লিখেছেন : নওরীন আমিনা
“বান্ধবীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইলের অভিযোগে রাবি শিক্ষার্থীর ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর।”
_____ এপর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল। ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভ আর ভিক্টিমের প্রতি সিমপ্যাথির কমতি ছিল না। কিন্তু সমস্যাটা বাধলো ছাত্রীর স্বীকারোক্তি নিয়ে।
ভিক্টিমের দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে, “গত ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে রাবির ওই ছাত্রীকে মাহফুজুর তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং তার ৫ সহযোগীকে দিয়ে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ব্লাক- মেইল করতে থাকে।”
নিউজের নিচের কমেন্টস অনুসারে, ফলোয়িং পয়েন্টস আর নোটেড বাই আওয়ার সুইট রাবিয়ানস,
১. এত রাতে বন্ধুর ফ্লাটে! জাস্টফ্রেন্ড?
২. অনৈতিক কাজ করতে গিয়েছিল নিশ্চিত!
৩. সুতরাং, মেয়েটারই দোষ। মেয়েটা খারাপ।
স্যরি টু সে ব্রাদারস, “দিস ইজ কলড ভিক্টিম ব্লেইমিং! আন্ড ইউ পুওর পিপল ডোন্ট ইভেন নো দিস।”
ভিক্টিম ব্লেইমিং আসলে কি?
ভিক্টিমকে তার সাথে ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে দায়ী করার প্রবণতাই ভিক্টিম ব্লেইমিং। যৌন হয়রানী কিংবা ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের নজির উল্লেখযোগ্য।
এই প্রবণতার পিছনে কোন ধরণের মনস্তত্ত্ব দায়ী?
“প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের ধারণা” ভিকটিম-ব্লেইমিং এর পেছনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ। মানুষ স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীকে একটি সুন্দর ও ন্যায়সঙ্গত স্থান হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। অধিকাংশ মানুষের মনেই একটি ধারণা বিদ্যমান, তা হলো- এ জগতে যে যেমন কাজ করে, সে তেমন ফলই পায়।
যখন কেউ কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধের শিকার হন, তখন আপনি খুব সম্ভবত নিজের অজান্তেই সে ভিকটিমের উপর আপনার এই থিওরি খাটাতে যান। অর্থাৎ, আপনার মন ভাবতে চায়, “ভিকটিম নিশ্চয়ই কোনো পাপ বা খারাপ কাজ করেছিল, এটার ফল সে পাচ্ছে।”
আপনি হয়তো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, যারা দুর্নীতি করেন, তারা একসময় ধরা পড়েনই। আপনার পর্যবেক্ষণ হয়তো একটা নির্দিষ্ট পরিসরে সত্য, কিন্তু এ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ থেকে যদি আপনি গোটা মানব সমাজকে নিয়ে একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে ফেলেন, তাহলে সেটা ‘লজিক্যাল ফ্যালাসি’ হবে।
কিভাবে? একটু ভেবে দেখুন, সব অপরাধীই কি সাজা পায়? আবার, সব সৎ ব্যক্তিই কি জীবনে সুখ পান? সৎ কোনো ব্যক্তিকে চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে দেখননি আপনি? একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, আপনার চিন্তার কোনো ভিত্তি নেই, কিন্তু তবুও আপনি কেন এই চিন্তাটা করছেন?
প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তর হলো, আপনি নিজের স্বার্থেই এভাবে চিন্তা করছেন। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এটাই সত্য!
প্রতিটি মানুষই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায় নিজের নিরাপত্তার জন্য। আবার প্রত্যেকেই নিজেকে ‘ভালো এবং সঠিক’ মনে করেন। তাই যখন আপনার প্রতিবেশীর সাথে খারাপ কিছু ঘটে, তখন আপনার অবচেতন মন তার সাথে আপনার তুলনা করতে চায়।
কিন্তু এটা করতে গিয়ে সে যখন দেখে, আপনার প্রতিবেশীর সাথে আজ যা ঘটলো, তা কাল আপনার সাথেও ঘটতে পারে, তখন সে অনিরাপদ ও অস্বস্তি বোধ করে। এই অনিরাপত্তাবোধ ও অস্বস্তি কাটানোর জন্য আপনার মন তখন বিকল্প ব্যাখ্যা খোঁজে এবং নিজেকেই মিথ্যা আশ্বাস দেয়।
আপনার মন তখন আপনাকে বলে, “তোমার প্রতিবেশী নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কাজ করেছিল এবং সেটার ফল পেয়েছে। কিন্তু তুমি তো খারাপ নও, তাই তোমার সাথে কখনো এমন কিছু ঘটবে না”। আর এটা করতে গিয়ে হয়তো নিজের অজান্তেই আপনি ভিকটিম ব্লেইমিং করে থাকেন। এটা নিজেকে পরিতৃপ্ত রাখার একটি মানসিক অপপ্রয়াস মাত্র।
কেন ভিক্টিম ব্লেইমিং পরিহার করা উচিত?
আপনি যদি কখনো ভিকটিম-ব্লেইমিং এর শিকার কাউকে খুব কাছ থেকে দেখে থাকেন, তাহলে আপনি তাদের প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও যন্ত্রণাটা কাছ আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু আপনি যদি কখনো বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে ভেবে না থাকেন, তাহলে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কারণ ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের ফলে একটা মানুষ আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে। দিস ইজ নট আ সিলি ম্যাটার ম্যান!
এবার আসি ধর্ষণে। ধর্ষণের সংজ্ঞা কি?
একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে।
অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন- কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি) এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত।
সংজ্ঞামতে, কোন ‘পতিতা’ আই রিপিট ‘পতিতা’ যদি রাত বারোটায় রাস্তায় পতিতের (খদ্দের) জন্য অপেক্ষা করে, আর সেসময় কেউ তার সাথে জোরপূর্বক সঙ্গম করে, সেটি ধর্ষণ।
অথবা কোন স্ত্রীও যদি তাদের চরম মুহূর্তে এসে ‘না’ বলে, আই রিপিট ‘না’ বলে অর্থাৎ অসম্মতি জানায়, আর তার পার্টনার তাকে জোর করে সঙ্গম করায়, সেটা ধর্ষণ (ম্যারিটাল রেপ)।
কেনো ধর্ষণ জানেন? কারণ যে পরিস্থিতেই হোক, যার দ্বারাই হোক, ”নো মিনস নো”। জ্বী, যে স্লোগানটা আপনারা যৌন হয়রানীর মুভমেন্টে মুড়ি মুরকির মতো ব্যবহার করেন, আবার ভিক্টিম ব্লেইমিংও করেন, সেই স্লোগান মতে উপরের ঘটনা দুটোও “ধর্ষণ”!
এই দুটো ঘটনাকে যদি ধর্ষণ হিসেবে মানতে পারেন, আশা করি রাবি শিক্ষার্থীর ধর্ষণের শিকার হওয়া নিয়ে আর সমস্যা হবে না। নিজের মনকে সান্তনা দিতে কিংবা না বুঝে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও করবেন না। আপনার অজ্ঞতা আরেকজনের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। সম্ভব হলে ভিক্টিমকে মেন্টাল সাপোর্ট দিন, নয়তো মুখটা বন্ধ রাখুন দয়া কারে। ধন্যবাদ।
নিউজ: Rajshahi News 24. com
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।
Leave a Reply