এক ফুপু ছিল, রাজকন্যা টাইপের, কিন্তু ভিতরে ভিতরে চরম হারামি। মানুষকে অপদস্থ করার যত প্রকার ফন্দি-ফিকির আছে, সবই যেন তার সুবিধার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল! সংক্ষেপে একটা বলি–তার কারণে আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে কোনো কালো মানুষ হাঁটতে পারত না।
গ্রামের মানুষগুলো, নিজের চেহারা-অবস্থা যেমনই হোক, বাগে পাইলে কাউরে কিছু বলতে ছাড়ে না। অন্যের পাছায় আগুন দেয়ার জন্য এরা কত কঠিন, রূঢ় কথা কত অবলীলায় যে বলতে পারে, না দেখলে, না শুনলে বিশ্বাস হবে না। আর ঝগড়া লাগলে তো কথাই নেই।
মানুষকে অপদস্ত করতে আমিও শিখেছিলাম। শিখেছিলাম মানে শিখতে বাধ্য। গ্রামের বুড়া এক লোক, সম্পর্কে দাদা হয়, একটা চোখে একটু সমস্যা। জন্ম থেকে শুনে আসছি, সবাই তাকে “কানা কুদ্দুস” বা এক চোখ ব্যাটারী” বইলা ডাকে। একজনের নাম “নুলা ফহির”। ফকির হলো টাইটেল। কিন্তু আসল নামটা আজ পর্যন্ত জানা হয় নাই। “টেরা ভক্কা”–আসল নাম আবু বক্কর। কিছু উদাহরণ।
পাশের গ্রামের এক কিষান। খুব সম্ভবত ভালো নাম ভৃগু। একবার পাথারে গেছে জমিতে নিড়ানি দিতে। খাল পাড় থেকে একটু ভিতরের দিকে। হাগু চাপলে বাকিরা বলছে–খাড় পাড় যাওয়া পর্যন্ত চাপাই রাখতে পারবি না, তুই ঐ পাশের জমিতে যা। কাজ সাইরা এখন তো পানি পাচ্ছে না। তখন বাকিরা বলছে মাটির ঢেলা দিয়ে কাজ সারতে। তাই করল। কিন্তু ফেরার সময় সারাটা পথ বাকিরা এরে ক্ষেপাইছে–কানে কেদা, গুদে গু–ভেগু ভেগু! এলাকায় এইটা বেশ ভালোই মার্কেট পেয়ে গেছিল। সেই থেকে কারো গায়ে কাঁদা লাগা দেখলেই বাকিরা ওই বলে ক্ষেপাত।
এছাড়াও যে কত রকম টাইটেলের প্রচলন আছে গ্রামের দিকে–ভদ্রস্থ কিছু উদাহরণ দেই–মোটা হইলে হাতি, হাতির বাচ্চা; চিকন হইলে পাটখড়ি, বাতাসা; কালো হইলে তেলাকুচা, আলকাতরা; ফর্সা হইলে সাদা মূলা, রাঙা মূলা; বেঁটে হইলে বাটাইল; লম্বা হইলে তালগাছ… আর গ্রাম্য গালাগালির কথা নাইবা বললাম।
ব্লগে এসে এই গালাগালির কিছু নমুনা পাইছিলাম। কারো সাথে কথায় না পেরে সেই গ্রামের লোকেদের মত কাউকে অপদস্থ করতে এরাও সেই গালির আশ্রয় নেয়। তবে পাল্টা গালি দেয়ার দরকার হয় নাই। মা-বোন তুলে গালি দিলে জাস্ট এইরকম বলতাম–“আপনার মা বোনের ইয়েগুলা কি সোনা দিয়া বান্ধানো যে সেখানে অন্যরা কিছু ঢুকাতে পারবে না?” কাজ না হলে মডুরাই ব্যবস্থা নিত। তাদের কমেণ্ট ডিলিট দিত, আইডি ব্যান করত।
ফেসবুকে আইডি ব্যানের সিস্টেম ছিল না। তখন গালির বদলে গালি চলত, অন্যের মা বোন তুলেও গালি দিতে বাধ্য হয়েছি। তবে একটা পর্যায়ে অনেকের সংস্পর্শে এসে, তাদের কথা শুনে ভেবে দেখলাম–গালিগুলো দেয়া হচ্ছে মূলত মা বোনদেরকে। অথচ এখানে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সেই থেকে গালি দেয়া এক প্রকার বন্ধই, বিশেষ করে মা বোন তুলে। গালি বন্ধ না হলে সে একই গালিতে আল্যা-নবীর নাম বসিয়ে পালটা দিলে অনেক সময় কাজে দিত। সেসবও অনেকদিন করা হয় না। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা হলেও।
খেয়াল করে দেখেছি, নিজের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষকে দেখে সেই আগের মত “ভ্যাটকানো” স্বভাবটা আর নেই বলতে গেলে। হুদাই ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে আঘাত করার বা মনে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতাটা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন ভাবি–যা কিছু করি বা করতে চাই–সবই তো মানুষের জন্য, সবার ভালো থাকার জন্য। মানুষের চেহারা, আকৃতি, গায়ের রঙ–এসব দেখে বিচার করার বাজে অভ্যাসটা প্রায় ঝেড়ে ফেলেছি। এখন শুধু ভাবি–সবাই ভালো আছে তো, সুখে আছে তো! ভালো থাকলেই ভালো। রাস্তাঘাটে মানুষের হাসি মুখ দেখলে অটোমেটিক ভালো লাগে, অসহায়-করুণ মুখ দেখলে খারাপ লাগে। ইচ্ছে হয় গিয়ে জিজ্ঞেস করি–কী সমস্যা, আমাকে বলেন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি। ক্ষমতা নাই বলে সেসব আর হয় না… কিন্তু এই যে মনের থেকে সবার ভালো চাই… কারো ভালো করতে না পারি, অন্তত ক্ষতি তো করছি না–এটাও একটা বড় ব্যাপার।
আরেকটা ব্যাপার–মাঝে মাঝে একা একা লাগে–এটা ঠিক। কিন্তু একই মন-মানসিকতার না হলে কারো সাথে খাপ খাইয়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না, তখন নিজেও কষ্ট পাব, অন্যকেও কষ্ট দেব–এই ভয় থেকে মাঝে মাঝে ভাবি সুযোগ সুবিধা হলে এত্তগুলা কুত্তা-বিলাই পালবো, জমিতে নিজের খাবারটা নিজে ফলাব, সবজি আর ফুলের বাগান করব…কিন্তু হায়, আমার তো নিজের বলে কিছুই নাই!
Leave a Reply