লিখেছেন : আকাশ মালিক
কিশোরকালে শুনতাম মানুষ গান গাইতো ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ আর কেউ বলতেন ‘চেহারাই মানুষের মনের আয়না’। আসলেই কি তা’ই? ইংরেজিতে একটি কথা আছে A face is the index of mind আর এক সাধু বলেছিলেন, “The face is the mirror of the mind, and eyes without speaking confess the secrets of the heart.” (Saint Jerome church father & saint (374 AD – 419 AD) …
আমি এর কোনোটাই পুরোপুরি মানি না। বলেছি ‘পুরোপুরি মানি না ’ এর অর্থ কিছুটা মানি। তবে শুধু ওগুলো অবিশ্বাসই করিনা, এর সাথে আরো একটি কথা যোগ করতে চাই, আমি মনে করি একজন লেখকের লেখাও তার মনের আয়না নয়। কেউ কি কোনোদিন দেখতে পেয়েছিলেন (ভবতারিনী) মৃণালিনী দেবীর স্বামী ৬৪ বছর বয়সের রবি ঠাকুরের চোখের আয়নায় ৩৪ বছর বয়সের সুন্দরী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে? না, কল্পনা করেন নি, কিন্তু কবি গুরু ভিক্টোরিয়াকে (কবির দেয়া নাম বিজয়া) ‘বিজয়ার করকমলে’ উৎসর্গকৃত পত্রে সত্যিই লিখেছিলেন-
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে,তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদ-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান,শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥
রবি ঠাকুরের এই প্রেমকাহিনি শুনে প্রথমে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। এটি উল্লেখ করে আমি কবি গুরুর প্রেম ভালবাসাকে কোনো অর্থেই অসম্মান করছিনা বা কারো অসৎ মিথ্যে ছলনা, প্রতারণার প্রেমের সাথে মিলিয়ে দেখছিনা, শুধু বলতে চাইছি মানুষের চোখ, মানুষের চেহারা এমন কি লেখকের লেখাও তার মনের আয়না নয়। কারণ আমরা মানুষেরা অন্যের মন জানা তো দূরের কথা নিজের আপন মনটাকেই ভালভাবে জানিনা।
মানুষের মন নিয়ে অন্যদিন আলোচনা হবে, আপাতত নিচের লেখাটি পড়ে আপনাদের দেয়া মতামত জানতে পারলে তা আগামী লেখার জন্যে সহায়ক মাল-মসলা হিসেবে সঞ্চয়ের থলেতে জমা করে রাখবো। এই লেখকের কোনো বইয়ের একটি বাক্যও জীবনে কোনো দিন পড়িনি আর আপনারাও কেউ দিলেন না তার লেখা কোনো একটি গল্প পড়তে। তাই আজ নিজেই তার ফেইসবুক খুঁজে নিচের লেখাটি পড়ে নিলাম।
“
পঁয়ত্রিশের পর ধনাঢ্য বাঙালি নারীরা ভোগেন এক অদ্ভুত অবসাদে। সদ্য-বিগত
জমকালো যৌবন আর মাত্রই-হাতছাড়া জ্বলন্ত জৌলুশের নস্টালজিয়ায় তারা ভোগেন
হুলস্থুল হীনম্মন্যতায়। মাত্রই বছর পাঁচ-সাতেক আগে একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বা
ছিলেন সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা; তারও গোলাভরা ধান ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল,
ছিল উঠোনভরা গাছ। মাত্র অর্ধদশকের ব্যবধানে আচমকা প্রাচুর্যের প্রায় সবটা
হারিয়ে তিনি নাম লেখান সর্বহারার দলে। কিছুকাল আগেও তার পেছনে ছিল মৌয়ালদের
অপেক্ষমাণ তালিকা। তার উন্নাসিক উপেক্ষাকে উপেক্ষা করেও যে মৌয়ালরা তার
এতটুকু কৃপার অপেক্ষায় থাকত, পঁয়ত্রিশে তিনি এসে চারিদিকে তাকিয়ে তিনি
দেখতে পান— কোথাও কেউ নেই! তিন দেখতে পান সেই সমবয়সী পূজারীরা সুপ্রতিষ্ঠিত
হয়ে এখন সংসারধর্মে লিপ্ত আছে ‘কচি’ স্ত্রী নিয়ে, যে স্ত্রীর বয়স ঐ
পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটির বয়সের অর্ধেকের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। এই ঈর্ষার
ইন্ধনে জ্বলেপুড়ে খাক হন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বা।
একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার
সাধারণত দুই বা ততোধিক সন্তান থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে জ্যেষ্ঠ সন্তানটির বয়স
হয়ে থাকে পনেরো বা এর বেশি। জ্যেষ্ঠ সন্তানটি কন্যা হলে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব
মায়ের সাথে কন্যাটির বয়সের ব্যবধান দাঁড়ায় মাত্র কুড়ি। পরিচিত প্রতিবেশে
পঞ্চদশী কন্যাটি যখন পূজারী পুরুষদের প্রাত্যহিক পূজা পায়, তখন
পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার মনে পড়ে— কুড়ি বছর, মাত্র কুড়ি বছর আগে এমন পুজো আমাকেও
করা হতো! চোখের সামনে আত্মজাকে এমন পুজো পেতে দেখে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার সাধ
জাগে পুনর্বার সামান্য পুজো পেতে। পুজোপ্রাপ্তির এই পারমাণবিক বাসনা তাকে
করে তোলে স্বীয় কন্যার প্রতি ঈর্ষাকাতর!
পঁয়ত্রিশের পর দেহনদীতে
অনিবার্যভাবে ভাঙন ধরে, এককালের পাহাড়ি ঊর্ধাঞ্চল পরিণত হয় শাদামাটা সমতল
ভূমিতে, প্রসাধনীর প্রচ্ছদে ঢাকা পড়তে থাকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার প্রকৃত
প্যারাডক্স। ওদিকে তার ব্যবসাসফল পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বামীটিও বয়সের ভারে
উত্থানরহিত কিংবা পরনারীর পরাগায়ণে নিয়োজিত। অর্থ-অলঙ্কারের অঢেল যোগানে
পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার জীবন হয়ে ওঠে কফি হাউস গানের সুজাতার মতো। কিন্তু
পৃথিবীতে দুর্লভতম জিনিশ হচ্ছে সময়। সুজাতারা লাখপতি স্বামী, দামি
বাড়ি-গাড়ি পেলেও পান না স্বামীটির ‘সময়’। ঝি-চাকরেরা গৃহস্থ সব কাজ করে
দিয়ে যাওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার কোনো কাজ থাকে না, স্বামী
কর্তৃক সময়বঞ্চিত হয়ে মনে-মনে তিনি হয়ে ওঠেন বেসামাল বিদ্রোহী। স্বামীকে
কচি নারীতে আসক্ত দেখে তিনিও হয়ে ওঠেন কচি পুরুষান্বেষী। এমতাবস্থায় কলিং
বেলে একবার মৃদু চাপ পড়লেই মুহুর্মুহু খুলে বন্ধ হয়ে যায় তার দরোজা-জানালার
সিটকিনি-সমগ্র। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী তরুণকে প্রেমিক হিশেবে পাওয়ার
আকাঙ্ক্ষার অন্যতম কারণ হচ্ছে তরুণটির হাতে থাকে দেওয়ার মতো অঢেল সময়, যা
থাকে না স্বামী নামক টাকার মেশিনটির।
পঁয়ত্রিশোর্ধ্বারা প্রশংসার
কাঙাল। লক্ষ বাক্যের মহাকাব্য রচনা করেও এককালে যে অপ্সরার দৃষ্টি আকর্ষণ
করা যেত না, পঁয়ত্রিশ অতিক্রান্ত হবার পর তিনিই চাতকের মতো মুখিয়ে থাকেন এক
বাক্যের স্তুতি শোনার জন্যে। কেউ যদি একবার বলে ‘বয়সের চেয়ে আপনাকে দশ বছর
কম লাগছে’ বা ‘আপনাকে আপনার মেয়ের বোনের মতো লাগছে’ কিংবা কপট করে হলেও
কেউ যদি একবার শুধোয়, ‘আপনার বয়স বিশ, না বাইশ?’ তখনই তার মনের অঙ্গনে
সুখের ফাগুন আসে, কাঠির ঘষা ছাড়াই তার দেশলাইয়ে আগুন আসে; এই একটি প্রশ্নের
জন্যেই তার ইচ্ছে করে প্রশ্নকর্তাকে সবুজ পাসপোর্ট দিয়ে দিতে!
পঁয়ত্রিশোর্ধ্বাটি কৈশোরে-তারুণ্যে প্রেম করেছেন হয়তো দরিদ্র কারো সাথে; যে
তাকে দিনভর কবিতা শুনিয়েছে, রাতভর জোছনা খাইয়েছে। কবিত্ব না থাকলেও তাকে
তুষ্ট করতে ছেলেটি হয়তো অনিচ্ছায় কবিতাচর্চা করেছে, ছেলেটি ছিল তার একান্ত
বাধ্যগত ব্যক্তিগত কবি। পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতার কবলে পড়ে তার বিয়ে হয়
দেড়গুণ বয়সী টেকো কোনো হোঁতকা পেটুকের সাথে; যে পেটুক সওদাগরটি তাকে গা-ভরা
সোনা আর পেটভরা সন্তান ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। পেটুকটির সাথে
পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটি সুখী-সুখী সেলফি প্রচার করলেও তার ভেতরে রয়ে যায়
কবিতার কৈ মাছ, জোছনার জলরঙ, বৃষ্টির বীর্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব পতি প্রবরটি যখন
অর্থ উৎপাদনের প্রবল প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত; তখন পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার ইচ্ছে করে
কেউ তাকে নিয়ে কবিতা লিখুক, নিদেনপক্ষে তাকে কেউ কবিতা শোনাক। কিন্তু বছরে
একটি করে বাচ্চা দিতে পারলেও পতির সময় হয় না বছরে একটি কবিতা শোনাবার।
স্বামীরা বুফে না, সব চাহিদা এক স্বামী দিয়ে পূরণ হবে না; স্বামীরা সেট
মেনু, এক স্বামী দিয়ে পূরণ হবে দু-একটি চাহিদা। যে স্বামী কবিতা শোনাবে,
স্ত্রীকে তিনি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারবেন না; যে স্বামী অর্থনৈতিক
নিরাপত্তা দিতে পারবেন, তিনি কবিতা শোনাবেন না। এমতাবস্থায় এই কাব্যিক
শূন্যস্থান পূরণে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীটি নিজেই কবি হয়ে যান, অলঙ্কারবেষ্টিত
হয়ে কবিতাপাঠের আসরে যান, সখ্য জমান কোনো উঠতি পুং কবির সাথে। এর পরের অংশ
পঠিত বলে গণ্য হোক ”।
লেখক,আখতারুজ্জামান আজাদ।
১২ অক্টোবর ২০১৫ বই : লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া।
————————————————-
এই লেখকের আরো একটি লেখা পড়েছি যেখানে তিনি লিখেছেন, ছোটবেলায় একটি ছবি দেখতে সিনেমায় গিয়েছিলেন খুব আগ্রহ উৎসাহ নিয়ে কারণ তিনি পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলেন যে, ঐ ছবিতে সুন্দরী নায়িকার শরীরের একটি বিশেষ অঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেখানো হয়েছে। প্রত্যেক এপিসোডেই সেই অত্যাশচার্য দৃশ্যটি দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্ষণ দৃশ্যেও তা দেখতে না পেয়ে বড় মনঃক্ষুন্ন হয়ে অথীব ব্যথিত মনে প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করেছিলেন।
Leave a Reply