ছুটির দিন। বাথরুমে বসে গুনগুন করছিলাম–রজ্জবে কয় আমি হইলাম যার/ সে যদি না হয় গো আমার/ প্রেমের মজা কী… বার বার এইটুকুই। অনেক চেষ্টা করেও প্রথম লাইন মনে আনতে পারছিলাম না। অস্বস্তি লাগছিল খুব। কারণ খুব প্রিয় একটা গান। এত বার শোনা… মুজিব পরদেশী… সেই ছোটবেলা থেকে…
বাথরুম থেকে বের হয়েই গুগল করলাম–পেয়ে গেলাম–সে যে আমার হোক বা না হোক সই/ আমি যে সই তার হয়েছি/ দিয়ে জাতি কুল মান/ এই দেহ প্রাণ গো সই/ আমি তার চরণে সব সঁপেছি… রাধাবিচ্ছেদ!
যারা এই ধরনের গান বা পদ রচনা করেছেন, প্রায় সব পদকর্তাই আভোগে এসে ভনিতায় নিজেদের নাম জুড়ে দিয়েছেন। সেই প্রথম দিকের চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস থেকে শুরু করে লালন, রাধারমণ, বিজয় সরকার… তারপর এই রজ্জব আলি দেওয়ানরাও এমন করেছেন। এতে কোন পদ কোন পদকর্তার রচনা, সেটা বুঝতে সুবিধা হয়। তবে এই নাম জুড়ে দেয়াটা জোর করে নয়, গানের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই উনারা এই কাজটা অত্যন্ত ধ্রুপদী পদ্ধতিতে জুড়ে দিয়েছেন।
পদকর্তারা বেশিরভাগ সময় নিজেদেরকে রাধার আসনে বসিয়ে, অর্থাৎ হৃদয়ে রাধাকে ধারণ করে, রাধাভাবে বিভোর হয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদন; আবার ঈশ্বরের প্রেমে দিওয়ানা, বা বিরহে ব্যাকুল হয়ে পদগুলো রচনা করেছেন। আবার অনেক সময় নিজেরাই কৃষ্ণ বা সখী সেজেছেন–পালাগানের সুবিধার্থে। গানগুলো ওভাবেই ভাবে বিভোর হয়ে মুখে মুখে রচনা করে গেছেন, শিষ্যরা শুনে আয়ত্ব করে নিয়েছে। আর শোনা জিনিসে যা হয়–এক জন থেকে আরেকজনে যাওয়ার সময় কিছুটা বিকৃত হয়ে যায়। এনাদের গানও তাই হয়েছে। এ কারণেই এনাদের অনেক গানে অনেক রকম ‘পাঠান্তর’ পাওয়া যায়। কোনটা যে সবচেয়ে বেশি নিখুঁত, সেটা গবেষকরা ভালো বলতে পারবেন।
তো এই ভনিতায় উনাদের নাম পাওয়া যায়–এই নামটা উনারা খুব চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করতেন। যেমন ধরা যাক কোনো গানে রাধার বিরহ প্রকাশ পাচ্ছে, তখন আভোগে এসে অর্থাৎ গানের শেষাংশে এসে নিজেরা রাধাকে সান্ত্বনাসূচক কোনো কথা বলছে। বা, গানটা এমন যে, বিরহিনী রাধা তার সখীদের কাছে নানান কেঁদে কেঁদে প্রশ্ন করছে, যার তেমন কোনো সদুত্তর সখীরা দিতে পারছে না, তখন পদকর্তারা শেষে সখীর বেশে এসে একটা উত্তর দিচ্ছে, বা সান্ত্বনা দিচ্ছে। আবার কখনও কখনও খোঁচা দিয়ে রাধাকে উস্কে দিচ্ছে! আবার রাধা যখন বলে যে প্রেম করার জন্য পাড়াপ্রতিবেশি তার বদনাম রটাচ্ছে, তখন সখীবেশে তাদেরকে গালি দিচ্ছে।
চণ্ডীদাসের একটা পদ থেকে উদাহরণ দেই–সখীদের উদ্দেশ্য করে রাধা বলতেছেন–
‘বাহির হইতে লোক চরচায়
বিষ মিশাইল ঘরে।
পিরীতি করিয়া, জগতের বৈরী
আপনা বলিব কারে।।’
— অর্থাৎ বাইরের লোকেরা বদনাম করে, এমনকি তারা বাজে বাজে কথা বলে ঘরের লোকদের মনও তার প্রতি বিষিয়ে দিয়েছে; প্রেম করে সারা দুনিয়ায় তার নামে কলঙ্ক রটিল, কেউ আর আপন রইল না, সবাই তাকে পর করে দিল…
তখন ভনিতায়–
‘চণ্ডীদাস কহে, সকলি পাইবা,
বঁধুয়া আপন হৈলে।।’
তো পদের ভিতরে দু-চার শব্দ বা দু-এক লাইন এদিক-ওদিক হতে পারে–এমন হয়ও–লালনের প্রচুর গাণেও এমন আছে, তার অনেক গানেরই কয়েক রকম ভার্সন পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে গানের মূলভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না, এবং গানটা যে লালনের–সেটা বুঝতেও সমস্যা হয় না–কিন্তু শেষের ভনিতাটা যদি কেউ বিকৃত করে ফেলে, অর্থাৎ পদকর্তা নামটাই মুছে অন্য কিছু বসিয়ে দেয়, তখন পদটাকেও নষ্ট করা হয়, পদকর্তাকেও অপমান করা হয়।
সেরকমই বিখ্যাত একটা গান–
‘রাই জাগো গো জাগো শ্যামের
মনমোহিনী বিনোদিনী রাই।।’
–গানটা প্রথম কবে কোথায় শুনেছিলাম মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, গানটা একেবারে অন্তরে ঢুকে গিয়েছিল মাকসুকের ‘প্রাপ্ত বয়স্কের নিষিদ্ধ’ অ্যালবামে শুনে। পরে আরো অনেকের গলায় শুনেছি, কিন্তু মাকসুদের মত দরদ দিয়ে গাইতে আর কাউকে শুনি নাই…অন্তত আমার ভালো লাগে নাই আর কারো গাওয়া। তো তখনকার দিনে ব্যান্ডের অ্যালবামের সাথে গানের কথাগুলোও দিয়ে দিত, ফলে দুই-তিনবার শুনলেই গানগুলো মুখস্ত হয়ে যেত। সারাদিন গুনগুন করতে সুবিধা হত। এই গানের লিরিকটাও ছিল কিনা খেয়াল নেই, বা থাকলেও গীতিকারের জায়গায় ‘সংগৃহীত’ বা ‘প্রচলিত’–এমন কিছু লেখা ছিল হয়তো। এরকম প্রচুর লোকসঙ্গীতের বেলাতেই হয়েছে–তারা গান-সুর নিয়েছে, কিন্তু গীতিকার বা সুরকারের নাম দেয় নি।
এবার পুরো গানটা দেখা যাক। কিছুদিন আগে বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাউলকবি রাধারমণ গীতি সংগ্রহ’ গ্রন্থটিতে গানটি পাই–
‘পুর্ব দিকে চেয়ে দেখ আর তো নিশি নাই
জয় রাধিকা জাগো শ্যামের মনমোহিনী
বিনোদিনী রাই।
রাই জাগো গো জাগো শ্যামের
মনমোহিনী বিনোদিনী রাই।।
বাসি ফুল দাও ভাসিয়ে আবার আনো ফুল তুলিয়ে
মন সাধে যুগল সাজাই।।
শ্যাম অঙ্গ অঙ্গ দিয়ে কী সুখে আছে ঘুমিয়ে
লোক নিন্দার ভয় কি তোমার নাই।।
ভাইবে রাধারমণ বলে যুগলে যুগল মিশিয়ে
যুগল বিনা অন্য গতি নাই।।’
যেটুকু বুঝছি–এই পদে রাধারমণ প্রথমে সখীরূপে ভোরবেলা এসে দেখছেন, প্রেমকুঞ্জে তখনও রাধা কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ওদিকে বেলা হয়ে গেলে লোকজন জেগে যাবে, তারা দেখে ফেললে রাধার নিন্দা করবে। তাই সখীরা এসে রাধাকে জাগিয়ে তুলছে–তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠ, রাতে যে ফুল দিয়ে ফুলশয্যা হয়েছিল, সে ফুল বাসি হয়ে গেছে, নতুন করে ফুল তুলে আনো, কৃষ্ণকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ভদ্রস্থ করে বিদায় দাও… আবার সখীদেরই ইচ্ছে করছে তারা ফুল দিয়ে রাধা-কৃষ্ণ দুজনকেই সাজায়। এমন অবস্থা দেখে শেষে ভনিতায় রাধারমণ বলছেন–রাধা এবং কৃষ্ণ একে অপরের পরিপূরক, কাউকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না–যুগল রূপটাকেই সাজাও–তারা অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে মিশে আছে–এটাই আসল রূপ। (আধ্যাত্মিক ভাবে হয়তো এর আরো অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে।)
এই একটি গানই আরো যে অনেকের কণ্ঠে অন্যরকম কথায় শুনেছি, সেখানেও গীতিকারের নাম পাই নি। মাকসুদ আভোগের অংশটুকু পুরোই বাদ দিয়েছেন। অন্যরা আভোগের অংশ বিকৃত করে গাইছে–
আমরা তোমার সেবার দাসী, যুগল চরন ভালোবাসি…–কবিকে অসম্মান করার পাশাপাশি এটা সহজেই অনুমেয়–এই লাইনে গানের মূল ভাবটাও বিকৃত হয়ে গেছে। বিখ্যাত অমর পালসহ আরো কয়েকটি ভার্সন শোনা যাক–
https://www.youtube.com/watch?v=UzJ-7c1amZI
https://www.youtube.com/watch?v=Rxp-T1pFfJo
২) যারা গানের জগতের মানুষ–সবাই শিল্পী–তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, পরিবেশনায় একটা গান আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। যেভাবে আসে, আমরা শ্রোতারা সেভাবেই শুনি। ভিতরের খবর খুব একটা রাখা হয় না আমাদের। এই হিসাবে একজন শিল্পী মূলত বেঁচে থাকেন আরেকজন শিল্পীর মাধ্যমেই। কিন্তু সেই শিল্পীরাই যখন শিল্পকে এভাবে বিকৃত করেন, এমনকি অন্য শিল্পীর নাম পর্যন্ত মুছে দেন, তখন শ্রোতা হিসাবে লজ্জা লুকানোর জায়গা পাই না! প্রশ্ন জাগে–শিল্পীরাই কি শিল্পীদের সবচেয়ে বড় শত্রু?
পোস্টটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।
তবে আররো কিছু কথা প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এখানে সংযুক্ত করে দিচ্ছি–
৩) ‘একটা চিঠি লিখি তোমার কাছে ব্যাথার কাজলে/ আশা করি পরান বন্ধু আছো কুশলে’–মুজিব পরদেশীর কণ্ঠে এই ধরনের গান খুব ভালো লাগে। কারণ হিসাবে যখনই বলেছি যে, উনার মত এত আবেগ দিয়ে এরকম গান আর কাউকে গাইতে শুনি না, তখন অনেকেই বলেন যে, আবেগ না, উনার কণ্ঠটাই এমন… এসব গান উনার কণ্ঠে অটোমেটিক আবেগী হয়ে বের হয়ে আসে! সে যাই হোক– এই চিঠির গানটাই মুজিব পরদেশীর ‘বিজয় বিচ্ছেদ’ শিরোনামের একটা অ্যালবামে শোনা। কিন্তু এই গানটা কবিয়াল বিজয় সরকারের লেখা নয়। এটা উনার শিষ্য রসিক সরকারের লেখা, সুরও তার। আভোগের ভনিতায় রসিকের নাম আছে–
‘চিঠি লিখি করি ইতি নিও আমার প্রেম পিরীতি
(অধম) রসিক বলে শেষ মিনতি চরণ কমলে…’
৪) মানুষ হিসাবেও প্রিয় মুজিব পরদেশীকে যথেষ্ঠ বিনয়ী মনে হয়েছে। গত বছর এটিএন-বাংলার এক অনুষ্ঠানে উনাকে দেখা গিয়েছিল উনার সঙ্গীত জীবন নিয়ে অনেক কিছু বলতে। যখনই কোনো প্রসঙ্গ এসেছে, তিনি বিনীত ভাবে কবি ও সুরকারদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের প্রতি হাত জোড় করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। তবে দু-একটা জায়গায় ধরা খেয়েছেন বলে মনে হয়েছে। উনার গাওয়া বিখ্যাত–আমি কেমন করে পত্র লিখি রে বন্ধু–গানটা যতদূর জানি মনমোহন কবিয়ালের লেখা এবং বিদিত লাল দাসের সুর। উনি বলেছেন, গানটা বিজিত লাল দাসের লেখা এবং উনার (মুজিব পরিদেশীর) নিজের সুর করা। আমার জানায় ভুলও থাকতে পারে। কেউ সত্যটা ভেরিভাই করলে ভালো লাগবে–গানটা আমারও খুব প্রিয়!
৫) আপডেট–আগস্ট ২৮, ২০১৭
কিছু গানের লাইনের লিস্ট–
- তোর সনে নাই লেনা দেনা যেজন প্রেমের ভাও জানে না
- গুরু আমার উপায় বল না, জন্মাবধি কৰ্মপোড়া আমি একজনা
- মন মিলে, মনের মানুষ মিলে না
- আমি যদি মরি ডুবে নামেতে কলঙ্ক রবে
- নিবি ছিল মনেরি আগুইন, কে দিল জ্বালাইয়া
- তোমার বাঁশির সুরে ভাটিয়াল নদী উজান ধরে
- তুমি পুরুষ কুলে জন্ম নিয়া নারীর বেদন জান না
- চণ্ডীদাস রজকিনী তারা প্রেমের শিরোমণি
তারা এক প্রেমেতে দুইজন মরে এমন মরে দুইজনা - নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্ৰমরা
- সোনার ময়না ঘরে থইয়া বাইরে তালা লাগাইছে
যারা সব ধরনের গান শোনেন তাদের কাছে এই লাইনগুলো খুব পরিচিত হওয়া স্বাভাবিক। জনপ্রিয় অনেক গানে এই লাইনগুলো পাওয়া যাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো–সে গানগুলো রাধারমণ দত্তর লেখা নয়, অন্য কবি বা গীতিকারের, কিন্তু এই লাইনগুলো রাধারমণ দত্তর। কারো একটা কবিতা বা গানের লাইন শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করে পুরো একটা গল্প বা উপন্যাস লেখার কথা জানি। ব্যাপারটা হয়তো স্বাভাবিক বা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এরকম গানের লাইন নিয়ে বা সেগুলো একটু এদিক-ওদিকে করে যে নতুন গানে ব্যবহার করা যায়, সেটা আগে জানতাম না।
Leave a Reply