লিখেছেন : কবিতা রায়
আম্বেদকরকে নিতান্তই অকারণে সংবিধানের জনক বানিয়ে ফেলা হয়। বাস্তব তথ্য এই যে ভারতের সংবিধান পরিষদ যে সংবিধানটা অনুমোদন করেছিল সেটা আম্বেদকরের পছন্দ না হওয়াতে তিনি পরিষদ থেকে এবং দল থেকেও পদত্যাগ করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্দল হিসাবে ভোটযুদ্ধে অবধি নেমে পড়েছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে তিনি বোম্বাই থেকে লড়ে হেরেছিলেন, ১৯৫৪ সালে ভান্ডারায় উপনির্বাচনেও চেষ্টা করেছিলেন। দুবারই হেরেছিলেন আর ওনার বক্তব্যমতে বামুন আর বেনিয়ার দল কংগ্রেস জিতেছিল। ওনার সাধের দলিতরা ওনাকে একেবারেই জিততে দেয়নি।
বামুন আর বেনিয়ারাই কংগ্রেস চালায়, এটাই ওনার বক্তব্য ছিল। তাই কংগ্রেস উনি পছন্দ করতেন না দিল্লির মন্ত্রীসভায় গেছিলেন বাংলা মুসলিম লীগ সরকারের অনুমোদিত প্রতিনিধি হয়ে। তিনি প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন যে, কংগ্রেসের তথাকথিত স্বাধীনতার লড়াইয়ে দলিতরা কখনো সামিল হয়নি আর হতেও চায় না। কারণ এই বামুন আর বেনিয়ার দল ক্ষমতায় এলে তা ভারতের ইতিহাসে এক মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির লোকই বুঝবে, যে লোকটি কংগ্রেসের কোনোকিছুই পছন্দ করতেন না, এমনকি কংগ্রেসের ক্ষমতালাভকে বিরাট বিপর্যয় বলে মনে করতেন, কোনোদিনই কংগ্রেসের সাথে সহমত ছিলেন না, তাঁকে দিয়ে সংবিধান লেখাবে এমন মহামূর্খ কংগ্রেসীরা নয়। বাস্তবে ভারতের সংবিধান পরিষদে ৩০০ সদস্য ছিলেন আর পরিষদের সভাপতি ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। সংবিধানের ড্রাফট যে অর্ধেকের বেশি বি এন রাও করেছিলেন সেটা আম্বেদকর নিজেই বলে গেছেন।
তাহলে আদতে আম্বেদকর সংবিধানে কী অবদান রেখেছিলেন? ওনার কাজ ছিল অন্যসব দেশের সংবিধান পড়ে দেখে সেখানকার যেসব নিয়মগুলো ভারতের সংবিধানে যোগ করা যেতে পারে তার তালিকা করা। তালিকা বানিয়ে সংবিধান পরিষদের সামনে পেশ করা। এইটুকুই উনি করেছিলেন। এইভাবে সংবিধানের খসড়া তৈরি হবার পর পরিষদের মিটিং এ সেই সংবিধানে ৩০০০ এর কিছু বেশি পরিবর্তন করা হয়েছিল। যদি নিতান্তই এটা মেনেও নেওয়া হয় যে খসড়া সংবিধানটা আম্বেদকর একাই বানিয়েছিলেন তার পরেও ৩০০০ সংশোধনের পরে আর সেটাকে আম্বেদকরের সংবিধান বলা যায় কি?
এছাড়া আরেকটি কাজ আম্বেদকর করেছিলেন। লর্ড ওয়াভেল যে ডিভাইড রুলের অংশ হিসাবে পার্লামেন্টে জাতিভিত্তিক কোটা আমদানি করেছিলেন, নেতাজী যার ঘোর বিরোধী ছিলেন, গান্ধীও যে পলিসির বিরুদ্ধে অনশনে বসেছিলেন, সেই জাতিভিত্তিক কোটা ব্যবস্থাকে আম্বেদকর ভারতের সংবিধানে যোগ করে গেছিলেন। না হলে জিন্নার দ্বিজাতি তত্বের মতো ত্রিজাতি তত্ব এনে দলিতরা আলাদা জাতি বলে আলাদা রাষ্ট্রের দাবীতে আন্দোলন করার হুমকিও দিয়েছিলেন। আর এই কাজটি করে তিনি ভারতের সংবিধানকে এক আজব হাসির বইয়ে পরিণত করে গেছেন। যে হাসির বইয়ের এক পাতায় লেখা আছে দেশের সব নাগরিক সমান, আর পরের পাতায় লেখা আছে যে সরকার চাইলেই যাকে ইচ্ছা বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে।
Leave a Reply