তখন গ্রামের দিকে এসএসসি দেয়া মানেই ‘এডাল্ট’ হয়ে যাওয়া–এসএসসি শেষ না করলে সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র আমাদের গ্রাম থেকে কিছুটা কাছে হওয়াতে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন-চেনাজানারা আমাদের গ্রামে এসে থেকে পরীক্ষা দিত। পরীক্ষার শেষ দিনে সবাই খুশি–একটা উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যেত। এসএসএস পরীক্ষার শেষ দিনে ‘এডাল্ট’ হয়েছি বলে আর সবার সাথে আমারও মায়ের কাছ থেকে অনুমতি মিলেছিল সিনেমা দেখতে যাওয়ার। কিন্তু আগেই সেই সিনেমাটি লুকিয়ে দেখে ফেলাতে আর যাই নি। মা হেসেছিল।
২) পরীক্ষার পর অফুরন্ত সময়। গল্প-উপন্যাস পড়ারও অনুমতি পেয়েছি। শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ পড়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ছিল। গল্প-উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করার ‘যোগ্যতা’ও হয়েছিল ‘এডাল্ট’ হওয়ার কারণে। উপন্যাসে শরৎচন্দ্র এরকম বলেছিলেন যে–একবার ছেড়ে যাওয়া মানুষটি যদি আবার ফিরে আসতে চায় তখন তাকে ক্ষমা করে গ্রহণ করলে অনেকগুণ বেশি হয়ে ফিরে আসে। ভেবেছিলাম মহিম হয়তো অচলাকে আবার ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু শরৎচন্দ্র সে ‘সাহস’ দেখালেন না। হয়তো সমাজে যেমন ঘটে, সেটাই তুলে ধরছিলেন। মা বলছিল, শরৎচন্দ্র পথ দেখালেও নিজে হয়তো সেই পথে হাঁটতে সাহস করেন নি সমাজের কথা ভেবে–সমাজের প্রথার বিরুদ্ধে যেতে পারেন নি, কিন্তু ভবিষ্যতে কেউ ঠিকই ওই পথে হাঁটবে–প্রথা ভাঙবে…।
মা’র কথাটার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরো কয়েকবছর পরে যখন ‘গৃহদাহ’ নিয়ে বানানো সিনেমাটি দেখেছিলাম। সেখানে পরিচালক ঠিকই অচলা আর মহিমের ‘মিলন’ দেখিয়েছেন।
৩) হুমায়ুন আজাদের ‘কবি’ হাসানের সাথে মেঘার সাক্ষাত এবং তাদের কথাবার্তাগুলো একটা ‘ধাক্কার’ মত লেগেছিল।
“হাসান টেলিফোন রেখে দিলে তরুণীটি হেসে বলে, আমি খুব চমৎকার সময় এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে।
হাসান বলে, হ্যাঁ, খুবই চমৎকার সময়; যখন ভূমিকম্প হচ্ছে তখন দরোজায় প্রিয় কলিংবেলের শব্দের মতো।
তরুণী বলে, আমার নাম মেঘা, আমি মাঝেমাঝে মডেলিং করি।
হাসান বলে, চুল আর মুখ আর ঠোঁট দেখেই বুঝেছি।
মেঘা বলে, আজ এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে, আপনার কবিতা আমার ভালো লাগে, আপনাকেও ভালো লাগছে।
হাসান বলে, অনুরাগিণীদের থেকে আমি আজকাল দূরে থাকি, অনুরাগে আমি ভয় পাই; চুল আর মুখ আর ঠোঁট থেকে আমি দূরে থাকতে চাই।
মেঘা বলে, আমাকে দেখে কি আপনার ভয় লাগছে?
হাসান বলে, কেমন লাগছে সেটা কি আমি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করবো?
মেঘা বলে, আমি স্পষ্টভাবেই শুনতে চাই।
হাসান বলে, অনেক দিন পর আমার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।
মেঘা বলে, সেটা কী? হাসান বলে, তোমাকে আমার জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে ইচ্ছে করছে।
মেঘা বলে, এই আমি, আমাকে জড়িয়ে ধরুন, চুমো খান।
হাসান উঠে মেঘাকে জড়িয়ে ধরে, দীর্ঘ সময় ধ’রে চুমো খায়; মেঘাও জড়িয়ে ধরে হাসানকে, চুমো খায়।
হাসান বলে, মেঘা, তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরেছি, চুমো খেয়েছি, কিন্তু আমি তোমার প্রেমে পড়ি নি, আর হয়তো আমি প্রেমে পড়বো না।
মেঘা বলে, আমি আপনার প্রেমে পড়েছি; চুমো খেতে খেতে আমি প্রেমে পড়েছি, আমি গ’লে গেছি, আমি এমন স্বপ্নেই ছিলাম।
হাসান বলে, তোমার জীবনে আজ বিপর্যয়ের সূত্রপাত হলো; তোমার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।
মেঘা বলে, বিপর্যয় কেনো?
হাসান বলে, আমাকে নিয়ে তুমি সুখ পাবে না।
মেঘা বলে, তা কেউ জানে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তোমার বয়স কতো?
মেঘা বলে, বিশ।
হাসান বলে, আমার একচল্লিশ।
মেঘা বলে, আমার থেকে আপনি একুশ বছরের ছোটো, এটাই আমার পছন্দ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
মেঘা বলে, কোলে নিতে পারবো, আবার পায়ের নিচে বসাতে পারবো; পিতা বলতে পারবো আবার পুত্র বলতে পারবো।
হাসান বলে, একটি নারীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো, দশ বছর ধ’রে।
মেঘা বলে, তাতে কিছু আসে যায় না।…”
এভাবেই চলছে তাদের কথাবার্তা। এখানে একটা বিষয়–ওই যে দশ বছর ধরে একটা নারীর (শ্যামলী) সাথে সম্পর্ক–হাসান বলছে–“একটি নারীর সাথে আমি দশ বছর সঙ্গম করেছি, জানি না তাকে প্রেম বলে কি না।”–শ্যামলির স্বামী ফরফাদ খান এই সম্পর্কের কথা জেনেছেন–হাসান ‘সৎ’ হতে গিয়েই সব জানাজানি হয়ে যায়। শ্যামলী যখন হাসানকে ছেড়ে স্বামীর কাছে চলে যায়, তখন তার স্বামী তাকে ঠিকই ফিরিয়ে। (কেন নেয়, কিভাবে নেয়–সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ–মোট কথা–ফিরিয়ে নেয়।)
মেঘার সাথে হাসানের প্রেম হয়, ভালোবাসা হয়, সেএণ্ডক্স হয়, মেঘার গর্ভে ‘ভালোবাসা’ আসে (হাসান চেয়েছিল)। কিন্তু হাসান কোনো ভাবেই বিয়ে নামক প্রথাটার মধ্যে যেতে চায় না। তাতে সায় দেয় মেঘাও। বিয়ে ছাড়াই যখন সে ভালোবাসার বন্ধনে হাসানের সাথে থাকতে পারছে, তখন বিয়ের প্রয়োজনীয়তা সে নিজেও উপলব্ধি করে না। কিন্তু বেঁকে বসে মেঘার মা-বাবা, বিশেষ করে তার অতিধার্মিক এবং গুণ্ডা প্রকৃতির চাচা। চাচার কাছে বিয়ে না করে বাচ্চার ব্যাপারটা সমাজবিরোধী, ধর্মবিরোধী, ইসলামবিরোধী। ইসলাম রক্ষা করতে চাচা শাস্তিস্বরূপ দলবল নিয়ে হাসানের লিঙ্গ কেটে দেয় (হাসান জানত চাচায় তাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে, কিন্তু তবুও সে বিয়ে প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে রাজি হয় না), পরে মেঘা আত্মহত্যা করে।
‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ঠিক জানি না এর আগে হুমায়ুন আজাদ নিজেকে ‘প্রথাবিরোধী’ লেখক বলে দাবী করতেন কিনা, বা অন্য কেউ তাঁকে প্রথাবিরোধী লেখক বলতেন কিনা।
৪) সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে বারট্রার্ন্ড রাসেলের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন–‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’ (অনেকে বলেন বাস্তবে যাদের বন্ধুবান্ধব নেই, বা বাস্তবে যাদের কোনো ‘লাইফ’ নেই, তারাই ফেসবুকে সময় কাটায় বেশি। ঘটনা অনেকাংশে সত্য–বুকের বদলে ফেসবুক!) তো মনের মধ্যে আপন ভুবন সৃষ্টির অন্যতম উপায় হলো বই পড়া… বই পড়তে পড়তে নানারকম কল্পনার রাজ্য তৈরি হয়, তার মধ্যে ডুবে থাকা… অনেকটা ভার্চুয়াল ফেসবুকে ‘ভুবন সৃষ্টি’ করে ডুবে থাকার মতই। বই, বিশেষ করে গল্প উপন্যাস, পড়তে গিয়ে আমরা নিজেরা বইয়ের কোনো না কোনো চরিত্রের সাথে নিজেকে একাত্মা করে দেই, মনে করি ওই চরিত্রটা আমিই।
লেখকরাও লেখার সময় কি এরকম চরিত্র সৃষ্টিতে নিজেদের কোনো ‘ফ্যান্টাসির’ আশ্রয় নেন না? নিজের কথা, চিন্তাভবনা, দর্শন–এসব কি কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে বলান না? বলান। কেউ টিয়াপাখির মুখ দিয়ে ‘রাজাকার’ বলেন, কেউ কুকুরের মুখ দিয়ে ‘পুরুষবিদ্বেষীতা’ প্রকাশ করেন… সরাসরি বলার চেয়ে এভাবে ফিকশন সৃষ্টি করে বলাটা অধিক ‘নিরাপদ’।
৫) হুমায়ুন আজাদ নিজে এমন কোন প্রথাটা ভেঙেছিলেন যে তাঁকে ‘প্রথাবিরোধী’ বলা হয়–এই প্রশ্ন নিজেই অনেক আগেই একবার ফেসবুকে তুলেছিলাম যখন ফেসবুকে অনেকে প্রথা ভাঙা বিষয়ে তাঁর আর তসলিমা নাসরিন-এর অহেতুক তুলনা করছিলেন। ব্যক্তিজীবনে হুমায়ুন আজাদ কতটা ‘প্রথাবিরোধী মানুষ’ সেটা তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অতটা জানা নেই বলে বলতে পারছি না, তবে তিনি যে ‘প্রথাবিরোধী লেখক’ সে পরিচয় তিনি তাঁর লেখাতেই দিয়ে গেছেন।
পুরানো প্রথাকে না ভাঙলে সমাজ আগায় না। লেখকরা সেই প্রথা-ভাঙার উপায় বা পথ দেখিয়ে দেন। যারাই এটা করেন তাঁরা সবাই-ই ‘প্রথাবিরোধী’। তারপর ব্যক্তিজীবনে নিজেরা কতটা প্রথাবিরোধী, আর লেখক হিসাবে কতটা–সে তুলনা করে কাকে কতখানি ‘স্ববিরোধী’ বলা যায়–সেটা ভিন্ন বিতর্ক…চলমান…
Leave a Reply