি তেমন কোনো লাভ হয় না। এখানে সবাই তালগাছ বগলে নিয়ে তর্ক করতে আসে। যেহেতু বাংলা ভাষায় কোনো ধর্মগ্রন্থ নাজিল হয়নি, তাই অনুবাদ গ্রন্থের উপর ভরসা করেই আমাদের কাজ চালাতে হয়। আর যখনই অনুবাদ হবে, তখনই তালগাছবাদীরা নানান ভাবে পিছলাবে, যেমন–অনুবাদে ভুল আছে, অমুকের অনুবাদ সহিহ না, তমুকের অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয়, অনুবাদ আক্ষরিক/ভাবানুবাদ হয়ে গেছে, আপনার বোঝার ভুল, অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে, মূল গ্রন্থ পড়তে হবে, আরবি/সংস্কৃত জানতে হবে, আসলে এখানে কী বুঝাতে চেয়েছে সেটা শুধু উপরওয়ালাই জানেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
গীতার ধ্যানযোগ নামক ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯তম শ্লোকে একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, নির্বাত অর্থাৎ বায়ুরহিত অর্থাৎ বায়ুবিহীন স্থানে প্রদীপের শিখা কাঁপে না। অনেকে বলেন, এই উদাহরণে ভুল বলা হয়েছে, কারণ প্রদীপ জ্বলতে অক্সিজেনের প্রয়োজন আছে; বায়ুবিহীন স্থানে অক্সিজেনই থাকবে না, সেখানে প্রদীপ জ্বলা–শিখা কাঁপা তো দূরের কথা।
আবার অনেকে উপরোক্ত কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিছুতেই ভুল বলতে পারেন না, তাই এখানে কোনো ভুল নেই। বায়ুহীন বলতে তেনারা যে ইনিয়ে বিনিয়ে আসলে কী বুঝাতে চান, আল্যায় জানে!
যা হোক, গীতার এই শ্লোকটার অনেকগুলো অনুবাদের স্নাপশট দেয়া হলো। যার যা বোঝার বুঝে নিন–
অমূল্যপদ চট্টোপাধ্যায়–

বাল-গঙ্গাধর তিলক-এর “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারহস্য অথবা কর্ম্মযোগশাস্ত্র”, অনুবাদ করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর–

চন্দকুমার দেবশর্ম্মা চট্টোপাধ্যায়–

পণ্ডিত দামোদর মুখোপাধ্যায় বিদ্যানন্দ-এর ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত গীতার যে অনুবাদ সংকলনটি বের করেছিলেন, সেটি অমূল্য এই কারণে যে তিনি মূল, অম্বয়, তৎসহ ‘গীতা-বোধ-বিবর্দ্বিনী, সংস্কৃত ব্যাখ্যা, বাংলা প্রতিশব্দ, বাংলা ব্যাখ্যাসহ শঙ্করাচার্য্য, রামানুজ, হনুমান ও বলদেবকৃত ভাষ্য এবং আনন্দগিরি, শ্রীধর, মধুসূদন, নীলকণ্ঠ ও বিশ্বনাথকৃত টীকাও যোগ করেছেন।
প্রথমে মূল, অম্বয়, প্রতিশব্দ ও ব্যাখ্যা দেখা যাক–

এবার শঙ্করাচার্য্য, আনন্দগিরি, রামানুজ, হনুমান, শ্রীধর, বলদেব, মধুসূদন, নীলকণ্ঠ, বিশ্বনাথ–এদের ভাষ্য এবং টীকা–


উপরোক্ত ভাষ্য ও টীকার তাৎপর্য্য বাংলা করেছেন পণ্ডিত দামোদর মুখোপাধ্যায় বিদ্যানন্দ–

উত্তমানন্দ স্বামী কর্তৃক ব্যাখ্যাত, স্বামী ধ্রুবানন্দ গিরি কর্তৃক সম্পাদিত–

গিরিন্দ্রশেখর বসু–

শ্রীধর স্বামীকৃত সুবোধনী টীকা এবং উক্ত টীকার অভিপ্রায়ানুসারে মহামহোপাধ্যায় গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ ভট্টাচার্য্যকৃত মূলানুবাদ–

কালীপ্রসন্ন শংকর–

কেদারনাথ দত্ত–

পণ্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ–

কৃষ্ণানন্দ স্বামী–

কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন–

কৈলাসচন্দ্র সিংহ–

লক্ষ্মণ শাস্ত্রী দ্রাবিড়–

মথুরানাথ তর্করত্নেন সংস্কৃতা–

নববিধানমণ্ডলীর উপাধ্যায় কর্তৃক উদ্ভাসিত–

নবীনচন্দ্র সেন–

প্রমথনাথ তর্কভূষণ–

প্রসন্নকুমার শাস্ত্রি ভট্টাচার্য্য–

গান্ধী-ভাষ্য : সতীসচন্দ্র দাসগুপ্ত সঙ্কলিত–

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর–

শশধর তর্কচূড়ামণি–

ভক্তিরক্ষক শ্রীধর, শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ–

আর্য্যমিশন ইনষ্টিটিউশন–

‘বায়ুশূণ্য’ বলতে বায়ুর অত্যন্ত অভাব বুঝাবে না, শান্ত বায়ু বুঝতে হবে ৷ বায়ু শান্ত থাকলে দীপশিখা কম্পিত হয়না ৷ চিকিৎসকেরা ‘রক্তশূন্যতা’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, রক্তশূণ্যতা বলতে রক্তের অত্যন্ত অভাব বুঝাই না, রক্তস্বল্পতাকে বোঝায় ৷ গীতার উক্ত বাণীর অর্থও তেমনি বুঝতে হবে ৷
রক্তশূন্যতা একটা রোগের বাংলা অনুবাদ। বায়ুশূণ্য মানে কখনোই শান্ত বায়ু মিন করে নাই। উদাহরণটা কৃষ্ণ ভুল দিছে।
কৃষ্ণ উদাহরণটা ভুল দেই নাই, বুঝার ভুল আছে ৷
নিবাত অর্থ বাতাসহীন, (বাত=বাতাস), বায়ু আর বাতাস এক জিনিস হলেও একটু পার্থক্য আছে ৷ প্রবাহমান বায়ুকেই বাতাস বলে ৷ অর্থাৎ নিবাত অর্থ প্রবাহহীন বায়ু, বায়ু থাকবে কিন্তু তার প্রবাহটা থাকবে না— তাহলে দীপশিখাও কম্পিত হবেনা ৷
এটা ভালোভাবে বুঝার জন্য শঙ্করাচার্যের গীতাভাষ্যের স্বামী গম্ভীরানন্দ কৃত ইংরেজি অনুবাদ দেখুন—
6.19 As a lamp kept in a windless place does not flicker, such is the simile thought of for the yogi whose mind is under control, and who is engaged in concentration on the Self.
লক্ষণীয় যে, ওখানে windless বলা হয়েছে, airless কিন্তু বলা হয়নি ৷ windless অর্থ বায়ু প্রবাহহীন, বায়ুহীন নয়; অপরদিকে airless অর্থ বায়ুহীন ৷
আশা করি এবার বুঝতে পারবেন, নমস্কার ৷
বাহ! সংস্কৃত থেকে ইংলিশ, ইংলিশ থেকে বাংলা!
পুণশ্চ, আপনার দেওয়া পন্ডিত দমোদর মুখোপাধ্যায় বিদ্যানন্দের তাৎপর্যের স্নাপশটটি দেখুন, সেখানেও কিন্তু ‘বায়ুপ্রবাহ’ এর কথাই বলা হয়েছে ৷
এতগুলা অনুবাদ দিলাম কেউ তো বায়ুপ্রবাহহীন কইতেছে না। 🙁
আর সংস্কৃত তো আরবী ভাষা না যে বাঙালীদেরও বুঝতে এত সমস্যা হবে!
বুঝতে সমস্যা বাঙালীদের হওয়ার কথা নয়, তবে সত্যকে মিথ্যারুপে দেখাতে আগ্রহীদের বুঝতে অসুবিধা হওয়াটাই স্বাভাবিক ৷