লিখেছেন : সুমিত আচার্য্যী
মানুষ থেকে সমাজ, আচার থেকে শিক্ষা অব্দি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থে কোথায় হাত দেয়নি তা খুঁজে বের করা কঠিন হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণবৈষম্যের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য ও পদক্ষেপ মানুষ থেকে মানুষে যেমন দুরুত্ব বাড়িয়েছে, একইভাবে বর্ণবৈষম্যের অযুহাতে সমাজে বুনেছিল হিংসা ও স্বার্থের অজস্র চতুর জাল!
তারই এক চাক্ষুষ উদাহরণ কলকাতা সংস্কৃত কলেজ।
এই কলেজের বারান্দায় নিম্নবর্ণের শূদ্রদের কদম ফেলা তো দূর, কোনোরকমেরই প্রবেশাধিকার ছিলোনা। শিক্ষা অর্জনে গড়া সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গন ছিল শুধুমাত্র উঁচুবর্ণের ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের জন্য উন্মুক্ত! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার পর এই বৈষম্য ভাঙার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভর্তি করার কাজে হাত দেন৷ শুধুমাত্র নিম্নবর্ণের কায়স্থ ও শূদ্র হিন্দুদের ভর্তি করাই নয়, সাত বছর অধ্যক্ষ থাকাকালীন বিদ্যাসাগর সম্পন্ন করেন অনেক সংস্কারেরও। সেসময় বিভিন্ন তিথি সমূহ উপলক্ষ্য করে কলেজ বন্ধ দেয়া হত, বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কলেজ বন্ধ রাখার জন্য কাজ করেন ও তা অনুমোদনও হয়৷
ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের স্বার্থে গড়া সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজের অবস্থান পাশাপাশি হলেও দুই কলেজের মধ্যে ছিলো অদূরবর্তী পার্থক্য! সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা ছিল উঁচুবর্ণের পক্ষান্তরে হিন্দু কলেজে কোনো জাতিভেদ না থাকলেও বেশিরভাগ ছাত্র ছিল আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের৷ কোনো রকমের জাতপাত নির্ণয় করে হিন্দু কলেজে ভর্তি করা হতনা, যেমনটা করা হত সংস্কৃত কলেজে৷ এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, রক্ষণীল সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকরাও ছিলেন ঐ রক্ষণশীল। ওনারা হিন্দু কলেজকে যেমন শাস্ত্রসম্মত মনে করতেন না, একিভাবে সতিদাহ প্রথা বন্ধেরও বিরুদ্ধে ছিলেন! জাতপাতের উর্ধ্বে গিয়ে সকল শ্রেণীর ছাত্রদের শিক্ষা অর্জনে সুযোগ করে দেয়ায় কম সমালোচনাও শুনতে হয়নি এই মহান মানুষটিকে৷ রক্ষণশীল শিক্ষকদের একটা বড় অংশের অবস্থান ছিলো বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে৷ তবু তিনি সংকল্প থেকে সরে আসেননি!
শিক্ষার মান ও বিবিধ ব্যবস্থাপনায়, সংস্কৃত কলেজ হয়ত আজ হিন্দু কলেজেরও অনেক পরে, কিন্তু কালে কালে এই বর্ণ চর্চা আজও আমাদের মাঝ থেকে মুছে যায়নি। এখনো শুদ্রকে অমানুষ ও ব্রাহ্মণকেই মানুষ হিসেবে ধরে নেয়ার চল অধিকাংশ হিন্দুই ধরে রেখেছে। আমি নিজেই ব্রাহ্মণ কর্তৃক শুদ্রকে বর্ণের অযুহাতে যেভাবে অপমান হতে দেখেছি, এই অভিজ্ঞতা অনেক শুদ্রেরই আছে।
অনেকেই জানেন, তবু একটি ছোট্ট গল্প বলে শেষ করি।
কলকাতার জানবাজারের এককালের মানবদরদি জমিদার ছিলেন রাণী রাসমনি। তিনি দক্ষিণেশ্বর কালিমন্দির ও রামকৃষ্ণ পরহংসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবু শুদ্র পরিবারে জন্মেছেন বলেই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো হিন্দুর কাছেই প্রথমদিকে একটু জমি পাননি!
এরচেয়ে দুঃখজনক ও আশ্চর্যের আর কি হতে পারে!
Leave a Reply