লিখেছেন : চার্বাক কাজী
(১)
আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার কাঠামোটাই এমন যে, তা সমাজ-নির্দিষ্ট
কিছু ন্যারেটিভকে মানতে ও পালন করতে শেখায়, কিন্তু প্রশ্ন করতে মোটেই শেখায়
না।
অর্থাৎ, রাষ্ট্র চায়, আমরা প্রথাকে মেনে নেওয়ার মতন শিক্ষিত হই, কিন্তু প্রথাকে প্রশ্ন করবার মত শিক্ষার ছোঁয়া যেন না পাই।
ফলে ব্যক্তির ‘সাংস্কৃতিক চোখ’ বিকশিত হয় শুধুমাত্র জনপ্রিয় ধারণা পালনের রেওয়াজকে কেন্দ্র করে; নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষন ও যুক্তিযুক্ত অভিমতের যেখানে ঠাঁই নেই। সমস্যার সামগ্রিক চিত্রকে অনুধাবন অযোগ্য করে তোলাটাই যেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য।
সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যার অস্তিত্বকে স্বীকার করা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বিশেষ কৌশলে আমাদের মধ্যে সমস্যার বিদ্যমানতাকেই অস্বীকার করবার এক অনন্য সক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া হয়।
এমনই একটি সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তির ধর্মীয়-পরিচয়ের ধারনাটি, যেটি আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজে রয়ে গেছে অমীমাংসিত; যে ধারনাটি হতে পারতো অসাম্প্রদায়িকতায় মীমাংসিত, সেটিই আজ হয়ে উঠেছে অপরাজনীতির হাতিয়ার।
(২)
উপমহাদেশের রাজনীতিতে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারনাটিকে আমাদের রাজনীতিবিদরা কখনই সৎ ভাবে ব্যাখ্যা করেন নি।
রাষ্ট্র যে হতে পারে ধর্মনিঃস্পৃহ, সেটিকে অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ
বিপরীমুখী, সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক হতবুদ্ধিকর ধারণা দিয়ে রাষ্ট্র ও ধর্মের
পৃথকীকরণের গোটা ধারনাকেই তাঁরা করে তুলেছেন গোলমেলে ও নিজেদের মতই অসৎ।
ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মত সুকুমারবৃত্তির সামাজিক ধারণাগুলোও সমাজে স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত না হয়ে, হয়ে উঠেছে ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা ও প্রত্যয় নির্ভর।
সমাজে সম্প্রদায় থাকবেই।
সম্প্রদায়ভুক্তিও থাকবে।
থাকবে সকলের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়াও।
কিন্তু তাতে সাম্প্রদায়িকতার মতন ঘৃণা চর্চা থাকবেনা, সেটিকে নিশ্চিত করে
সুকুমারবৃত্তির চর্চা, যার প্রতি আমাদের আমাদের ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদ ও
অপরিশীলিত, দুর্নীতিবাজ সমাজপতিরা যথেষ্ট যত্নশীল নন।
ধর্মেও
আছি, জিরাফেও আছি এমন এক অবস্থা থেকে তাঁরা ব্যক্তির আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের
সমাধান করতে চেয়েছেন, জাতীয়তা বা জাতিসত্ত্বার দোহাই দিয়ে।
সমস্যাটিকে তাঁরা আরও ঘনীভূত করেছেন তাতে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে যুক্ত করে।
ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র-জাতীয়তাবাদের এই যূথবদ্ধ সম্মিলনে সঙ্কট আজ প্রান্তসীমায় পৌঁছেছে।
গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিস্তার দেখলেই এটা পরিষ্কার হয় যে, আত্মপরিচয়ের এই সঙ্কট আজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজ একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে; অচিরেই যা রাস্ট্রকেও আঘাত করবে।
(৩)
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দিল্লির সহিংসতাকেও কিছু
এলিট ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানী’ শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস নামে অভিহিত করবার
চেষ্টা করেই চলেছেন।
রেজিমচেঞ্জের পক্ষপাতী এই মানুষেরা নির্দ্বিধায় ভুলে যান, হিন্দুত্ববাদ নামের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয়-ফ্যাসিবাদী শক্তিটির উত্থান হয়েছে ভারতীয়দের আজন্ম লালিত ও সুপ্ত সাম্প্রদায়িক মানসকে আশ্রয় করে, সেটাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে।
একসময় বিলুপ্তপ্রায় হিন্দুত্ববাদীরা আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছে ভোটের জনাদেশের মাধ্যমে, প্রবল জনপ্রিয়তার রথে ভর করে।
তারা অপরিসীম ঔদ্ধত্যে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একে একে নষ্ট করেছে; যা ছিল সেক্যুলার ভারতের অনন্য অর্জন।
খুব সুবিধাজনকভাবে এঁরা ভুলে যান যে, ধর্মানুভুতি নামের যে অলীক ধারনাটিকে রাষ্ট্র প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, তার ছায়াতলে বেড়ে উঠেছে রাজনৈতিক ইসলাম নামের সাম্প্রদায়িক ও শক্তিশালী সহিংস শক্তিটি, যার লক্ষ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা।
এই দুইয়ের সহাবস্থান উৎসাহিত করেছে ঘৃণাচর্চাকে, ঘৃণার রাজনীতিকে। উভয় মৌলবাদের পুঁজিই হচ্ছে এই ঘৃণা।
সাম্প্রদায়িক যুদ্ধবাজরা কেন ঘৃণাকে জিইয়ে রাখে, ঘৃণার এই রাজনীতি কাদের বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণ করে, বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে যখন প্রয়োজন এই ব্যাখ্যা, তখন তাঁরা চলমান ব্যবস্থার বিশ্লেষণ না করে, বোল তুলেন পরিবর্তনের।
তাঁরা মূলত স্বার্থ সংরক্ষণ করেন ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ সমাজপতিদের।
গৌণ করে তোলেন শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিষয়টিকে, হারিয়ে যায় সাম্য ও শান্তির
মানবিক সম্পর্কটিকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় সেই প্রশ্নটুকু।
(৪)
বাংলাদেশ ভিন্ন কিছু নয়।
আমাদের নেতা ও বুদ্ধিজীবীরাও মোটেই এই প্রবণতার বাইরে নন; তাঁরা আমাদের
ইউটোপিয়া (utopia) শব্দটির সাথে পরিচিত হতে ও তার বিরোধীতায় ব্রতী করে
তুলতে যতটা আগ্রহী, ডিসটোপিয়া (dystopia) শব্দের সাথে পরিচিত করতে ঠিক
ততটাই অনাগ্রহী।
অথচ নেতৃত্বের স্বৈরাচারীতা, অমানবিক ব্যবস্থা ও বিপর্যস্ত পরিবেশ ইতিমধ্যেই একটি চলমান বাস্তবতা, যা ডিসটোপিয়াকে আর কল্পনার মধ্যে সীমিত রাখেনি।
রাষ্ট্রের অধিকারীরা এটাও পছন্দ করেন
না যে আমরা শিখি ও জানি যে, সাইকোপ্যাথ (psychopath) ও সোশিওপ্যাথ
(sociopath) শব্দগুলো আজ আর শুধুমাত্র মনোবিজ্ঞান/সমাজবিজ্ঞানের বইয়ের
পাতায় আটকে নেই; এই ভয়ানক চরিত্রগুলো বাস্তবিক অর্থেই আমাদের সমাজে
বিদ্যমান।
এরাই আমাদের চারপাশ নিয়ন্ত্রন করছে এবং দিন দিন, তাদেরই
পায়ে আমরাই নিজেদের ক্রীড়নক হিসেবে, খেলনা হিসেবে তুলে ধরছি। আমরা তাদের
অধিষ্ঠিত করছি আমাদের অর্থব্যবস্থা, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা সহ সকল
নেতৃত্বদানকারী ভুমিকায়।
এই সাইকোপ্যাথ ও সোশিওপ্যাথদের চরিত্রের গভীর অনুধাবন, প্রকৃত ব্যবচ্ছেদ ও প্রত্যক্ষ বিরোধিতা না করে গণমানুষের কল্যানে কোন আন্দোলন যে সফলতার মুখ দেখবেনা, সেটা বলাই বাহুল্য।
সেটা বরং হয়ে উঠবে ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া কৃষকের ধান পুলিশি উদ্যোগে কেটে দিয়ে দিনমজুরের আয়ের পথ বন্ধ করে দেওয়ার মত রসিক এক ‘কসমেটিক সমাধান’; জনতার ট্যাক্সের টাকা ব্যয়ের কথা নয় উহ্যই রাখলাম।
অথবা
সেটা হয়ে উঠবে দাঙ্গায় মারা যাওয়া নাগরিকদের সাথে সামান্য দেখা করবার সৌজন্যটুকুও না দেখিয়ে শুধুমাত্র সামান্য অর্থসাহায্য ঘোষণা করবার মত রাজনৈতিক কৌশল, যাতে আর যাই থাকুক, সহমর্মী বিবেক অনুপস্থিত।
Leave a Reply