লিখেছেন : মনজুরুল হক
আজ পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’র নেতা কমরেড সিরাজ শিকদারের ৪৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। শহীদ দিবস। কমরেড সিরাজ শিকদার শহীদ হওয়ার পর তাঁর পার্টি বহুধা বিভক্ত হয়েছে। এর পর এক এক ফ্যাকশন তাঁকে একেক রকম উপস্থাপন করেছে। সে অর্থে তাঁকে নিয়ে সঠিক গবেষণা হয়নি। ‘ভুল বিপ্লবের বাঁশীঅলা’ , ‘বিপ্লবের বাঁশিওয়ালা: সিরাজ সিকদার ও তাঁর সর্বহারা পার্টি’ এই ধরণের শিরোনামে পত্র-পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে নিয়ে পত্রিকায় লিখে পর দিনই রিজয়েন্ডার দিয়ে সেই লেখা বদলে দিয়েছেন। এসব কারণে তাঁকে কেউ জাতীয়তাবাদী নেতা বলছে, কেউ মাওবাদী নেতা, তো কেউ শুধুই মুক্তিযোদ্ধা।
এবার সব কিছু ছাপিয়ে তাকে বলা হচ্ছে- দেশের সর্বপ্রথম ‘ক্রসফায়ার’ এর শিকার। এই বিশেষণটাই ব্যাপকভাবে প্রচারে এসেছে, যা আদৌ তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন নয়। তাঁকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা হাইলাইট করতে গিয়ে তার লাইন, আদর্শ, কর্মপদ্ধতি চাপা পড়ে গেছে! এই ব্যাপারটা তাঁকে নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দেখা উচিৎ।
এধরণের কোনো মৃত্যুই যেমন ‘ক্রসফায়ার’ নয়, তেমনি সিরাজ শিকদারের মৃত্যুও ‘ক্রসফায়ার’ নয়। পেছন থেকে গুলি করে হত্যা। তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
এধরণের হত্যা প্রথমে হয় ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট। কলকাতার ময়দানে খুব ভোরে নকশালপন্থী নেতা কমরেড সরোজ দত্তকে হত্যা করা হয়।
উপমহাদেশে ১৭৫৭ সালের বিদ্রোহের আগে-পরে শত শত নেতা-কর্মীকে এইভাবে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সে দিক থেকে বলতে গেলে ‘কে প্রথম ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার’ সেটা বলা মুশকিল। তবে তথ্য-উপাত্য বিবেচনায় তিতুমীরের হত্যাকাণ্ড ঠান্ডা মাথার খুন। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর প্রত্যুষে তাঁকে হত্যা করা হয়।
“কর্নেল সাহেব স্বয়ং অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করিয়া দুর্গের দিকে অগ্রসর হইলেন। দুর্গের প্রধান ফটকের সম্মুখে দন্ডায়মান হইয়া তিনি একখানি গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বাহির করিলেন এবং তাহা তরবারির অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেনঃ
“মহাশয়, ভারতবাসীর মহামান্য গভর্নর-জেনারেল আপনাকে সদলবলে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পরোয়ানা দিয়াছেন। আপনি স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হইবেন কি না জানিতে চাই।”
সাহেব দুইবার গ্রেপ্তারী পরোয়ানাখানি পাঠ করিয়া তাঁহার সৈন্যদের নিকট ফিরিয়া আসিলেন এবং দুর্গের উপর আক্রমণের আদেশ দিলেন।
যুদ্ধের আদেশ ঘোষণা করিবামাত্র ইংরেজ সৈন্যগণ বন্দুক উচ্চে তুলিয়া দুর্গের দিকে অগ্রসর হইল এবং দুর্গ বেষ্টন করিয়া ফেলিল। সৈন্যদল দুর্গের নিকটবর্তী হইবামাত্র দুর্গমধ্য হইতে দৃষ্টিধারার মত ইষ্টক, বেল ও তীর বর্ষণ আরম্ভ হইল। বিদ্রোহিগণ দুর্গের অভ্যন্তরে থাকায় ইংরেজ পক্ষের গুলিবর্ষণে তাহাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হইল না। দুর্গমধ্য হইতে বিদ্রোহিগণের তীর ও ইষ্টক বর্ষণে ইংরেজ পক্ষের অত্যধিক সৈন্য আহত হওয়ায় কর্নেল সাহেব ক্ষিপ্ত হইয়া কামানগুলি গেলা বর্ষণের জন্য প্রস্তুত করিবার নির্দেশ দিলেন। এবার আরম্ভ হইল বিদ্রোহিগণের ইষ্টক, বেল ও তীরের বিরুদ্ধে ইংরেজ বলিদের কামানের যুদ্ধ!
সাহস গভীর মেঘগর্জনের ন্যায় কামানের বজ্রনির্ঘোষে চতুর্দিকে আলোড়িত হইল। তিতুর ‘বাঁশের কেল্লা’ কাঁপিয়া উঠিল।
যুদ্ধের অবস্থা বিপজ্জনক বুঝিয়া কর্নেল সাহেব কামান দ্বারা গোলা বর্ষণের নির্দেশ দিলেন। দুর্গের উপর মুহুর্মুহু গোলাবৃষ্টি হইতে লাগিল। একটি গোলা তিতুর দেহের সন্নিকটে পতিত হওয়ায় তিতুর দক্ষিণ ঊরু ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। তিতু অল্পক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন (ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। সুপ্রকাশ রায়)।”
এখানে তিতুমীরকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ থাকার পরও একখানা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার নাটক করেছিল ব্রিটিশ কর্নেল।
Leave a Reply