সন্দেহ নেই হিন্দুধর্মশাস্ত্রগুলো অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের চেয়ে পুরানো। এমনও হতে পারে–হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রগুলোই আগে সংকলিত হয়েছে, সেজন্য সেগুলো পুরানো বলে মনে হয়। কিন্তু ওই একই সমাজব্যবস্থা প্রায় সবখানেই ছিল। সেগুলো আগে-পরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেজন্য অন্যান্য সব ধর্মশাস্ত্রে এমন সব কথা আছে–দেখা যায়–সেগুলো অনেক আগে থেকেই হিন্দুধর্মশাস্ত্রে ছিল। কিন্তু অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের কথা–বিশেষ করে আমাদের দেশে–ইসলামের কথাগুলো এত বেশি প্রচলিত যে হিন্দুধর্মের কোনো কথা যদি রেফারেন্স উল্লেখ না করে বলা হয় তাহলে অনেকেই সেগুলোকে ইসলাম ধর্মের কথা বলে মনে করবেন।
আগেই বলছি–একই কথা–বিশেষ করে নারী বিষয়ক নিয়মকানুনগুলো প্রায় সব সমাজেই এক। সবাই চেয়েছে নারীকে বন্দী করতে। তাই নারী বিষয়ে সব ধর্ম-ধর্মগ্রন্থের কথাই প্রায় এক। এ কারণেই কোরান-হাদিসের অনেক কথা হুবহু বাইবেলের সাথে বা খ্রীষ্টধর্মের সাথে মিলে যায়। এখানে হিন্দুধর্মশাস্ত্রের কিছু কথা উল্লেখ করছি। কিছু কিছু কথা মনে হবে কোরান-হাদিস থেকে কপি করা। কিন্তু না–এগুলা হিন্দুধর্মশাস্ত্রেই অনেক আগে থেকে বলা আছে–[যাদের রেফারেন্স লাগবে, তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য–সুকুমারী ভট্টাচার্য » প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ » বৈদিক যুগে নারী]
মেয়েদের শরীরে কোনও খুঁত থাকলে যৌতুকের প্রয়োজন হত।
রাজা বৈধ ভাবেই চারটি মহিষী রাখতে পারতেন। [ইসলামের চার বিয়ের আইডিয়া তাহলে নতুন কিছু নয়।]
তাকে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকতে হবে, না হলে তার শক্তিক্ষয় হয়। [ইসলামেও নারীকে ঘরের মধ্যে থাকতে বলা হয়।]
সতী স্ত্রী সে-ই যে স্বামীকে তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর মুখের উপর জবাব দেয় না।
পুরুষের সম্মুখে স্ত্রীর ভোজন উচিত নয়।
স্ত্রী মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে না। তার উপস্থিতি যজ্ঞে আবশ্যক, কিন্তু সে সেখানে পুতুলমাত্র।
সে যজ্ঞে আহুতি দিতে পারবে না।
সে সভায় উপস্থিত থাকতে পারত না, মধুপান করতে পারত না। সে মধু খায় না, বলে–আমি আমার পুত্রদের জন্য এই ব্ৰতপালন করলাম।
তার প্রধান কর্তব্য পুত্রের জন্ম দেওয়া এবং সে যদি তা না পারে তবে তাকে ত্যাগ করা যায়।
বন্ধ্যা নারী দশ বছর পরে আইনত পরিত্যাজ্য হত, যে নারী মৃত্যুবৎসা বা শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়, সে বারো বছর পর পরিত্যাজ্য হত, এবং কলহপরায়ণা তৎক্ষণাৎ পরিত্যাজ্য।
সদ্যোজাত কন্যাসন্তান মাটিতে রাখা হয়, পুত্রসন্তান উপরে তুলে ধরতে হয়।
বিবাহেও সে তার দাম্পত্যজীবন শুরু করে নিচু হয়েছে; পরিচিত বিবাহের মন্ত্রে স্বামী বলেন, ‘তোমার হৃদয় আমার ব্ৰতে নিহিত হোক, তোমার চিত্ত আমার চিত্তকে অনুসরণ করুক।
স্ত্রী স্বামীর অনুগামী হবে।
নারী তার স্বামীর পথে চলবে।
নারীকে শৈশবে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনে স্বামী রক্ষা করে, বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করে; স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্যের অধিকার নেই।
অগ্নিপত্নীবৎ— অনুষ্ঠানে যেমন হবিকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, ঠিক তেমন ভাবেই পত্নীকে প্রহার করা উচিত, যাতে তার নিজের শরীরের উপর বা সম্পত্তির উপর কোনও অধিকার না থাকে। [নারীপ্রহার শুধু ইসলামের পৈত্রিক সম্পত্ত নয়।]
স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ কামনা চরিতার্থ করতে অস্বীকার করে, তাহলে স্বামী প্ৰথমে কোমল ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, তার পরে উপহার দিয়ে তাকে কিনে নিতে চেষ্টা করবে (অবক্ৰীণীয়াৎ) এবং তারও পরে স্ত্রী রাজি না হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে বশ করবে। [আবারো]
গৃহে স্ত্রীর স্থান স্বামীর নিচে, সে সব সময়ে স্বামীর অনুগামিনী হবে।
স্বামীকে বলা হয়েছে, খাবার পরে স্ত্রীকে উচ্ছিষ্টটি দিতে।
স্ত্রী সঙ্গিনী, কন্যা অভিশাপ, পুত্ৰ স্বৰ্গে আলো।
যতদিন কারও স্ত্রী সংগ্ৰহ না হয়, তার সন্তান আসে না। অতএব পুত্রসন্তান লাভের প্রয়োজনেই স্ত্রীর মূল্য।
যার স্ত্রী নেই সে যজ্ঞে অনধিকারী।
পুরুষের অধিকার আছে একাধিক পত্নীকে বিবাহ করার, অসংখ্য উপপত্নী রাখার এবং গণিকার কাছে যাওয়ার, স্ত্রীর কিন্তু উপপতি রাখার অধিকার নেই; স্ত্রীর উপপতিকে ধ্বংস করার জন্য উপচার ক্রিয়ার বিধান আছে।
নারী নিজেই পাপ। কতটা? অমৃতকে দেখবে না, অর্থাৎ নারী, কুকুর ও কালো পাখি দেখবে না; অন্যথায় পুণ্য ও পাপ জ্যোতি ও অন্ধকার সত্য ও মিথ্যা মিশে যাবে। [ইসলামেও নারী আর কুকুরকে এক লাইনে দেখা হয়েছে।]
নারী মিথ্যা, দুৰ্ভাগ্য, সে মদ বা জুয়ার মতো ব্যসন মাত্ৰ। [মদ-জুয়া-নারী!]
কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শূদ্র ও নারী হত্যার জন্য প্ৰায়শ্চিত্ত মাত্র একদিনের কৃচ্ছসাধন। [আবারো কুকুর… সেই সাথে হিন্দুধর্ম নারী ও শূদ্রের অবস্থান আরেকবার…]
সর্বগুণসমন্বিতা নারীও অপকৃষ্টতম পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট। [হুমায়ুন আজাদ নারীগ্রন্থে এই কথাটা অনেকবার উল্লেখ করছেন।]
সারস্বতস্বস্তয়ন নামক যজ্ঞের দক্ষিণা একটি ঘোটকী এবং একটি সন্তানবতী দাসী।
নারীদের শ্রেণিভাগ– কুমারী, সধবা, সন্তানবতী বা নিঃসন্তান।
নারীর জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য পুরুষকে তার যৌবন, রূপ, লাস্য এবং গৃহকর্মে তার শ্রম দিয়ে তুষ্ট করা। সেই পুরুষ ও তার আত্মীয়স্বজনকে তার নম্র হয়ে সেবা করতে হবে, কাজে বা কথায় তাদের কোনও প্রতিবাদ না করে। নিজের শরীরের উপরে তার কোনও অধিকার নেই; তার সম্পত্তি অর্জন বা ভোগ করার অধিকার নেই, এমন কি স্বামীর সম্পত্তিতেও অধিকার নেই।
বিবাহ অনুষ্ঠানে বরের উচ্চারিত একটি মন্ত্রে: এস আমরা মিলিত হই, যেন পুত্রসন্তান উৎপন্ন হয়, যে সন্তানদ্বারা সম্পত্তিবৃদ্ধি হবে। [জনসংখ্যার দিক দিয়ে আর সবাইকে হারিয়ে দেয়ার ইচ্ছার দোষ মুহম্মদের একার নয়।]
বিয়ের আরেক মন্ত্র–আমি যেন পুত্র, পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্ৰ, কম্বল, ধাতু, বহু ভাৰ্যা, রাজা, অন্ন ও নিরাপত্তা লাভ করি। [বিয়েপ্রথা!]
‘ভার্যা’ ও ‘ভৃত্য’ শব্দ দুটি একই ‘ভৃ’ ধাতু থেকে নিম্পন্ন (অর্থাৎ ভরণ করা), এবং মূলগত ভাবে তাদের বিষয়ে একই ধারণা। [ভার্যা একই সাথে দাসী এবং যৌনদাসী।]
যে নারী যুক্তিসঙ্গত ভাবে তর্ক করতে পারে ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঋষিকে তর্কে কোণঠাসা করে ফেলতে পারে, তার বিষয়ে সমাজের রক্ষণশীলতা প্রতিফলিত হয়। গার্গীর প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের অযাচিত তিরস্কারে: আর প্রশ্ন কোরো না তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে। [যাজ্ঞবল্ক্যরে হলো বিচিবাদের জনক বলা হলে আশা করি বেশি বলা হবে না। আমাদের বিচিবাদীরাও নারীদের মুখ বন্ধ করতে এমনটাই বলে বা করে থাকে।]
Leave a Reply