বিশুর ঠাকুরদার মানুষটি ‘ধার্মিক’ ছিলেন না। আসলে তাদের পরিবারে হিন্দুদের পূজার্চনার চলই ছিল না। এটা শুরু করেছিলেন বিশুর ঠাকুরমা। তারপরেও সাঁওতাল-সংস্কৃতির কিছুটা বিশুর ঠাকুরদা বেঁচে থাকা অবধি টিকে ছিল তাদের পরিবারে। সে গল্প আগে একবার বলেছি। আজ হোলি প্রসঙ্গে ভিন্ন একটু কাহিনী শোনা যাক–
আমাদের এলাকার ভিতর দিয়ে বিশুদের গ্রামের পশ্চিম সীমানা দিয়ে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া খালে একসময় লঞ্চ চলত। বন্যার সময় পানি প্রায় উপচে পড়ত, আর ছিল প্রচণ্ড স্রোত। একপাশে বড় রাস্তা–এটা সহজে ভাঙার নয়। অন্য পাশে পাথারের জমিজমা রক্ষা করার জন্য উঁচু বাঁধ। তবে রাস্তা আর বাঁধের দুদিকেই ছিলে প্রচুর গাছপালা–বাবলা আর খই গাছের সংখ্যাই বেশি। শীতকালে অনেকেই যার যার জমি সংলগ্ন গাছ কেটে নিত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। এছাড়া অনেকে চুরি করেও গাছ কেটে নিয়ে যেত। পরের বন্যায় ওই জায়গাগুলো ধ্বসে গিয়ে বাঁধ ভেঙে পাথারের ফসল নষ্ট হত।
যেখানে বড় বাঁকটি ছিল, সেই মোড়ে ছিল বড় একটি বটগাছ। প্রচণ্ড স্রোতে গোড়ার দিকের মাটি অনেকটা ক্ষয়ে গেলেও এই পাড়টি ভাঙত না শুধু এই বটগাছটির জন্যই। বর্ষার সময় পানিতে গাছটির গোড়া প্রায় তলিয়ে যেত। নিজের কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে–বিশুর সাথে বর্ষার সময় এই গাছের শিকড়ের ফাঁকে ফাঁকে বড়শি ফেলে বড় বাইন ধরার দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভাসে।
আর কিছু স্মৃতি আছে হোলি খেলা নিয়ে। বিশুর ঠাকুরদা হিসেবী মানুষ হলেও হোলির আগের হাটবার নিজের পয়সায় প্রচুর বাতাসা আর আবির কিনে রাখতেন। হোলির দিন সকালে ওসব বাড়ির ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন বটগাছের গোড়ায় পূজা দিয়ে আসতে। বিশুরা গ্রামের আর সবাইকে নিয়ে ডাঙ্কা বাজিয়ে বটগাছ পূজা করত। তারপর আবির খেলা। নিজেরা খেলে তারপর ডাঙ্কা বাজাতে বাজাতে আবার গ্রামের দিকে আসত। প্রতিটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই বাতাসা বিলাত, আর সবার মুখে আবির মেখে দিত। তারপর গ্রামের সবাই মিলে আবার এই বটতলাতে আসত। অনেকক্ষণ নাচানাচি করে, কাদামাটি ছোড়াছুড়ি করে তারপর খালের পানিতে গোসল দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরত।
বিশুর ঠাকুরদা অনেকদিন হয় নেই। উনি মারা যাবার পরে খুব একটা বন্যাও হয় নাই, আর বিশুরাও বিদেশ চলে যাওয়াতে ওই বটগাছ পূজাও হয় নাই। ধীরে ধীরে খালটা প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালেই পানি থাকে না বললেই চলে। বটগাছটিও ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বিশু নিজেও অবাক হত–তার ঠাকুরদা পূজাটূজা মানত না, তারপর আবার হিসেবী মানুষ। সেই মানুষ কিনা নিজের পয়সা খরচ করে বাতাসা-আবির কিনে দিত, পূজা করতে বলত! বিশু পরে বলেছিল–ওই পূজাটা আসলে ছল–হিন্দুরা এই গাছটিকে পূজা দেয়–এই বিষয়টাকে শ্রদ্ধা করে কেউ গাছটি কাটবে না–গাছটি রক্ষা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তবে আমি ভাবতাম–গ্রামের এই খেটেখাওয়া মানুষগুলোর কথা–কত অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে এরা থাকে। আবার সামান্য উৎসবে এরা যেভাবে আনন্দে মেতে উঠত–মনে হত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষগুলো এরাই।
২) এ বছরের হোলি উৎসব শেষে খবরে দেখলাম মুসলমানরা এই বলে উস্কানি দিচ্ছে যে ৯৭% মুসলমানের দেশে হিন্দুরা নাকি হিজাব পরা মেয়েদের জোর করে আবির দিয়েছে, গায়ে হাত দিয়েছে, হিন্দুরা এত সাহস কোথায় পায়, এত কিছু করার পরেও তারা এই দেশে এখনো কিভাবে আছে! যদিও পরে দেখা গেছে এগুলা করেছে মুসলমানেরাই। পুলিশ তিনজনকে আটকও করেছে!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার নাই। বিশুরা যতদিন দেশে ছিল, বন্ধুবান্ধব মিলে তাদের গ্রামে গিয়ে পূজা-অনুষ্ঠান-উৎসবে যোগ দিয়েছি, ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে রঙ খেলেছি, আবির খেলেছি, জলকেলি করেছি, নাচানাচি করেছি–কেউ কোনো আপত্তি করে নি। কেউ বলতে পারে নি–মুসলমান পাড়ার কোনো ছেলে অসভ্যতা করেছে, বা হিন্দু বা মুসলমান ছেলে কোনো হিন্দু মেয়ে বা নারীকে অযাচিত ভাবে স্পর্শ করেছে। অথচ সবাই সবার গালে রঙ লাগিয়েছে।
অনেকদিন হয় সব ধরনের ধর্মীয় উৎসব থেকে দূরে থাকছি। তবে কেউ উৎসব পালন করলে বাধা দিচ্ছি না। শুধু এইটুকু বলি যে ধর্মের নাম, পুণ্য সঞ্চয়ের নামে এগুলো করা বোকামী। ধর্ম-ধার্মিক-আস্তিকেরা সব কিছুতেই শেষ পর্যন্ত অন্ধকার টেনে আনে। তাই ধর্ম বাদ দিয়েই উৎসব হোক–উৎসবমুখর হয়ে উঠুক প্রতিটা মানুষের জীবন…প্রতিটা দিন…
Leave a Reply