৪৭-এর দেশভাগ কি জাতিগত দ্বন্দ্ব না কি ধর্মীয়? চোখ বুজে বলে দিতে পারবেন–ধর্মীয়। তারপর বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ–জাতিগত? মোটেই না। ধর্মীয়। ৭১-এ পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছে, অনেকেই বলেন সেটা জাতিগত দ্বন্দ্বের ফল। মোটেই না। ওটাও ধর্মীয়। খেয়াল করেন, পাকিস্তানিরা টার্গেট করেছিল হিন্দুদের, এবং বাঙালি মুসলমানদের তারা মনে করত হাফ হিন্দু।
বাংলাদেশের হিন্দুরা কি জাতি হিসাবে মুসলমানদের চেয়ে আলাদা? না, উভয়েই জাতি হিসাবে বাঙালি। তবুও ৭১-এর পর থেকে এ দেশের মুসলমানরা হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার করে আসছে, তার পেছনে ধর্ম ছাড়া আর কিছু নয়।
বার্মায় রোহিঙ্গাদের উপর বৌদ্ধদের অত্যাচার আপাত দৃষ্টিতে জাতিগত বিদ্বেষ মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে সেটাও ধর্মীয়। বার্মিজরা মুসলমান হলে রোহিঙ্গাদের সাথে কোন সমস্যাই হত না, যেমন হয় রোহিঙ্গাদের সাথে বাংলাদেশের মুসলমানদের। রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমান বলেই বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
পাহাড়ে সেটলার বাঙালিরা যা করে আসছে, সেটাকেও অনেকে জাতিগত দ্বন্দ্ব বলে চালিয়ে ধর্মের পেছন বাঁচাতে ব্যস্ত। ভেবে দেখেন পাহাড়িদের সাথে কোনো হিন্দু বাঙালির বিরোধ নেই, আছে শুধু মুসলমানদের। পাহাড়িরা মুসলমান হলে কোনো বাঙালির ক্ষমতা ছিল না তাদের বিন্দুমাত্র হিন্দি চুল ফেলানোর।
এক আরবের বংশধর পাহাড়িদের নাকি বাঙালি হয়ে যেতে বলছিল। সেই বংশধর ভালো করেই জানত–এত সহজে কেউ এক জাতি থেকে আরেক জাতিতে রূপান্তর হতে পারে। সে আসলে বলতে পাহাড়িদের মুসলমান হয়ে যেতে বলছিল। ভেবে দেখেন, হিন্দুরা বাঙালি হওয়ার পরেও মুসলমানদের কাছে নিরাপদ ছিল না, নাই, থাকবেও না। কিন্তু যেসব হিন্দু নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তারা মুসলমান হয়ে মুসলমানদের কাছে ভালো আছে।
আসলে জাতি জিনিসটা কী, সেটাই আমরা ভালো করে বুঝি না। সেজন্য আরবের বংশধরেরাও বাংলাদেশে এসে শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে আমাদের কাছে বাঙালি বলে চিহ্নিত হয়–মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই হয়ে যায়। শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে পাকিরাও আজ বাঙালি মুসলমানদের আপন, কিন্তু একই জাতির হিন্দুরা গণিমতের মাল।
সবশেষে, জাতি জিনিসটাকে বুঝতে গেলে আসলে মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতেই ঝামেলা বেঁধে যা। জাতে আরব আদম-হাওয়া থেকে দুনিয়ায় এত জাতের সৃষ্টি হওয়াটা যে অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব, এবং সেই সাথে ইসলাম ধর্মটাই মিথ্যে হয়ে যায়–এ কারণে এ কোনো মুসলমানই জাতি জিনিসটাকে বুঝতে চাইবে না, বুঝলেও না বোঝার ভান করে থাকবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ভয়–জাতি জিনিসটা বুঝলে তাদের পক্ষে আর মুসলমান হয়ে থাকা সম্ভব হবে না, মানুষ হয়ে যাবে যে!
Leave a Reply