উড়নডণ্ডী কালী যখন ‘রণে’ নামত, তখন হাতের কাছে যাকে পেতো তারই কল্লা কাটত। তাকে থামাতে মহাদেব বাধ্য হয়ে তার পথের উপর শুয়ে পড়েছিল, যাতে তার উপর পা পড়লে কালী লজ্জিত হয়ে তার ধ্বংসলীলা থামায়, না হলে মানবসভ্যতাই বিলীন হয়ে যেত। আগের পোস্টটাতে হিন্দুরা কালীকে ডিফেণ্ড করতে আসছে এই বলে যে আইসিস কোতল করে নিরীহ লোকদের, আর কালী কোতল করত রাক্ষস-অসুরদের।
আইসিস শুধু নিরীহ লোকদের কোতল করে না, তারা কোতল করে তাদের মতের সাথে যায় না, এমন সবাইকে। ভিন্ন মতের সেনাবাহিনী, পুলিশ–এদেরকেও এরা কোতল করছে।
এবার প্রশ্নঃ রাক্ষস-অসুর–এরা কারা?
রাবণকে তো হিন্দুরা রাক্ষস-অসুর ইত্যাদি বলে। রাবণের পিতার নাম বিশ্রবা, একজন স্বনামধন্য ঋষি। রাবণের ঠাকুরদা পুলস্ত্য, একজন প্রখ্যাত মুনি। সপ্তর্ষি মণ্ডলের সাতটি তারার একটি তারা এনার নামে নামকরণ করা হয়েছে। চরক সংহিতায় দেখা যায়, পৃথিবীতে যখন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলো তখন মানুষের তপস্যা, উপবাস, অধ্যয়ন, ব্রত ও আয়ুর বিঘ্ন ঘটতে শুরু করল। তখন মহর্ষিগণ এই রোগ-শোক থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হিমালয়ের পাশে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেই সভাতে পুলস্ত্য মুনিও ছিল। রাবণ ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। তার নামটাও নাকি স্বয়ং শিবের দেয়া। শোনা যায় দুর্গা রাবণের দ্বাররক্ষী ছিল, অন্নপূর্ণ তার ভাণ্ডার সামলাত। এরকম বহু দেবদেবী রাবণের বাড়িতে কামলা দিত।
এহেন রাবণ কিভাবে ইতিহাসের পাতায় রাক্ষস-অসুর হয়ে গেলো, নচিকেতার একটা গানের লাইনেই মনে হয় পরিষ্কার–“রাম যদি হেরে যেত, রামায়ণ লেখা হত, রাবণ দেবতা হতো সেখানে।”–রাবণ দুর্ভাগ্যবশতঃ রামের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। ফর্সা চামড়ার লোকেরা জিতে গিয়ে ইতিহাস লিখল, কালো চামড়ার রাবণ হয়ে গেলো ভিলেন–রাক্ষস-অসুর। বর্ণবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ–যা আজও সভ্যতার অন্যতম আঁতুরঘর ভারতের বর্তমান অশিক্ষিত-মূর্খ ভারতবাসী গর্বের সাথে বলে থাকে। অথচ ইউরোপ-আমেরিকাতে বর্ণবাদকে এতটাই ঘৃণা করা হয় যে তারা “নিগ্রো” শব্দটাকেই ব্যান করে দিয়েছে। এই শব্দ উচ্চারণ করলে জেল পর্যন্ত হতে পারে সেখানে।
দুর্গাপূজার সময় দুইটা লেখায় দেখিয়েছিলাম, এই সব রাক্ষস-অসুররা আর কেউ নয়, এরা ভারতের স্থানীয় আদিবাসী, সভ্যতার বিচারের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ব্রাহ্মণ্যবাদের বর্ণভেদের জাঁতাকলে পিষ্ট নিম্নবর্ণের মানুষ। কিন্তু রাবণের জীবনীই বলে দেয় এরা কোনো ভাবেই অসভ্য ছিল না, আর্য-ব্রাহ্মণদের মত ভণ্ড, কুটিল, নিষ্ঠুর ছিল না। রাবণের পরাজয়, দুর্গা-পর্ণশরবীর পায়ের তলায়, কালীর গলায়–সেসব মূর্তি দেখি, সেগুলো সমাজের এই আদি অকৃত্রিম মানুষগুলোর উপর সবলের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের প্রতীক। ব্রাহ্মণরা নিজেরা তো পূজা করেই, অন্য বর্ণের লোকদের দিয়েও এইসব পূজা করায়। ব্রাহ্মণরা বর্ণভেদ প্রথা, নিজেদেরকে ঐতিহ্য-অহংকার হিসাবে এসব চালু রাখতে চায়। কিন্তু অন্য বর্ণের মানুষেরা কেন সেটাকে আজও সাপোর্ট করে, সেটা মাথায় ঢুকে না!
আপনার লেখাগুলো পড়ি আর অভিভূত হয়ে যাই। ধর্মীয় বই পত্র কোনো দিনই পড়ি নি। ওতে কোনো দিনই আগ্রহ ছিল না। ফেসবুকের থেকে এই বিষয়গুলো কিছুটা হলে ও জানতে পারছি বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে এবং আপনার বিশ্লেষন ভালই । এটা আমার কাছে বড় প্রাপ্তি।