লিখেছেন : মনির হোসাইন
বাঙালির ইউরোপ-আমেরিকায় পারিবারিকভাবে বসবাস করার ইতিহাস হিসেব করলে দেখা যাবে তা একেবারে এই সেদিনের নয়। বেশ দীর্ঘ দিনের বলাই যায়। মোটাদাগে বিলেত দিয়ে শুরু হলেও আজ তা গোটা পৃথিবীতে বাঙালিরা বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের এক শতাব্দী বা অর্ধ শতাব্দী কিংবা সিকি শতাব্দী বয়সী এই বসবাসের ফলাফল এখন ইউরোপ-আমেরিকায় খানিকটা শক্তপোক্তও। এইসবের কিছু নমুনা মাঝেমধ্যে বিদেশি মাধ্যমে প্রায় তিন চার দশক ধরে ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। এই জার্নিটাও এতো সহজ সরল ছিলো না। চাইলাম আর হয়ে গেলো এই ধরনের তা মোটেই ছিলো না। এর পেছনে ছিলো কঠোর শ্রম। ছিলো সাধনা। আর পাশাপাশি নানান বর্ণ-বৈষম্য হজম করেই তবেই তাঁরা আজ এই একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
এই বিদেশ বিভুইয়ে এসে এঁদের এক দুই প্রজন্মের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছুই প্রায় বিসর্জন দিয়ে তবে আজকে ইউরোপ-আমেরিকায় বাঙালি ইমিগ্রান্টদের একটা মোটামুটি অবস্থান দাঁড়িয়েছে। যা নিসন্দেহে আশা জাগানিয়া। টিকে থাকার এই অসম লড়াই, আত্মমর্যাদার এই লড়াই নিয়ে এই যে পথচলা তাতে কিছু কিম্ভূতকিমাকার বৈপরিত্য বলি আর স্ববিরোধীতাই বলি তা অত্যন্ত উৎকট আকারে আছে। এসব অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বা বিশ্ব রাজনৈতিক ডামাডোলের প্রেক্ষাপটে তা আর কেউই বোধহয় খুব বেশি সে নিয়ে ভাবেন না।
বাঙালি ইউরোপ-আমেরিকায় হয়তোবা সুপারশপ বা রেস্টুরেন্টে বা ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করেন। যারা একটু স্কিলড তারা হয়তো রাঁধুনির কাজ করেন। একজন রাঁধুনিকে সবকিছুই রান্নাবান্না করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। তেমনি ফাস্টফুডস শপ বা রেস্টুরেন্টে যারা টেবিল সার্ভিসসহ অন্যান্য কাজ করেন তাদেরকেও সবই পরিবেশন করতে হয়। ধোয়ামোছার কাজ করতে হয়। যদি সেখানে বার থাকে তবে তাদেরকে কাস্টমারের জন্য এলকোহলও পরিবেশন করতে হয়। এসব তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করেন। আগের প্রজন্মের এরাও করেছেন। অভিবাসী বাঙালিদের এই টাইপের কমন জব যারা করেন না যারা অন্যান্য জব করেন বা ব্যবসা বাণিজ্য করেন তারাও কোনো না কোনো ভাবে নানান সময়ে এইসব পরিবেশ দেখেশুনে অভ্যস্ত। কেউ কেউ হয়তোবা বিয়ে-জন্মদিন এই ঘরানার অনুষ্ঠানে নিজে অংশগ্রহণ করে, তা নিজের সহনশীলতা, নিজেদের উদার সংস্কৃতি এসবকে ঊর্ধ্বেই তুলে ধরেছেন। এ পর্যন্ত একটা সময় অবধি হয়তো ঠিকঠাকই ছিলো। সময়ের আবর্তে তা এখন প্রায় সবই পাল্টে গিয়েছে। আমূল-পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
যিনি আগে এইসব জব করতেন তিনি তদ্দিনে হালাল রেস্টুরেন্টে জব খুঁজে নিয়েছেন। কেউবা হালাল রেস্টুরেন্টের রাঁধুনি হয়েছেন। কেউ কেউ হালাল হারাম ভেদাভেদ করতে করতে লাইফটাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় টেনে নিয়েও গেছে! আবার তরুণ খোমেনি টাইপ যারা আগে জিহাদের বলে সারাক্ষণ টগবগ টগবগ করতো এদের কেউ কেউ নিজে ইরাক-সিরিয়ায় জিহাদ করে মরেছে। ব্যতিক্রম এদের কেউ কেউ এখনোও হয়তো দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এরা এখন বেশিরভাগই ধর্ম-জিহাদ, হালাল-হারাম ভেদাভেদ করতে করতে কেউ নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে যে করেই হোক (!) শাদা চামড়ার কাউকে বিয়ে করে, তাকে ইসলামে দীক্ষা দিতে দিতে জানপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে। এও এক লড়াই বটে। এইরকম জ্ঞাতিগুষ্টি কেউ কেউ আছে। নির্দিষ্ট কারও নাম না নিয়েই বলা যায়, এরা জীবনটাকে হালাল মাংশ, হালাল খাবারের মধ্যে ঘূর্ণায়মান রেখে বাকির খাতায় নগদে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, বৈধ-অবৈধ কাজকর্ম করে বেশ ফুলেফেঁপে পেট ভারি করে মুখে চাপদাড়ি সমেত দেশে এসে মুক্তহস্তে দান-দক্ষিণা করা থেকে মসজিদ-মক্তব, মাদ্রাসা আর ওয়াজ মাহফিল টাকা ব্যয় করে।
এঁরাই এখন ফিবছর দেশে গিয়ে মোল্লাদের সাথে গলা মিলিয়ে এখন দেদারসে বলে যাচ্ছে, বাংলা-ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হারাম। আলোকসজ্জা, আতশবাজি হারাম। নারীপুরুষ একত্রে মেলামেশা করা নাজায়েজ। হারাম। স্কুলকলেজ হারাম। এতিমখানা মাদ্রাসা হালাল। অথচ এই এরা একসময় এইসব ফাটকা বুলি আউড়ানোওয়ালা মোল্লাদের ভাঁটবকাকে তুড়ি মেরে সারাজীবন হাড়ভাঙ্গা কী পরিশ্রমই না করেছে! আজ সময়ের পরিক্রমায় সব ভুলে গিয়ে নিজেরে নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেনো বলতেছে, তুমি সারাজীবন যা করেছো সবই হারাম। তুমি নিজেই একটা আস্তো হারামির হারামি!
Leave a Reply