লিখেছেন : তৌফিকুর ইসলাম পিয়াস
এই সময়ের খুবই জনপ্রিয় একজন ওয়াজেন মিজানুর রহমান আযহারী; তার অনেক বক্তব্য ফেসবুকে শেয়ার করতে দেখি প্রায়ই। আমি আজ তার বহুল প্রচারিত একটা ওয়াজ শুনলাম মিনিট দশেক সময় নিয়ে।
তিনি বললেন, “চাঁদে মানুষ পাঠানোর আগে নাসার বিজ্ঞানীরা আগে কুকুর পাঠিয়েছিল, যার নাম লাইকা। কারণ মরলে আগে কুকুর মরুক। চাঁদে গিয়ে নীল আর্ল্মস্ট্রং লক্ষ্য করে দেখলেন চাঁদের এই মাথা থেকে ঐ মাথার মাঝখানটাতে ফাঁটা। খাবার ছিল না, চকলেট খেয়ে একটু পরেই চাঁদের মধ্যে সে চমৎকার একটা মিউজিক শুনতে পেলো। পৃথিবীতে ফিরে কোথাও সে এই মিউজিক আর খুঁজে পায় না। পরে আমেরিকায় একটা প্রেয়ার হলের পাশ দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ দেখে মসজিদের ভেতর থেকে ঐ মিউজিকটা বাজছে যেটা সে চাঁদে শুনেছে। মসজিদে ঢুকে দেখে একটা লোক কানের মধ্যে দুই হাত দিয়ে এই মিউজিকটা বাজায়। আসলে এটা মিউজিক না আজান। চিল্লায়া বলেন আজান।”
শুনেছি এই ভদ্রলোক নাকি মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। আর তাই নামের শেষে আযহারী লিখেন। এরশাদ সাহেব হজ করে ফিরে এসে যেমনটা নামের আগে আলহাজ লিখতেন ঠিক তেমনটাই। তবে, তিনি আলহাজ এবং আযহারী দু’টোই লিখেছেন। ভদ্রলোকের চেহারাও এরশাদের মতোই সুন্দর; বাড়তি হিসাবে কন্ঠটাও তার অসাধারণ সুন্দর, প্রশংসাযোগ্য।
এই সময়ের অতি জনপ্রিয় ওয়াজেন মিজানুর রহমান আযহারী তার উপরোক্ত বক্তব্যের ৩টি বাক্যে সরাসরি ৩টি মিথ্যা কথা বলেছেন। আমি বলবো না বা বিশ্বাস করি না যে তিনি তার অজ্ঞতা থেকে বলেছেন। কারণ তিনি কথায় কথায় খুব সুন্দর ইংলিশ উচ্চারণ করেন। নিশ্চয়ই তিনি ভালো ইংরেজী জানেন। নিশ্চয় অনেক পড়াশোনাও করেন। সুতরাং আমি মানতে নারাজ যে তিনি ‘অজ্ঞতা’ থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওয়াজ করেন।
আদতে তিনি জনপ্রিয় হবার জন্য সস্তা বক্তব্য দিয়ে মানুষের প্রিয়পাত্র হবার চেষ্টা করেছেন। আর এই বাংলাদেশের যেহেতু অধিকাংশ মানুষই জিপিএ-পাইপ সেহেতু তিনি জনপ্রিয় হবার সবচে সহজ রাস্তাটিই বেছে নিয়েছেন।
প্রথমত, লাইকা নামের মস্কোর রাস্তা থেকে ধরে নেয়া একটা নেড়ী কুকুর মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল রসকসমস নামের সোভিয়েট মহাকাশ সংস্থা। নাসার সংগে যার কোন সম্পর্কই নেই বা ছিল না।
দ্বিতীয়ত বললেন, ‘নীল আর্ল্মস্ট্রং লক্ষ্য করে দেখলেন চাঁদের এই মাথা থেকে ঐ মাথার মাঝখানটাতে ফাঁটা’ যা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য। চাঁদ কি একটা ফুটবল যে হাত দিয়ে ধরে তিনি দেখলেন তার এমাথা থেকে ওমাথা ফাটা! আমি দ্যর্থহীনভাবে জানাতে চাই এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা এবং মিজানুর রহমান আজহারীর মনগড়া গল্প। কারণ নীল আর্ল্মষ্টং চাঁদের ফাঁটা নিয়ে কখনও কোন কিছু বলেননি, তাছাড়া সেটা তার জানারও কথা না। এমনকি নাসা বা অন্য কোন মহাকাশ বা চাঁদ নিয়ে গবেষনা সংস্থাও এযাবতকালে চাঁদে কোন ফাটল খুঁজে পাননি। আমি তাই বলে মুহাম্মদ (সা) এর চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করাকে অসত্য বলছি না। আমি বলছি সেটা সম্পুর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছিল এবং পরে তা মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটার কোন বাস্তব প্রমাণ আজ অবধি বিজ্ঞান খুঁজে পায়নি। আমিও বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ঠ পড়াশোনা করেছি- কোন সায়েন্স জার্নালে আমি এর সত্যতার প্রমাণ পাইনি। আযহারী নির্লজ্জভাবে মিথ্যা কথা বলেছেন।
তৃতীয়ত, সেই একই নীল আর্ল্মষ্টং নাকি চাঁদে আজান (মিউজিক) শুনেছেন! আশ্চর্য! একজন মানুষ যিনি একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছেন বলে দাবী করেন- তিনি কিভাবে এরকম মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আজ পর্যন্ত যে সমস্ত অতি ক্ষীন ‘আওয়াজ’ (মহাজাগতিক শব্দ) মহাশূন্যে পাওয়া গেছে সেটা চাইলেই আপনি ইউটিউবে বা নাসার সাইটে গিয়ে শুনতে পাবেন- সেখানে আজান বা মিউজিক কোথায় পেলেন এই মিথ্যুক আযহারীরা? নীল আর্ল্মষ্টং এর অনেকগুলি ইন্টারভিউ আমি দেখেছি, তাকে নিয়ে অনেক পড়েছি কিন্তু এইসব আজগুবি বা গাজাখুড়ি গল্প কোথ্থাও খুঁজে পাইনি।
ইসলাম মিথ্যাকে ঘৃণা করে। ইসলামের আবির্ভাবই হয়েছিল মিথ্যাকে দূর করতে। আর বাংলাদেশী এসব ওয়াজেনরা মিথ্যার পসরা নিয়ে বসেছেন। শুধুই ঘৃণা হয় এসব তথাকথিত ইসলামী ব্যক্তিত্বদের কর্মকান্ড দেখলে। ওয়াজ নিয়ে আরও অনেক কথা শেয়ার হচ্ছে সোসাল মিডিয়াতে; বেশ কয়েকজন নামকরা মাওলানা ও ওয়াজেনের অনেক ভাড়ামীও দেখলাম।
তারেক মনোয়ার নামে একজনকে বলতে শুনলাম- আইফোনের মালিক ‘বেল গ্রেড’ এর সংগে নাকি তার দেখা হয়েছে, বেল গ্রেড দেখতে টিকটিকির মতো! সিরিয়া থেকে ধরে নিয়ে এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’কে! আরও বলেন, তিনি ইংল্যান্ডে যেয়ে ‘লীগে’ খেলেছেন; ১৯৯০ সালে। আবার একই সংগে ১৯৯০ সালে অক্সফোর্ডের ‘শ্রেষ্ঠ টিচার’ও ছিলেন তিনি, তাও ১বার ২বার না, ৩ তিনবার। এটা নাকি কেউ জানতো না, এমনকি তার পরিবারও জানতো না। আজকেই সে হঠাৎ করে প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও বলেন অক্সফোর্ডের সেলেবাসেই নাকি চলে ইংল্যান্ড-আমেরিকার স্কুল গুলি! ‘নাসা বলছে যে-কোন সময় সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে’!
মুফতি ইব্রাহিম নামে আরেকজন আইজ্যাক নিউটনকে ‘ইসাক নিউটন’ বানিয়ে তাকে অনেক বড় ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক বানিয়ে ছেড়েছেন অন্যজন আইনষ্টাইনকে ‘চোরা নকলবাজ’ আর কিসব বানিয়ে দিলেন।
আমরা বাংলাদেশীরা নিয়মিত ভারতীয়দের গোমুত্র নিয়ে ট্রল করি। মজা নিই। ভারতীয়দের জ্ঞান নিয়ে উপহাস করি। কিন্তু ভারতীয়রা যখন জানবে আমাদের কথিত প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিদের মিথ্যার বেসাতীপূর্ণ জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, তখন তারা কিভাবে ট্রল করবে- সেটা কি ভেবে দেখার সময় পেয়েছেন?
আমার তো মনে হচ্ছে ‘এসব হুজুর’ আর ভারতীয় ‘গরুর মুত্র’ একই সূত্রে গাঁথা।
মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে একশ্রেণীর লোক দ্বারা চাঁদে পাঠিয়ে ‘মহাকাশ জয়’ করে ফেলার ফলাফল বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার পেতে চায় নাকি?
যাই হোক, আযহারীরা যখন ওসব নাসা, চাঁদ, মিউজিক বা বেল গ্রেড, আইফোন, অক্সফোর্ড বা নিউটন-আইনষ্টাইন শব্দগুলি উচ্চারণ করে তখন উপস্থিত জনতা (হাজেরাইনে মজলিস) যেভাবে ‘সুবাহানাল্লা’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে জিকির শুরু করে দেয়- তখনই সবচে বেশী ভয় পাই; মিথ্যার শেষেও আজ ওসব পবিত্র শব্দমালা শুনতে হচ্ছে। কষ্ট হয়, কি দুর্দশা এই দেশটির!
Leave a Reply