ধর্ম সম্পর্কিত একটা পোস্ট ফেসবুকে ঘুরছে। তাতে ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম…’ ভিত্তিতে কিছু ধর্মীয় প্রশ্ন এবং উত্তর আছে। তার মধ্যে একটা প্রশ্নে চোখ আটকে গেছে–পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নিজ মায়ের সাথে এসইএক্স করে কে? তাতে উত্তর হিসাবে গণপতির নাম লেখা। এই তথ্যটা কোন রেফারেন্স থেকে নেয়া হয়েছে, আমার জানা নেই। তবে অবাক হইনি। কালিকা পুরাণ আর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন‘ পড়া থাকলে আপনারাও কেউ অবাক হবেন না
পড়ুন – গণপতি—বস্তুবাদের উৎস-সন্ধানে
পড়ুন – কালিকা পুরাণ
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ‘গণপতি’ নামটির বিশ্লেষণ করেছেন। অনেক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ‘গণেশ’ মানে কী–সেটা পরিষ্কার করেছেন। এখানে শুধু অতুলচন্দ্র গুপ্তর কিছু কথা উল্লেখ করি–“সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা বলে যে দেবতাটি হিন্দুর পূজা-পার্বণে সর্বাগ্রে পূজা পান, তাঁর গণেশ নামেই পরিচয় যে, তিনি ‘গণ’ অর্থাৎ জনসঙ্ঘের দেবতা। এ থেকে যেন কেউ অনুমান না করেন যে, প্রাচীন হিন্দুসমাজের যাঁরা মাথা তাঁরা জনসঙ্ঘের উপর অশেষ ভক্তি ও প্রীতিমান ছিলেন। যেমন তার সব সমাজের মাথা, তেমনি তাঁরাও সঙ্ঘবদ্ধ জনশক্তিকে ভক্তি করতেন না, ভয় করতেন!…গণশক্তির প্রতি প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার কর্তাদের মনোভাব কি ছিল। তা গণেশের নরশরীরের উপর জানোয়ারের মাথার কল্পনাতেই প্রকাশ।”
পড়ুন – গণপতি থেকে গণজাগরণ
গণেশের মাথাটা হাতির মাথা হলো কী করে–যাদের প্রচীন গোত্র বা ট্রাইব্যাল সমাজ নিয়ে ধারণা আছে–তারা সহজেই বুঝতে পারবেন। [যারা বুঝেন না, তাদের সদিচ্ছা থাকলে নিজেরাই পড়াশোনা করে জেনে নিতে পারেন, আর যারা বুঝবেন না বা বুঝতে চাইবেন না, তাদেরকে শত বলেও বুঝানো যাবে না।] যেমন মহিষাসুর আসলে কোনো মহিষ বা ‘অসুর’ নন, তিনি প্রাচীন ভারতের কোনো একটা গোত্রের প্রধান ছিলেন যাদের ‘সিম্বল’ ছিল মহিষ। এখনো এই গোত্রের মানুষদের সন্ধান মেলে–তারা দুর্গাকে নয়, এই মহিষাসুরকে পূর্বপ্রজন্মজ্ঞানে পূজা করেন এবং দুর্গা প্রতিমার মুখ দেখেন না। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের অন্যতম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বাজিপাখি-মস্তক সদৃশ হোরাসকেও উদারহণ হিসাবে আনা যেতে পারে।
দুর্গাপূজা : অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতীক
তো গণপতি গণেশ ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরী উরফে দুর্গা দেবীর পদানত হওয়া পূর্বক আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়াতে তাকে আর মরতে হয় নি। গণেশ উলটে গিয়ে বিঘ্নকারী থেকে হয়ে গেলেন সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, পেলেন ইনু-মেননদের মতো মন্ত্রীত্ব–যার কারণে গণেশের পূজাটাই সবার আগে হয়; পেলেন ধন সম্পদ অলংকার আর অতি অবশ্যই ‘নারী’। এই বিষয়ে আবার পরে আসছি। তার আগে কালিকা পুরাণ থেকে–
২)
হিমালয় অঞ্চলের পাহাড় পর্বত নদনদী অরণ্যবাসীরা তাদের রাজাকে হিমালয় বলেন। তার কন্যা দেবী কালী। এরা আদি অনার্য। এদের দেবতা দেবাদিদেব শিবের বাসও এই অঞ্চলে। এরা ওখানকার লতাপাতা-গাছগাছালি দিয়ে অনেক আগে থেকেই আয়ুর্বেদের চিকিৎসা জানত। ওদিকে শিবের কাছ থেকে আর্যরা কোনো এক সময়ে এই চিকিৎসার কথা শুনে থাকবে। আর্যদের মধ্যে ধীরে ধীরে ‘ভারতীয় রোগ’-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তারাও এই চিকিৎসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এইটাই হয়তো তাদের হিমালয় অঞ্চলের দিকে চোখ পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
একদিকে এ অঞ্চলের অনার্যদের শক্তি সামর্থ্য, অন্যদিকে শিবের আশীর্বাদ–তাই এই জায়গাটা দখল করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে নি। আর্যরা আগে নজর দেন শিবকে হাত করতে। ঠিক করেন শিবকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিবেন। অবশ্য এর পেছনে ছিল সুদূর প্রসারী আরেক চক্রান্ত। সে বিষয়ে পরে আসছি।
অনার্য হিমালয় কন্যা কালী–অনার্যদের কাছে যিনি দেবীরূপে পরিচিত (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সরাসরিই বলেছিলেন যে, কালী সাঁওতালী…)–আর্যরা ঠিক করল এর সাথেই শিবের বিয়ে দেবেন। ভালোমানুষীর মতো ঘটকালী করে বিয়েটা দিয়েও দিল। তারপর হানিমুনের কথা বলে শিব আর কালীকে দূরে নির্জনে নিয়ে গেলো। আর সেখানে পাঠিয়ে দিল ট্রেইনিং প্রাপ্ত অপ্সরাদের। সবাই জানেন, যেখানে বলে কাজ উদ্ধার হয় নি বা বল প্রয়োগের দরকার হয় নি, সেখানেই তারা এইসব অপ্সরাদের পাঠিয়ে দিত ছলে কাজ উদ্ধারের জন্য। উদাহরণ স্বরূপ ইন্দ্রের নির্দেশে মেনকা কর্তৃক বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গ, রম্ভা কর্তৃক জাবালি মুনির তপোভঙ্গ, সুন্দ ও উপসুন্দ বধের জন্য তিলোত্তমার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আর এখানে ভূমিকা নেন অবতীর্ণ উর্বশী।
পড়ুন – উর্বশী উর্বশী টেক ইট ইজি উর্বশী
উর্বশী কালীকে দেখে ভয় পাওয়ার অভিনয় করলে শিব কালীকে বলেন যে উনি নাকি কালীর গায়ের কালো রঙ দেখে ভয় পেয়েছেন। তখন কালীও বায়না ধরে তার গায়ের রঙও ফর্সা হতে হবে। শিব বলেন যে, আকাশগঙ্গা নদীতে স্নান করালে গায়ের রঙ ফর্সা হবে। (ভোলানাথকে এই বুদ্ধিটা কে দিয়েছিল, জানা নেই, তবে সন্দেহ হয় এটা আগে থেকেই আর্যরা শিবের কানে কৌশলে কথাটা দিয়ে রেখেছিল।)
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক কাহিনীগুলোতে মাঝে মাঝে নদীতে স্নান করতে নেমে উধাও হয়ে যাওয়ার ‘দুর্ঘটনার’ কথা শোনা যায়–মূলত এগুলা এক ধরনের গুপ্তখুন–রাজনৈতিক কারণেই এগুলা বেশি হতো। এতে শিকার নদীতে নামলে রাজার ডুবুরীরা ডুব দিয়ে এসে পা ধরে টেনে মাঝনদীতে নিয়ে ডুবিয়ে বা গলাটিপে বা অন্য কোনোভাবে মেরে ফেলে। কালীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল–তাকে আর্যদের ডুবুরীরা ওভাবে টেনে নিয়ে যায়, আর কালীর জায়গায় শিবের সামনে ভেসে ওঠে দুর্গা–যে মূলত অপ্সরাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধু রূপে নয়, গুণে এবং সাহসেও আর সবার চেয়ে সেরা। অনেক আর্য মিলে একে বিভিন্ন ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে সেরা এক যোদ্ধা এবং ‘স্পাই’ হিসেবে। এর হাতে যে বিভিন্ন দেবতাদের দেয়া বিভিন্ন অস্ত্র–সেগুলা মূলত বিভিন্ন আর্যের কাছ থেকে প্রাপ্ত ‘ট্রেইনিং’। পরে সে কালীর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে অনার্যদের মাঝে প্রবেশ করে, এবং শিবের কাছ থেকে অনার্য মহিষাসুর বধের আসল ‘ট্রেইনিং’ বা ‘অস্ত্র’ লাভ করে। আর সবাই জানেন–এই শিবের দেয়া ‘অস্ত্রেই’ মহিষাসুর ‘বধ’ হয়।
৩)
ভারতীয় সনাতনী সমাজে প্রায় একই ব্যাপার বার বার ঘুরে-ফিরে আসে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সমাজটা ধর্মনির্ভর, এবং ধর্মটা অনেকদিন ধরে সংস্কার হয় না। সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। পুরানো দিনের কাহিনী আবার নতুন করে সাহিত্য-সিনেমায় প্রচুর দেখা যায়। আবার কিছু ব্যাপার আছে, যা সব সমাজের বেলাতেই প্রযোজ্য। যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে চানক্যের অর্থশাস্ত্র। ওদিকে জেমস বন্ডের সিনেমায় তো ওরকম বিভিন্নভাবে ট্রেইনিং প্রাপ্ত সুন্দরী স্পাই থাকাটা বাধ্যতামূলক। হালের বাংলা সিরিয়ালগুলোতেও এরকম কিছু না হলে কাহিনী জমে না। যেমন ধরুন, জি-বাংলার ‘ত্রিনয়নী’ সিরিয়ালটা–চারদিকে ছেলেটার শত্রু। তাকে বাঁচাতে তার ‘রক্ষাকবচ’ হিসাবে আসছে ত্রিনয়নী নামের মেয়েটি, যার চেহারা আর কাজকর্ম রক্ষাকালীর সাথে তুলনীয়। আর নেগেটিভ রোলের সুন্দরী মেয়েটা ‘স্পাই’, যে কিনা ছেলেটার সম্পত্তি অধিকারপূর্বক তার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়। কাকতালীয় ভাবে মেয়েটা আগে আরেকটা সিরিয়ালে (ভোলা মহেশ্বর) পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করে আসছে।
৪)
সতী, কালী, পার্বতী, বাসন্তী… ওদিকে আগে ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরী–এরা সবাই-ই নাকি দুর্গা! কিন্তু জন্মান্তরের এই ব্যাপারটি ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপার। বাস্তবে এরকম কিছু হয় না। তাহলে বাস্তবে আসলে কী হতে পারে?–কালীর জায়গায় দুর্গাকে কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য ওই কাহিনী ফাঁদা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন লক্ষ্মী-সরস্বতী নাকি দুর্গার মেয়ে।–এটাও ভুল ধারণা। বরং শাস্ত্রে বলা হয় লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গারই আর দুইটা অংশ। এসব দেখে মনে হয় দুর্গা জিনিসটা আর্যদের কাছে ‘স্পাই’ ব্যাপারটারই আর একটা প্রতিশব্দ। আর দুর্গার আক্ষরিক অর্থ হলো–যিনি দুর্গতি নাশ করেন, তিনিই দুর্গা। যখন এক বা একাধিক গণপতি আর্যদের দুর্গতির কারণ হয়েছিলেন, তখন ভ্রুকুটিতারা এবং/অথবা পর্ণশবরী আর্যদের উদ্ধার করেছিল–এই কারণে ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরীও দুর্গা। এরকম উদ্ধারকার্য আরো অনেক অপ্সরাও করেছেন। কিন্তু তাদের পক্ষে ‘দেবী’ হয়ে ওঠা হয় নি, কারণ তাদের শুধু রূপ ছিল, কিন্তু গুণ ছিল না। দুর্গার দুইটাই ছিল। আর কৌশলে অনার্যদের দেবী কালীর জায়গাটাও নিয়ে নিয়েছিল। ফলে যে কালী আগে থেকেই অনার্যদের কাছে দেবী, তাদের কাছে দুর্গার আর নতুন করে দেবী হওয়ার জন্য বেশি কিছু করতে হয় নি। ওদিকে আর্যরাও অনার্য কালীকে দুর্গা দেবী রূপে মেনে নেয়, কিন্তু দুর্গা পূজাটা সেভাবে তারা কোনোকালেই করে নি। পূজাটা অনার্যদের এই পূর্বাঞ্চলেই কালীর জায়গায় দুর্গা পেয়ে আসতেছেন।
৫) ফাইনালি, দুর্গা পূজায় বেশ্যাপাড়ার মাটি লাগার ব্যাপারটাও একটা বড় ইঙ্গিত হতে পারে। অনেকে এটাকে অনেক রকম ভাবে ব্যাখ্যা দেন, কিন্তু আমার কাছে এটা সার্বিকভাবে সেই অপ্সরাদের প্রতিই এক ধরনের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ বলে মনে হয়। আর একালের ‘স্পাই’দের সাথে নায়কদের যেমন কমবেশি বিছানার ‘সিন’ থাকে, তেমনি সেকালে অপ্সরাদের ওটাই তো প্রধান অস্ত্র ছিল। তাই ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরীরা যদি গণপতিদের ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিয়ে কাজ উদ্ধার করেন, তাহলে প্রথমে আসা প্রশ্নটার উত্তর দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছলে-কৌশলে বিছানাতেই যদি সব ফয়সালা করে ফেলা যায়, তাহলে আর বল প্রয়োগের দরকার কী! আর গণেশকে দুর্গার ছেলে বানিয়ে দেয়াটা অনেক পরের দিকের পুরাণ রচনাকালী কবি-সাহিত্যিকদের হৃদয়ের মাতৃভাবের প্রভাব। আর এ নিয়েও একেক পুরাণে একেক রকম কবিকল্পনা! বিশ্বাস করা শক্ত।
(ছবিটি অনলাইন থেকে সংগৃহীত)
[পাল্লার সাথে বসে পোস্টটি লিখতে সাহায্য করেছে বিশু কর্মকার]
Leave a Reply