লিখেছেন : চার্বাক কাজী
(১)
বার্ট্রান্ড রাসেল বলতেন, আধুনিক সমাজে জীবনকে অনুধাবনের দুটি পরিপ্রেক্ষিত আছে, তার একটি হল প্রাচীন ধারণা ও প্রাচীন সময়ের নিরিখে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ; আর অপরটি হল তুলনামুলকভাবে নবীনতর চিন্তা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ।
দুটো দৃষ্টিকোণের মধ্যে যে সংঘাত আছে, সেটাকেও তিনি এড়িয়ে যাননি। বরং বেশ স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবেই বিজ্ঞানের অনিবার্য জয়ের কথা ঘোষণা করেছেন।
আজ এই অর্ধশতক পরেও মানবিক বোধ, ধর্ম, বিজ্ঞান ও তার সামাজিক পরিক্রমা প্রসঙ্গে তিনি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
বিজ্ঞানের সরাসরি যোগ আছে মানুষের জীবনধারণে, কারন বিজ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের নিয়মকে বুঝবার ও সেই নিয়মকে মানবকল্যানে পরিচালিত করবার একটি সমন্বিত মানবিক প্রচেষ্টা।
সে লক্ষ্যে ভৌত বিশ্বের যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান।
একটি সমন্বিত মানবিক প্রচেষ্টা বলেই বিজ্ঞান দেশ, কাল, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা মতাদর্শের উর্ধে।
সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
বিজ্ঞানের প্রতিটি তত্ত্বই কোন একটি হাইপোথিসিসের ফলাফল।
আর একারনেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্রমাগত শুদ্ধতর করবার চেষ্টায় ব্রতী।
উত্তরোত্তর নির্ভরযোগ্য উপায় খুঁজে বের করাই এই পরিবর্তনশীলতার কারন; সেই সাথে আছে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ এবং নতুন নতুন হাইপোথিসিসের ফলাফল আবিস্কার।
প্রতিনিয়ত সুক্ষ হতে সুক্ষ্মতর প্রামান্যতার ভিত্তিতে পরিমার্জন, এমনকি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষন সাপেক্ষে পরিবর্তনও বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর একটি আবশ্যিক বিষয়; এবং সে কারনেই বিজ্ঞান জীবন্ত এবং বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই “পরম” বা “ধ্রুব” বা “স্থবির” নয়।
তার অর্থ এই যে বিজ্ঞান সর্বদাই এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, যা তথ্য ও পর্যবেক্ষণের সাপেক্ষে, ক্রমপরিবর্তনশীল, স্থবিরতা বিবর্জিত এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে চর্চা নির্ভর।
গবেষণালব্ধ ফলাফলের ক্রমাগত সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ব্যাখ্যা করা এবং সে প্রচেষ্টায় কখনই ইতি না টানাই বিজ্ঞানের সবচাইতে শক্তিশালী ও নান্দনিক দিক।
(২)
জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজের জন্য প্রয়োজন প্রগতি অভিমুখী নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা; কারন সমাজ থেমে থাকেনা, বিকশিত হয়। আর এই পরিবর্তনশীলতাকে প্রগতি অভিমুখী হতে সাহায্য করে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস দাবি করেনা; বিজ্ঞান দাবি করে বোধগম্যতা। বিজ্ঞান দাবি করে বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞান চর্চা।
বিজ্ঞানচর্চা আর বিজ্ঞানমনস্কতা সমার্থক নয়; যদিও উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বিজ্ঞানচর্চা হলো শুধুমাত্র প্রাযুক্তিক জ্ঞানের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিস্ট দক্ষতা অর্জন; পক্ষান্তরে বিজ্ঞানমনস্কতা হলো বুদ্ধিবৃত্তি ও বোধশক্তিতে সংস্কারমুক্ত ভাবে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বা সমালোচনামূলক চিন্তাধারায় দক্ষতা অর্জন। ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এর জন্য প্রয়োজন হয় সচেতনতার, যার চরিত্র স্বতঃপ্রণোদিত, সুশৃঙ্খল, স্বসংশোধনমূলক।
বিজ্ঞানের লক্ষ্য খুবই নির্দিষ্ট; আর তা হল প্রামাণ্যতার অনুসন্ধান, আর সেকারনেই তা মুলত কল্যাণকামী। বিজ্ঞানের কাজটাই হল নিয়মবদ্ধ প্রকৃতির নিয়মগুলোকে তথ্য আর উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা, এবং তার ভিত্তিতে মানুষের জীবন ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
সেটাকে অনেকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে দাবী করতেই পারেন, কিন্তু তার বেশি বিস্তৃত হওয়ার প্রয়োজন বিজ্ঞানের নেই।
(৩)
পক্ষান্তরে দাবী করা হয় যে, ধর্ম হচ্ছে অলৌকিকভাবে প্রাপ্ত একধরণের পূর্ণজ্ঞান, যা কোন ঐশী শক্তি অলৌকিকভাবে বিশেষ কিছু মানুষের কাছে প্রেরন করেছেন, এবং যার পালন বাধ্যতামুলক। এই ঐশীশক্তি ও তাঁর প্রেরিত পূর্ণজ্ঞান দাবী করে ব্যক্তির নিজস্ব সমর্পণ, যা গড়ে ওঠে বিশ্বাস, প্রেম, আস্থা, ভীতি, প্রাপ্তি-প্রত্যাশার মত মানবীয় আবেগের ভিত্তিতে, এবং যার সমন্বিত রূপ হল গোষ্ঠীবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সুনিদৃষ্ট এক জীবন দর্শন ও বিধিবদ্ধ সামাজিক জীবনাচরণ, এবং যার উদ্দেশ্য হল সেই ঐশী শক্তির সন্তুষ্টি অর্জন।
ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক শিক্ষাই হল প্রশ্ন ছাড়া মেনে নেওয়ার প্রণোদনা; ধর্মীয় গ্রন্থে যা কিছু লেখা আছে তার সবই গ্রহণ করতে হবে, মানতে হবে, এবং সেটা পৃথিবীর বাস্তব প্রেক্ষাপট ও মানব প্রগতির বিপরীতে হলেও। যুক্তির প্রয়োগ, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের কোন সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে, এই বিশ্বাস একটি স্থির (fixed), বদ্ধ (stagnant). জড় (passive) চিন্তা থেকে নির্ধারিত হয় বলে সেটি কোন ধরনের নতুন চিন্তার জন্য উপযোগী নয়, কেবল নতুন আবিস্কার বা মানবিক চিন্তার সাথে সমন্বয়বিধানের একধরনের শিথিল চেষ্টা করা ছাড়া।
এবং এই সীমাবদ্ধতার কারনেই ধর্ম বা ধর্মীয় দর্শন তাদের নিজ নিজ কালকে অতিক্রম করতে সক্ষম নয়। ফলে স্বভাবতই ধর্ম ও ধর্মীয় দর্শনের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজাটা অবান্তর। তাছাড়া বিজ্ঞানের গতিশীল চিন্তার মাপকাঠিতে স্থির ধর্মীয় মতাদর্শকে জরাজীর্ণ বলেই বোধ হবে বলে ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজার চেষ্টাটাই হাস্যকর।
(৪)
ক্রিয়াশীল একজন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবার জন্যে চিন্তার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তার ইতিবাচক চর্চা মানুষের সবচাইতে মহত্তম গুনের একটি; আর এই চিন্তাকে সুসংহত ভাবে ভাষায় ব্যক্ত করার বৈজ্ঞানিক ধারাটির নাম হচ্ছে যুক্তি। সে অর্থে বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তিপূর্ণ মানস গঠনের জন্য অন্যতম একটি হাতিয়ার। যুক্তিপূর্ণ মানস লালন ও ধারন সমাজকে প্রগতি অভিমুখী করবার সবচাইতে শাণিত মাধ্যম, কারন জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজের জন্য প্রয়োজন প্রগতি অভিমুখী নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা। সমাজ থেমে থাকেনা, বিকশিত হয়, আর এই পরিবর্তনশীলতাকে প্রগতি অভিমুখী হতে সাহায্য করে বিজ্ঞান।
এই পরিবর্তনশীলতার সম্যক অনুধাবন ও ধারাবাহিক চর্চাই হচ্ছে সচেতনতা, যা মানুষ ও সমাজকে করে তোলে মানবিক। অর্থাৎ, সচেতনতা মুলত জ্ঞানার্জন, অভিজ্ঞতা এবং অনুভবের মাধ্যমে বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অনুভুতির সচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক অনুধাবন ও মানবিক উপলব্ধি।
সহানুভুতি, সমানুভুতি, সহমর্মিতা ও সহৃদয়তার গুনগুলো মানবিক গুন; এবং এই গুনগুলোর সচেতন চর্চাই মানবতা। কাজেই মানবতা হচ্ছে সেই অর্জিত গুন, যেটা মানুষের মানবীয় সত্ত্বাকে উদার হতে, কল্যাণমূলক কার্যকলাপে স্বতঃপ্রণোদিত হতে, হিতৈষি হতে, দয়াশীল হতে, দানশীল হতে, সদাশয় হতে, বদান্যতা দেখাতে উদ্বুদ্ধ করে।
কোন সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে, বা গোষ্ঠী স্বার্থ থেকে এই গুন অর্জিত হয়না বলেই তুলনামুলক ভাবে কম সংখ্যক মানুষ মানবিক। কোন ধর্মই মানবতার কথা বলেনা, কারন ধর্মমাত্রই মানব সম্প্রদায়কে খণ্ডিত ভাবে দেখে; ধর্মগুলো শুধুমাত্র সেই ধর্মে বিশ্বাসীদের অধিকার সমর্থন করে, সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে এক দৃষ্টিতে দেখে না।
ধর্মগুলোর প্রতিরোধ সত্ত্বেও মানবিক চিন্তা আজ এগিয়েছে বলেই আজ আমরা সার্বজনীন আইনের প্রচলন দেখি, যদিও আমাদের আরও অনেক এগুতে হবে। এই এগুনোর পথে ধর্মই বৃহত্তম বাধা। মানবতার সাথে মানব ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হলেও মানবতার সীমা মানবকে ছাড়িয়ে বিশ্ব ও প্রকৃতিতে মিশে যায়।
Neil deGrasse Tyson এর ভাষায় we are all connected to each other biologically, to the earth chemically and to the rest of the universe atomically.
এই বোধ মানবতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।
(৫)
সুস্থ মানবিক চিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার কোন বিকল্প নেই, প্রগতির পক্ষে সঙ্গবদ্ধ হওয়ারও নেই কোন বিকল্প; আহমেদ শরীফের ভাষায় বলতে হয়, প্রীতিহীন হৃদয় ও নির্লক্ষ্য কর্ম দু-ই বন্ধ্যা ।
আপাত দৃষ্টিতে “ইগো-হীন” বিজ্ঞান তার নির্মোহ চরিত্রের কারণেই অংশত প্রীতিহীন, অংশত নির্লক্ষ্য; আর সে কারনেই কেবল বিজ্ঞানচর্চা নয়, সেই সাথে বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা আবশ্যিক, নয়তো তথাকথিত “technocratic বস্তবাদী সমাজ” আবার প্যাট্রিশিয়ান, প্লিবিয়ান, নোবিলিটেট, অপটিম্যাট, পপুলার ইত্যকার ভাগে বিভক্ত হয়ে উঠবে, আরে তখন থোড়-বড়ি-খাড়া হয়ে উঠবে খাড়া-বড়ি-থোড়।
একটি মানবিক সমাজ গঠনের পূর্বশর্তই হচ্ছে সে সমাজে অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, যার মৌলিক একটি পূর্বাভাস হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও ধর্মের অনুসারী মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের অভিমত, পরামর্শ, ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারা, ভিন্ন মতের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ ও সহনশীলতাই পরমতসহিষ্ণুতা।
মানবিক সমাজের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল তা সর্বজনীন; অর্থাৎ তা সর্বজনের জন্যই প্রযোজ্য; এককথায়, যা কোন বিধি, আচার, প্রথা, অভ্যাস, খাদ্য, পরিধান, বিশেষ নিষেধাজ্ঞা, ভৌগলিক পরিসীমার সাপেক্ষে বা লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য, জাতি বৈষম্য, বয়স বৈষম্যের ভিত্তিতে মানব গোষ্ঠীকে বিভেদ করেনা।
অর্থাৎ মানবিক একজন মানুষ এবং মানবিক একটি সমাজ একই সাথে অসাম্প্রদায়িকও।
কারন, কোন রকম শর্ত ছাড়াই সমাধিকার ও ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের রাষ্ট্রীয়, আইনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে পারা এবং সেই অধিকার নিশ্চিত করতে পারার যোগ্যতা হল অসাম্প্রদায়িকতা।
একটি সেক্যুলার সমাজই পারে অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা পুর্নভাবে সুনিশ্চিত করতে, কারন সেক্যুলারিজমের মৌলিক কথাটাই হলঃ
১। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্র আর ধর্মের ভুমিকা হবে সম্পূর্ণ পৃথক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মীয় বিধানের কোন প্রভাব থাকবেনা ,
২। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য থাকবে একই আইনি কাঠামো ও অধিকার।
সেক্যুলার সমাজে ধর্ম ব্রাত্য নয়, কিন্তু ব্যক্তির ধর্ম পালন একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয় এবং সেটা পালনে রাষ্ট্র কোন ভাবেই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেনা। একই ভাবে,কোন ধর্মীয় আচার বা নিয়ম রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেনা।
মোদ্দাকথা, রাষ্ট্রের চরিত্র হবে অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন।
শেকড়ে ফিরে যাওয়া এবং সেক্যুলার সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া মুক্তি অসম্ভব।
Leave a Reply