লিখেছেন: প্রখর শৈশব
ব্যঙ্গচিত্রের স্বাধীনতায় আমি আস্থা পোষণ করি অনেক আগে থেকেই । আমার ব্যঙ্গচিত্র দেখার, বুঝার চেষ্টার অভিজ্ঞতা দেশীয় টুকটাক ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো । আর এনিমেটেড ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যে বাচ্চাদের গুলোই দেখা হয়েছে, এবং দেখা হয় ।
ব্যঙ্গচিত্র অসাধারণ জিনিস । এটা শুধু মেধাবী নির্মানশিল্পই নয়, নয় শুধু সৃজনশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাস; এটার উদ্দেশ্য নয় কেবল আনন্দ-বিনোদনঃ বরং ব্যঙ্গচিত্র বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, একাডেমী- মহাএকাডেমীর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার ভেতর দিয়ে উদ্ভাসিত হয় মানুষের বিকাশ ও অগ্রতির ফলে অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষার শ্লেষাত্মকরূপ । আবার এই শ্লেষাত্মক, উপহাসমূলক শিল্পকলা ত্বরান্বিত করতে থাকে ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের বোধশক্তির উৎকর্ষতা । ব্যঙ্গচিত্র জন্ম দেয় সহলশীলতা-সহিষ্ণুতা, সমালোচনা, জবাবদিহিতা, আত্মবিশ্লেষণ ও উন্নোয়ন, গনতান্ত্রিক মনোভাব এবং বাকস্বাধীনতা, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর, উন্নত, দুর্নীতি এবং চৌর্যবৃত্তিমুক্ত, ন্যায়বিচার ও নায্যতার সুস্থিত ও নিরাপদ এবং বসবাসযোগ্য সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণের মূল উপাদান । এ ধরনের শিল্পকলার ভেতর দিয়ে গেলে যে বিদ্রুপাত্মক এবং শ্লেষাত্নক রস, আনন্দ, হাসি চলে আসে, তা আসলে অনুধাবন ও উপলব্দির বহিঃপ্রকাশ, জ্ঞান চর্চামূলক আনন্দের হাসি । হাসার স্বাধীনতা খুনের স্বাধীনতা চর্চার থেকে নিরাপদ এবং মানবিক। ব্যঙ্গচিত্র মোটা দাগে একই সাথে গনতান্ত্রিক মানসিকতা ও সহনশীলতা চর্চার সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে বিরোধী দলের ভূমিকার মত কাজ করে সমাজে এবং রাষ্ট্রে ।
ফরাসী ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, বলা যায় রম্য ম্যাগাজিন, শার্লি হেবদোর ব্যঙ্গচিত্র দেখা তো দূরের কথা, এর নামই জানতাম না । তবে ২০১৫ সালে মুসলমান ধার্মিকদের সহিংস প্রতিনিধিদের হাতে শার্লি হেব্দোর বারো জন শিল্পী-নির্মাতা ব্রাশফায়ারে খুন হওয়ার পর এই ম্যাগাজিনের ব্যঙ্গচিত্রগুলো দেখার ও বুঝার আগ্রহ তৈরী হয়, কিন্তু তবুও দেখা হয় নি এতোদিন ।
সম্প্রতি আরেকজন ইসলাম ধর্মানুভূতির ভাইরাসে আক্রান্ত বিকৃত কিশোর ফ্রান্সের আরেকজন স্কুলশিক্ষককে গলা কেটে খুন করার পর শার্লি হেব্দোর ব্যঙ্গচিত্রের প্রতি আরো দুর্ণিবার আকর্ষণ তৈরী হয় । ফরাসী বিপ্লবের ফসল এই ধরনের শিল্পকলা দেখতে ঢু মারি শার্লি হেবদোতে । অল্পকিছু সংখ্যক কার্টুন দেখার পর মনে হয়েছে ফরাসী হালারপুতেরা সত্যিই মারাত্মক জিনিয়াস, রসিক, এবং বিপ্লবী । শুধু এগুলো দেখলেই বুঝা যায় কোন স্তরের সহনশীলতা ও সংযমের শিক্ষালাভকরা ব্যক্তির সমষ্টিতে ফ্রান্সের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো নির্মিত হয়েছে । যারা এসব ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণ করে, তারা শুধু জিনিয়াসই নয়; তারা মানবিক, বন্ধুসুলভ, ভাতৃত্বপূর্ণ, সহনশীল, জ্ঞান ও প্রাজ্ঞতামুখী, জীবনবাদী, নায্যতাপরায়ন, উন্নয়নকামী- এমনটাই মনে হয়েছে আমার।
অন্যদিকে এই ম্যাগাজিনের ব্যঙ্গচিত্রগুলো দেখে নিজেকে, মানু্ষ হিসেবে কীটপতঙ্গের চেয়েও ক্ষুদ্র প্রাণি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না । মানুষ যে আসলে কত তুচ্ছ, আবার একইসাথে ঠিক একটা ছাগল হতে পারে তা চিত্রগুলোর দিকে তাকালে বোধগম্য হয়ে উঠে। বিশাল মহাবিশ্বের কোনো এক বিন্দুর চেয়েও ক্ষুদ্র স্থানে অবস্থিত সৌরজগতীয় সিস্টেমের মধ্যে পরমাণুর মত ক্ষুদ্র একটা গ্রহে, যাকে আমরা বলি পৃথিবী, সেই পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানে বসবাসরত অন্যান্য জীবের মত, ঠিক একটা টিকটিকি, কিংবা আরশোলা, কিংবা মাকড়শা, কিংবা নেকরে, অথবা শেয়াল কুকুর ঈগল ফড়িং সাপ বিচ্ছু জোনাকী মৌমাছি মশা ছাড়পোকা প্রভৃতির মত ইলেকট্রনের কোটি কোটি ভগ্নাংশের চেয়েও ক্ষুদ্র মানুষও একটা সাধারণ জীব, আলাদা বিশেষ কিছু নয়- এমন অনুধাবন তৈরী হয়; পৃথিবী কিংবা মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদান, জীব কিংবা জড় সবকিছুর প্রতি সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত অনুধাবন ও বাস্তব উপলব্ধীর বৈজ্ঞানিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ প্রকট হয়ে উঠে। যে ধরনের সেনসেশান প্রকাশ করতে, বুঝাতে লেখকরা ব্যায় করেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, কবিরা নির্মাণ করেন একটি বাক্য; ব্যঙ্গচিত্র তা এক পৃষ্ঠায় একটা চিত্রের মাধ্যমে উদ্ভাসিত করে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে নিয়ে, নিজেদের মানুষ প্রজাতিটি নিয়ে খুবই ভ্রান্ত এবং কৌতুককর সুপিরিয়রিটিতে ভুগা, নিজেদের মহাবিশ্বে বিজ্ঞানের ঊর্ধে আলাদা কিছু ভাবা, নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাত মনে করা যে কেউ এইরকম চরম সত্যকে চরম উপহাস এবং অপমান মনে করে বিপন্ন বোধ করবে, অসহায় হয়ে পড়বে, কেননা তাদের নিজেদের চেতনায় নিজের উচ্চতা এবং ওজনের, সুপিরিয়রিটির, আত্মসম্মানবোধের যে অমূলক বিশ্বাস ও ভ্রান্তি, তা নিজের সামনে যখন হাজির হয়, তখন একজন বিভাজন ও পৃথকীকরণের ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ধার্মিক নিজের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে; সে যে দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যার উপর, তার পা দুটো যে আসলে মিথ্যা, তার হাত আসলে অন্যায়, তার কান আসলে ভুল, তার চোখ যে আসলে প্রপঞ্চ আর তার মগজ যে ভ্রান্তি – তা মেনে নেয়া খুবই পীড়াদায়ক হয়ে উঠে তার জন্য । সে যে আসলে বাতিল, তার যে কিছুই নেই- সেই কষ্ট সহ্য করা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। এরকম অনুভূতিসম্পন্ন ক্ষতিকর আগেবী জীবনযাপিত লোকগুলো আসলে ব্যঙ্গচিত্র দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনায় ভুগতে শুরু করে। সে যে টিকে আছে মিথ্যার উপর, সে বসে থাকে ভুলের উপর, সে শুয়ে থাকে প্রতারণার উপর, তার যাপিত জীবন যে আসলে বিরাট এক কৌতুককর মিথ্যা এবং সে যে আসলে এক ক্রীতদাসী সত্ত্বা- এই চরম অপ্রিয় সত্য হজম করতে পারেনা সে এবং তারা।
ফরাসী বিপ্লবের ফলে যে ফরাসী প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে, সেই হারামজাদাগুলো সত্যিই একেকটা বজ্জাতের হাড্ডি, হাড়ে হাড়ে দুষ্টু ছাওয়ালপাওয়ালঃ তারা সুখ ও আনন্দের সূর্য, তারা উৎযাপিত জীবন।
Leave a Reply