‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সভ্যতা’য় সুকুমারী ভট্টাচার্য দেখান–“বৎসর জ্ঞাপক ‘বর্ষ’ শব্দের মধ্যে স্পষ্টতই বার্ষিক বৃষ্টিপাত বা বর্ষার প্রভাব রয়েছে।”–পড়েই মাথার মধ্যে কেমন যেন বর্ষার বিদ্যুৎকুমার ভৌমিক খেলে গেলো। মনে পড়ল, কিছুদিন আগে একটা প্রশ্ন এসেছিল–মানুষের মাথায় সময়ের আইডিয়া কিভাবে এসেছিল? মানুষ কবে থেকে কেন কিভাবে সময় গণনা করতে শিখেছিল…
মানুষ একটা পর্যায়ে শিকার করা শিখল… আর্যরা তখনো শিকারী ছিল। ভারতেও তারা শিকারিই ছিল। কিন্তু তাদেরও অনেক আগে হরপ্পা-মহেঞ্জাদারো সভ্যতার লোকেরা কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে রীতিমত নগর সভ্যতায় প্রবেশ করে গিয়েছিল। তাহলে কৃষি-আবিষ্কার কবে হলো? নিশ্চয়ই সেই হরপ্পা-মহেঞ্জাদারো সভ্যতাও আরও অনেককাল আগে। তো কৃষিকাজের সাথে বর্ষার সম্পর্কটা যে খুবই ঘনিষ্ট, সেটা আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না।
বর্ষার গুরুত্ব আর্যরাও বুঝতে শিখল, অর্থাৎ যখন থেকে তারাও অনার্যদের দেখাদেখি কৃষিকাজ শিখে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল, তখন থেকে ইন্দ্রের কাছে মেঘ-বৃষ্টি প্রার্থনাপূর্বক বেদের শ্লোক রচনাও করছিল। অর্থাৎ মানুষ যতই কৃষির উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করল, ততই বর্ষার গুরুত্ব বাড়তে শুরু করল। এই বর্ষাকে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবন আবর্তিত হতে লাগল।
বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানে বর্ষ’র তিনটি অর্থ–১) বৎসর; বছর, ২) বর্ষণ; বারিপাত; বৃষ্টি, ৩) পুরানোক্ত জম্বু দ্বীপ বা এশিয়ার ভারত, কুরু, রম্যক, হিরণ্ময়, কেতুমান, হরি, ইলাবৃত, কিম্পুরুষ, ভদ্রার্থ নামক নয়টি ভূভাগ।
ওদিকে জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘রামায়ণের উৎস কৃষি’ গ্রন্থে হিসাব করে দেখিয়ছেন রামায়ণের কালে শ্রাবণ মাসই ছিল বছরের প্রথম মাস–“তখন সূর্য কর্কটরাশিতে প্রবেশ করলে শ্রাবণ মাস বৰ্ষাঋতুর প্রথম মাস হিসাবে গণ্য হত। অতএব পুনর্বসু নক্ষত্রর শেষপাদে সূর্য এলে আগামী বর্ষার আশায় কৃষিকাজের প্রস্তুতি শুরু হত। কৃষিকাজের এই প্রস্তাবনাই হল জনকের যজ্ঞ।”
বছর ঘুরে যখন আবার বর্ষা ফিরে আসত, অর্থাৎ নতুন বর্ষ, সেটাই নববর্ষ, অর্থাৎ নতুন বছর। নৌ-বানিজ্যের কারণে যেমন মানুষ বিভিন্ন নক্ষত্রের গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত হতে বাধ্য হলো, তেমনি এই কৃষিকাজের জন্য বর্ষার জন্য প্রতীক্ষা–এভাবেই হয়তো বর্ষ বা বছরের হিসাব শুরু হলো। এবং তখন হয়তো এই শ্রাবণ মাসই বছরের প্রথম মাসও ছিল।
২) আরবে বৃষ্টির স্বল্পতার কারণে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠে নি। সেখানে ব্যবসা-বানিজ্য এবং পশুপালন ছিল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তাই তারা সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে নি। তারা তাদের প্রধান দেবতা হুবাল অর্থাৎ চান্দ্র দেবতার অনুসারী ছিল বলে, বা চাঁদকেই প্রধান দেবতা বানিয়ে ফেলাতে চন্দ্রকে কেন্দ্র করেই জীবন-বিন্যাস গড়ে তুলেছিল। আর এভাবেই তারা হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
শোনা যায়, ভারতে ইসলামি শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। কিন্তু বাংলার সমাজব্যবস্থা ছিল কৃষিকেন্দ্রিক, যা নির্ভর করত মূলত বর্ষাঋতুর উপর। তাই শাসনকার্য পরিচালনা এবং খাজনা আদায় ইত্যাদি সুবিধার জন্য শেষে বঙ্গাব্দ চালু হয়, এবং বৈশাখকে প্রথম মাস ধরা হয়।
Leave a Reply