ছোটরা কোনো ভুল করলে বড়রা তাদেরকে ভর্ৎসনা করে। যেমন কেউ আগুনে হাত পোড়ালে বলে–আরে বোকা, আগুনে কেউ হাত দেয় নাকি! আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে, এ তুই জানিস না? কিন্তু কখনোই কাউকে দেখেছেন আগুনের দোষ দিতে? এই পোড়ানোটা আগুনের কোনো অপরাধ না, বরং ওটা আগুনের ধর্ম।
ওরকম আগুনে যখন বস্তি পোড়ে, আমরা কেউ আগুনের দোষ বা অপরাধ খুঁজতে যাই না। আমরা দেখি কীভাবে আগুন লাগল, বা কে বা কারা শত্রুতা করে বা বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করার জন্য আগুন দিল কি না। দাবানলে বন পুড়লেও আমরা একই কাজ করি। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
সম্প্রতি আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলা যায়। এখানে হয়েছে পানির দ্বারা। প্লাবনে হাওড়ের ফসল তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কাউকে কি দেখেছেন পানির উপর দোষ বা অপরাধ চাপাতে? সবাই খুঁজছে কে বা কারা ওরকম ক্রুটিপূর্ণ বাঁধ বানিয়েছিল, তাদেরকে। দোষ বা অপরাধ সেই বাঁধ নির্মাণকারীদের।
উপরের উদাহরণগুলোতে আমরা দেখলাম যে কেউ কোনো কিছুতে কেউ ভুক্তভোগীদের দোষ দিচ্ছে না। কেউ বলছে না, বস্তিতে ঘর বানালে সে ঘর তো আগুনে পুড়বেই; বন যখন আছে তখন তো বনে আগুন লাগবেই, জমিতে ফসল বুনিলে তা তো প্লাবনে ডুববেই। শুধু আগুনে হাত দিয়ে হাত পুড়িয়েছে, তাকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে। এটাও কিন্তু ভুক্তভোগীদের দোষ বা অপরাধ দেয়া হচ্ছে না। আক্ষেপ থেকে বলা হচ্ছে। যে বাচ্চারা আগুনে হাত দিয়ে হাত পোড়ায় তারা না বুঝেই সেটা করে। বড়দের দায়িত্ব তাদেরকে ও ব্যাপারে আগে থেকেই জ্ঞান দেয়া বা বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করা। সেটা দেয়া হয় নাই বলেই বড়রাই মূলত এখানে দোষটা নিজেদেরকেই দেয়। কিন্তু সেটা ইগোজনিত কারণে স্বীকার না করে, তাই উলটো ছোটদের ভর্ৎসনা করে।
এবার দেখি আমরা ছোটরা বড়দের কাছ থেকে কী কী শেখে। বড়রা ছোটদের স্কুলে-মাদ্রাসায় পাঠায় শিক্ষালাভের জন্য, বাইরে বেড়াতে যায় আনন্দ করার জন্য, নতুন কিছু দেখা-শেখার জন্য, পার্টি বা অনুষ্ঠানে যায় ফূর্তি করার জন্য, কাজে যায় জীবিকা অর্জনের জন্য… এরকম অনেক কিছু…
এবার বলেন তো, কেউ কেউ কাউরে কি এমন শিক্ষা দেন যে স্কুল-মাদ্রাসায় গেলে যৌননির্যাতনের শিকার হতে হবে, বাইরে গেলে পার্টিতে-অনুষ্ঠানে-বেড়াতে গেলে, কর্মক্ষেত্রে গেলে, আড্ডা দিতে গেলে, হোটেলে গেলে,… ধর্ষিত হতে হবে? যারা ঘরে বসে থাকার শিক্ষা দেন, তারা কি সেই ঘরের মধ্যেই ধর্ষিত না হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারেন? ঘরের মধ্যেই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এমনকি নিজ ভাই বা বাবার হাতেও যে ধর্ষিত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? এমন তো হয়, অনেক হয়, হচ্ছে। অনেকে বোরখার কথা বলেন। কিন্তু বোরখা পরা মেয়ে ধর্ষিত হয় না, এমন নিশ্চয়তা কিসের ভিত্তিতে দিচ্ছেন? মসজিদ-মাদ্রাসার মধ্যে যে বাচ্চাকাচ্চারা যৌননির্যাতনের শিকার হয়, তাদের পোশাকে কী এমন দোষ থাকে?
ভুক্তভোগীর দোষ বা অপরাধ আগে দেখলে তার বাইরে যাওয়া যেমন দোষের, তেমনি মসজিদ-মাদ্রাসায় যাওয়া, এমনকি ঘরের মধ্যে থাকাটাও দোষের। তাহলে এরা কোথায় যাবে? কিছু করলেও অপরাধ, কিছু না করলেও অপরাধ! আর ওদিকে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষের এহেন আচরণের জন্য। অপরাধের প্রতিবাদ করার বা অপরাধীর শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা না থাকলে চুপ করে থাকাই ভালো। তা না করে যদি নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে উলটো ভুক্তভোগীকে দোষ দিতে থাকলে তাহলে অপরাধের মাত্রা আরো বাড়বে, অপরাধীরা আরো অপরাধ করার প্রেরণা পাবে।
আরেকটা বিষয়–কেউ রেপ হয়ে বা গ্যাংরেপ হলে যাদের বোঝার তারা এমনিতেই বোঝে কী হয়েছিল। এগুলো বিস্তারিত ভাবে, স্টেপ বাই স্টেপ বর্ণনা করার কিছু নাই। পেপার-পত্রিকায় ধর্ষণের খবরগুলোই বেশি পঠিত, লোকে বর্ণনাগুলো পড়ে এক ধরনের বিকৃত সুখ পায় মনে মনে। অনেকে জানে সোস্যাল মিডিয়াতে এ ধরণের বর্ণনামূলক পোস্ট হিট খাবে। তাই অনেকেই এটা করে থাকে।
রেপ হয়েছে–এই একটি কথাই যথেষ্ট। বাকি থাকে শুধু ধর্ষকদেরকে খুঁজে বের করা, আইনের হাতে তুলে দেয়া, বিচার করা, এবং শাস্তি নিশ্চিত করা। কাকে রেপ করেছে, কীভাবে করেছে, কতটা নির্মম ভাবে করেছে, কতটা ব্যথা দিয়েছে–ইত্যাদি বর্ণনা এড়িয়ে যাওয়াটাই উত্তম বলে মনে করি।
Leave a Reply