আগেকার দিনে ইউরোপীয়রা মনে করতো যে, পৃথিবী এই বিশ্বজগতের কেন্দ্রে একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে, আর সূর্যসহ অন্য সব গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। এই মতবাদকে বলা হতো থিওরী অফ জিওসেন্ট্রিজম। এই মতবাদে বিশ্বাস করতেন টলেমী খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এবং তার পরবর্তীতে এই মতবাদ টিকে ছিল ১৬০০ শতাব্দী পর্যন্ত। যতদিন না কোপারনিকাস বললেন যে, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। আর পরবর্তীতে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউহান্নেস কেপলাম, তিনি তার বই এস্টোনবিয়া নবিয়াতে লিখেছেন যে, এই সৌরজগতে পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহ শুধু সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে না, তারা নিজ অক্ষের চারপাশেও প্রদক্ষিণ করে।
আমি যখন স্কুলে ছিলাম, তখন পড়েছিলাম যে, পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহ নিজ অক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। তখন আমি পড়েছিলাম যে, সূর্য স্থির থাকে, সূর্য তার নিজ অক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে না। কিন্তু পবিত্র কুরআনে সুরা আল আম্বিয়ার ৩৩ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা আছে, “হুয়াল্লাজি খালাকা লাইলা ওয়া নাহারা”; “আর আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করিয়াছেন রাত্রি এবং দিবস”, “ওয়া সামসু ওয়া কামার”; “আর সূর্য এবং চন্দ্র”, “কুল্লুনফি ফালাকী ইয়াজবাহুন”, “প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করিতেছে তাহাদের নিজস্ব গতিতে।” এখানে আরবি শব্দটি ‘ইয়াজবাহুন’, এটা এসেছে মূল শব্দ সাবাহা থেকে; যেটা দিয়ে চলন্ত কোনোকিছুর গতিকে বোঝানো হয়।
যদি আমি বলি, একজন মানুষ মাটির ওপরে সাবাহা করছে, তার মানে এই নয় যে, সে মাটিতে গড়াগড়ি করছে। এর অর্থ সে হাটছে অথবা দৌড়াচ্ছে। যদি আমি বলি, একজন মানুষ পানিতে সাবাহা করছে; তার মানে এই নয় যে, সে ভেসে আছে। এটার অর্থ – সে সাঁতার কাটছে। একইভাবে পবিত্র কুরআনে যখন বলা হচ্ছে ‘ইয়াজবাহুন’ যার মূল শব্দ ‘সাবাহা’, গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে তখন সেটা উড়ে যাওয়া বোঝায় না, নিজ অক্ষের চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বোঝায়।
আর এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যের ইমেজ ঘরে বসেই পরীক্ষা করা যায়। দেখা যাবে বেশ কিছু কালো রঙের বিন্দু আছে। আর এই কালো বিন্দুগুলো আনুমানিক ২৫ দিনের মধ্যে একবার নিজ অক্ষকে প্রদক্ষিন করবে। যার অর্থ – সূর্য আনুমানিক ২৫ দিনের মধ্যে নিজ অক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। একবার চিন্তা করুন, পবিত্র কুরআন সূর্যের গতি আর নিজের অক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণের কথা বলেছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে, যেটা বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে কিছু দিন আগে!
পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াসিনের ৪০ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা আছে যে, “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর দিবসকে অতিক্রম করা।” “কুল্লুনফি ফালাকী ইয়াজবাহুন”, “এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে তাহাদের নিজস্ব গতিতে।” পবিত্র কুরআনে এই কথাটা দিয়ে কি বোঝানো হয়েছে যে, “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া”? আগেকার দিনের মানুষ মনে করতো যে, সূর্য আর চাঁদের কক্ষপথ একটাই। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলছে, না, সূর্য আর চাঁদের কক্ষপথ দুটোই আলাদা। তাই একটার পক্ষে আরেকটার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। আর এরা দুটোই সূর্য এবং চাঁদ, গতিশীল আর নিজ অক্ষকে প্রদক্ষিণ করে।
পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াসিনের ৩৮ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা আছে, “ওয়া সামসু তাজি লিমুসতাকারিল্লাহা” যে, সূর্য ভ্রমণ করে ওহার নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এখানে আরবি শব্দ মুসতাকার অর্থ একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য, অথবা একটা নির্দিষ্ট সময়। আজকের দিনে বিজ্ঞান জানতে পেরেছে যে, সূর্য এই সৌরজগতকে নিয়ে বিশ্বজগতের দিকে একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যে পয়েন্টাকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন সোলার এপেক্স। এই পয়েন্টের দিকে সূর্য যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ১২ মাইল গতিতে। আর এভাবেই সূর্য যে-পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছে, সেটার নাম কন্সোলেশন অফ হারকিউলিস। এই একই কথা বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনের সূরা রাদের ০২ নাম্বার আয়াতে। আর এছাড়াও সূরা ফাতির ১৩ নাম্বার আয়াতে। সূরা লোকমানের ২৯ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা আছে। আর এছাড়াও সূরা আল জুমার ০৫ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা আছে যে, “সূর্য এবং চন্দ্র ওহারা প্রত্যেকে পরিভ্রমন করে এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত।”
Leave a Reply