লিখেছেন : আকাশ মালিক
দশম শ্রেণীর ছাত্রদের বয়স আর কতোই বা হবে? আমি তো তখন কিশোর ছিলাম। সেই বয়সে ন্যায় অন্যায় যাছাই করা, মানবিক অমানবিক কাজ বুঝার পরিপূর্ণ জ্ঞান উপলব্ধি হয় কি? আখের ফল বা পরিণতি Consequence না জেনে না বুঝে নিছক ফালতু মজা করা, অর্থহীন ফ্যান করার জন্যেও দল বেঁধে এমন কিছু কাজ করেছি যা এখন বুঝি অন্যায় ছিল। আমাদের দেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা কিশোর যুব সমাজকে আইন করে সেই ফ্যান করার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই কেউ তার চেয়ে অধিক সবল বা শক্তিশালী কাউকে নিয়ে ঢং ফ্যান করেনা, করে তার চেয়ে দূর্বলকে নিয়ে। যুবক কিশোরেরা এই ফ্যান করা দেখে দেখে বড় হচ্ছে। তা্রা দেখেছে এই দেশে শিক্ষককে কান ধরে উঠানামা করানো যায়, রসরাজ, টিটু রায়কে বিচার প্রমাণ ছাড়াই মারমিট করে জেলে ঢুকানো যায়, হিন্দুদেরকে গাই বলদের বাচ্চা বললে কেউ কিছু বলেনা, সরকারও চোখ কান বন্ধ করে নীরব সমর্থন দেয়।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের মেদাকুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উজ্জল কুমার রায় কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে শিক্ষক উজ্জল কুমার রায়কে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে গ্রামবাসী। শিক্ষককে ৫৪ ধারায় বরিশাল আদালতে পাঠানো হয়েছে। দশম শ্রেণির ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে এসে খাদ্যে আমিষ নিয়ে পাঠদানের সময় গরু খাওয়া নিয়ে কটূক্তি করেন তিনি। শিক্ষক উজ্জল কুমার রায়ের কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি গো-মাংস খাওয়া নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু কোরআন, নবী ও ইসলাম সম্পর্কে কুরুচিপূর্ন খারাপ কোন কথা বলিনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
একটি পত্রিকা রিপোর্ট লিখেছে এভাবে; “ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার, সাকিব মোল্লা ও সৌরভ হাসান জানান, গত শনিবার দশম শ্রেণির ২য় ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে আসেন সহকারী শিক্ষক উজ্জল কুমার রায়। খাদ্যে আমিষ নিয়ে পাঠদানের সময় বলেন ‘ আলেম-ওলামা দ্বারা গরু কাটিয়া মাংস খাওয়া ভণ্ডামি। কচ্ছপ খাওয়া উত্তম, গরু খাওয়া হারাম। কোরআন সত্য নয়, কোরআনে যা আছে তা মিথ্যা। আলেম-ওলামারা যা বলে তা সত্য নয়। হুজুররা অপদার্থ। তাই খ্রীষ্টান এক ব্যক্তি কোরআন শরীফ বাংলায় অনুবাদ করেছে ”। পত্রিকার এই রিপোর্টটা আমাকে বড় সন্দিহান করে তোলে। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা কী ভাবতে পারে, কী করতে পারে এমন কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার অর্জন হয়েছিল, যখন আমি বেশ কয়েক বছর একটি ইয়োথ অর্গেনাইজেশনের সাথে কাজ করেছিলাম।
বিজ্ঞান ক্লাসে খাদ্যে আমিষ নিয়ে পাঠদানে গরু মহিষ শুকর মাংস ইত্যাদি আলোচনায় আসতেই পারে আসাই উচিৎ। শিক্ষক তার স্কুলের হিন্দু ( যদি কেউ থাকে) মুসলমান ছাত্রদেরকে কি মাংস খাওয়ার কুফল জানাবেন না? এটা তো বৈজ্ঞানিক ভাবেই প্রমাণীত যে, সব ধরনের মাংসই স্বাস্থ্যের জন্যে খারাপ, বিশেষ করে Red Meat আর Processed Meat প্রক্রিয়াজাত মাংস। মাংস মানুষের দেহে heart disease, diabetes আর cancer এর মতো মরণব্যাধির জন্ম দেয়। গরু নাম শুনেই কি ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে গেল? কীই বা বুঝে তারা ধর্মের, আর আসলেই স্যার কী বলেছিলেন তা জানার বা সত্য মিথ্যা প্রমাণের খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ আগেও এর প্রয়োজন হয় নি।
৫৪ ধারা কী? ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলন থামাতে ১৮৯৮ সালে ইংরেজরা সর্বপ্রথম এই আইন তৈরি করে। তারা ওই আইনের ৫৪ ধারা তৈরি করে লাখ লাখ মানুষকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে। পাকিস্তান আমলেও এ ধারা ব্যবহার করে বাঙালিদের গ্রেপ্তার করা হতো। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, `যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।` বলা বাহুল্য, শতবর্ষ আগে এই আইনের জন্ম হয়েছিল ঔপনিবেশিকতার স্বার্থসিদ্ধির প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশ সরকার কার স্বার্থে এই নির্দয় আইনটি এখনও টিকিয়ে রেখেছে?
শিক্ষক উজ্জল কুমার রায় যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন তার শাস্তি আদালত দিবে। আমি সরকারকে জিজ্ঞেস করতে চাই, তাকে যে গণধোলাই দেয়া হলো, তাকে শারিরিকভাবে নির্যাতন করা হলো এর বিচার কি হবে, নাকি এটি কোনো অন্যায়ই নয়? একজন শিক্ষক প্রাণের মায়ায় খালের জলে ঝাপ দিয়েও রক্ষা পান নি। হিন্দু ভাইদের কাছে প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, আপনারাও কি এ অন্যায় সমর্থন করেন, আপনাদের কি কিছুই বলার নেই কিছুই করার নেই?
Leave a Reply