মনীষীরা দেশপ্রেম নিয়ে লিখেছেন। তাদের কথার প্রতিধ্বনি করে একলাইনে যা পাওয়া যায়—দেশপ্রেম ধর্মপ্রেমের মতই ক্ষতিকর।
দেখে নিন দেশপ্রেম নিয়ে মনীষীদের কিছু বাণী—
‘দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয়স্থল বা ভরসাস্থল‘– স্যামুয়েল জনসন
‘বক্তৃতাবাগীশ রাজনৈতিক নেতারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বদলে স্বদেশপ্রেমের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য জনসাধারণকে আবেগ তাড়িত করে খেপিয়ে দেন। এ ধরনের নেতারা জনসাধারণের সমর্থন পাওয়া এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার আশায় যা খুশি তাই বলতে পারেন। কোনো ব্যক্তি যদি এই ধরণের নেতার সাথে একমত না হন তাহলে সেই নেতার ভিন্নমত পোষনকারী ব্যক্তিটিকে দেশপ্রেম, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশে বিরোধী রুপে আখ্যায়িত করতে পারেন। সৎ মনে ভিন্নমত পোষন করলেও সেই ব্যক্তির চরিত্র হনন করা হতে পারে। এই ধরণের নেতা যখন দেশপ্রেম প্রচার করেন তখন তার আসল মতলব থাকে জনসাধারণের সরল অনুভূতিগুলোকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা।“– জেমস লিরয়
“খুব তুচ্ছ কারণে হত্যা করতে এবং নিহিত হতে রাজি হওয়াই হচ্ছে দেশপ্রেম।“–বারট্রান্ড রাসেল
“যদি দেশপ্রেম হয় একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয়স্থল তবে সেটা শুধু দেশপ্রেমের নামে খারাপ কাজ করার জন্যই সে সেটা প্রচার করে না। সে দেশপ্রেমের তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে নৈতিকতার সকল সীমারেখা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষেও দেশপ্রেমের কথা বলতে পারে।“–রালফ বি পারি
“দেশপ্রেম হচ্ছে চরম বুদ্ধিহীনতার একটি বিধ্বংসী ও বিকারগ্রস্ত রুপ।“–বার্নড শ
“দেশপ্রেম হচ্ছে দুষ্টের গুন।“–অস্কার ওয়াইল্ড
“যদিও আমি ড. স্যামুয়েল জনসন মত পণ্ডিত নই তবুও আমার মনে হয় তিনি একটা ভুল করেছিলেন। দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয়স্থল বা ভরসাস্থল নয়, এটি হচ্ছে তার প্রথম আশ্রয় বা ভরসাস্থল।“–অ্যামব্রোস বিয়াস
ধর্মপ্রেমীরা যেমন তাদের ধর্মটাকেই একমাত্র সত্য এবং সব ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে, দেশপ্রেমীরাও শুধু তাদের দেশটাকেই ভালোবাসে, আর সব দেশ ও দেশের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে। যেমন হিন্দুরা মুসলমানদেরকে বর্বর ইত্যাদি বলে, মুসলমানরা হিন্দুদের মালাউন ইত্যাদি বলে, তেমনি বাংলাদেশপ্রেমীদের দেখা যায় পাকিস্তানকে হেয় করে ফাকিস্তান, ইণ্ডিয়াকে রেণ্ডিয়া, ভারতপ্রেমীরা বাংলাদেশকে কাঙলাদেশ—এরকম আরো অনেক কিছু বলে থাকে।
অথচ আপনি যখন মানবতার কথা বলতে চান, একজন মানববাদীর আসনে নিজেকে দেখতে চান, তখন মনে রাখা উচিত আপনি শুধু আপনাদের দেশের মানবতার কথা বলছেন না, আপনি শুধু আপনার দেশের মানুষের জন্য মানববাদী নন; আপনি বিশ্বমানবতার কথা বলতে চাইছেন, সারা বিশ্বের জন্য মানববাদী হতে চাচ্ছেন। আপনার এই চাওয়ায় ধর্মের মতই দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে দেশ এবং দেশের সীমানা।
যে তার নিজের মাকে ভালোবাসে, সে কি অন্যের মাকে গালি দিতে পারে? যে তার নিজের বোনকে ভালোবাসে, সে কি অন্যের বোনকে গালি দিতে পারে? যে নিজের বন্ধুকে ভালোবাসে, সে কি অন্যের বন্ধুকে গালি দিতে পারে? যদি না পারে, তাহলে যে নিজের ধর্মকে ভালোবাসে, সে কিভাবে অন্যের ধর্মকে গালি দেয়? যে নিজের দেশকে ভালোবাসে, সে কিভাবে অন্যের দেশকে গালি দেয়? কিন্তু যেহেতু এরা নিজেদেরকে ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে অন্যের ধর্ম, দেশ, মা-বোন সবাইকে গালি দেয়, সেহেতু ধরে নেয়া যায়—এরা নিজের ধর্ম, দেশ, মা-বোন কাউকেই ভালোবাসে না।
দেশ কাকে বলে? দেশ কী? যখন আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে যাবেন, তখন দেশ কী হবে? যখন সৌরজগতের বাইরে যাবেন, তখন দেশ কী হবে? যখন মহাশূণ্যে যাবেন, তখন দেশ কী হবে? যখন বিদেশ যাবেন তখন দেশ কী হবে? যখন বাংলাদেশে যাবেন, তখন দেশ কী হবে? যখন জেলায় যাবেন, তখন দেশ কী হবে? আচ্ছা, ৭১-এর আগে আমাদের দেশ কী ছিল? ৪৭-এর আগে আমাদের দেশ কী ছিল? বহিরাগতদের আগমনের পূর্বে যখন আমরা ভারতকেই সারা পৃথিবী বলে জানতাম, তখন আমাদের দেশ কী ছিল?
-তাহলে কি দেশের প্রতি ভালোবাসা বা দেশপ্রেম কি একেবারেই থাকতে নেই?
—অবশ্যই আছে। বলতে গেলে দেশপ্রেম এতটাই থাকা উচিত যার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত নয়।
-কেমন?
—এক সাথে দুনিয়ার সব ধর্মগুলোকে সম্মান করতে বা মেনে নিতে পারবেন না, কারণ একটা আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু দেশপ্রেমের বেলায় এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আপনি নিজের বেডে থাকেন, তখন রুমের অন্য বেডগুলোকে কি নিজের বেডের মত আপন মনে হয়? হয় না! যখন নিজের রুমে থাকেন তখন ঘরের অন্যান্য রুমগুলোকে কি ততটা আপন মনে হয়? হয় না! যখন বাড়িতে থাকেন তখন নিজের ঘরটার মত কি অন্য ঘরগুলোকে আপন মনে হয়? হয় না! যখন পাড়াতে থাকেন, তখন নিজের বাড়ির মত কি অন্য বাড়িগুলোকে আপন মনে হয়? হয় না! যখন গ্রামে থাকেন তখন নিজের পাড়ার মত কি অন্য পাড়াগুলোকে আপন মনে হয়? হয় না! যখন এলাকায় যান, তখন নিজের গ্রামের মত কি অন্য গ্রামগুলোকে ভালোবাসেন? বাসেন না! অন্য এলাকাগুলোকে নিজের এলাকার মত ভালোবাসেন না। অন্য জেলাগুলোকে নিজের জেলার মত ভালোবাসেন না। অন্য দেশগুলোকে নিজের দেশের মত ভালোবাসেন না। এবার পৃথিবী ছেড়ে যদি মহাশূন্যে যান, অন্য গ্রহগুলোকে ততটা ভালোবাসবেন, যতটা বাসেন পৃথিবী নামক গ্রহটাকে? দেশের বাইরে আছি, তবে মহাশূন্য যাইনি। যারা যায়, অনুমান করি তারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই আমাদের পৃথিবী! তারা তখন নিশ্চয়ই বলেন না, ওই আমাদের দেশ! এভাবে আরো অনুমান করি, সৌরজগতের বাইরে গেলে আমাদের এই সৌরজগতের দিকেই তাকিয়ে থাকব, কেননা ওটার আমাদের দেশ। গ্যালাক্সির বাইরে গেলে আমাদের গ্যালাক্সির দিকেই তাকিয়ে থাকব, মনে হতে ওটাই আমাদের দেশ।…এর শেষ কোথায়, জানি না! বলতে চাইছি, নিজেকে যত বড় মনে করবেন, আপনার এই দেশপ্রেমটাও তত বড় হবে।
বাংলাদেশেকে ভালোবেসে কেউ কি পৃথিবীর ধ্বংস কামনা করেন? কিংবা দেশপ্রেমের ঠেলায় কেউ কি ভাবেন, বাংলাদেশ বাদে আর সব দেশ ধ্বংস হয়ে যাক? আমি অন্তত ভাবি না। আপনার দেশপ্রেম একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যার কখনোই সম্প্রসারণ হবে না, কিন্তু সংকোচন হবে। আমার দেশপ্রেম উলটো…এই দেশ এই পৃথিবী এই সৌরজগত… যতই নিজের বলে মনে করি, দেশপ্রেমটা ততই সম্প্রসারিত হয়।
কেয়া শারমিন
এত সহজ কথাগুলো এত সহজে কখনো কাউকে বলে বোঝাতে পারিনি। অনেক ধন্যবাদ সহজ মানুষ হওয়ার জন্য।
dadago
অসাধারন পাল্লাদা,অসাধারন..
সেবা দেবী
আনন্দময় ও অকপট কথা ! আলোকের মতই স্বচ্ছ ও সত্য ! যত দ্রুত এই সত্য প্রতিটি মানুষের হৃদয়ভূমি ( মনের গহন কন্দরটুকু ) আলোকিত করতে পারে
ততই মঙ্গল ! মানবজাতি ও তার সভ্যতা তখনই উত্তীর্ণ হবে পরম সার্থকতায় !!