লিখেছেন : এসকে মিজান
শরীয়ত বয়াতির বাচ্চাদের অপরাধটা কী?
ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজদের ক্রমাগত হুমকিতে ঘরের ভেতরেই বন্দী জীবন কাটাচ্ছে শরীয়ত বয়াতির পরিবার, জীবনের অনিশ্চয়তা প্রতি মূহুর্তে ঘিরে ধরছে তাদের সবাইকে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে শরীয়ত বয়াতির বাচ্চাদের।
নুন আনতে পান্তা ফুরানো একজন বাউল শিল্পী হঠাৎই চায়ের দোকানের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেলেন, পরিণত হলেন ‘তৌহিদি জনতার চোখে সবচেয়ে বড় খলনায়কে! অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশও তার নামে মামলা নিয়েছে, তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে এত মানবন্ধন হলো, সমাবেশ-প্রতিবাদ মিছিল হলো, মামলা করে শরীয়ত বয়াতীকে জেলে নেয়া হলো, এর মাঝখানে কেউ কিন্ত তার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে এগিয়ে এলেন না। ইসলামে গান কেন নিষিদ্ধ, আসলেই এটা নিয়ে কোরআন কী বলছে, সেসবের রেফারেন্স তুলে ধরতে দেখা গেল না কাউকে। যুক্তি দিয়ে কেউ দাবী করলেন না যে শরীয়ত বয়াতী ভুল বলেছেন, মিথ্যাচার করেছেন। একদল লোক শুধু এক সুরে হুক্কা হুয়া করে গেল, ধর্ম অবমাননা হয়েছে, ধর্মের অপমান হয়েছে! কীভাবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে- সেই ব্যাখ্যাটা কেউ দিলো না!
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, শরীয়ত বয়াতির মামলার বাদী যিনি, সেই মাওলানা ফরিদুল ইসলাম অনেক বছর ধরেই শরীয়ত বয়াতিকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন, বাড়িতে বাউল গানের আসর না বসানোর জন্যে। কার বাড়ির উঠোনে সে কী করবে, সেটা নিয়ে মাওলানা ফরিদের এত মাথাব্যাথা কেন কে জানে! এখন একটা সুযোগ পেয়েই শরীয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছেন তিনি, ইসলাম ধর্মকে বিশাল বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন! শরীয়ত বয়াতি জেলের বাইরে থাকলে তো ধর্মের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যেতো!
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, শরীয়ত বয়াতি বিশাল বড় অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। তাকে ফাঁসি দেয়া হবে, সেটাও মেনে নিলাম। সহরীয়ত বয়াতি খারাপ লোক, খুব খারাপ, কিন্ত তার সন্তানদের কী দোষ? তার পরিবারের অপরাধটা কী? তাদের জীবনকে কেন জাহান্নাম বানিয়ে ফেলা হচ্ছে? শরীয়ত বয়াতিকে জেলের ভাত খাইয়ে কি ধর্মান্ধদের আক্রোশ মেটেনি? তার পরিবারকে কেন অব্যহতভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে? তারা তো গান বাজনা হালাল না হারাম সেই বিষয়ে টু শব্দটাও উচ্চারণ করেনি!
এই দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা, যারা এই দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে মিলে বাঙালির ওপরে গণহত্যা চালিয়েছিল। তাদের অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, ফাঁসিও হয়ে গেছে। কই, তাদের পরিবারের সঙ্গে তো এই রাষ্ট্র বিমাতাসুলভ আচরণ করেনি, তাদের সন্তানদের রাস্তায় ধরে পিটুনি দেয়া হয়নি, মাঝরাতে তাদের বাড়িতে হামলা করা হয়নি। শরীয়ত বয়াতি কি যুদ্ধাপরাধীদের চেয়েও বড় অপরাধী হয়ে গেলেন?
ধর্ম অবমাননাই যদি শরিয়ত বয়াতির মূল অপরাধ হয়, তাহলে ওয়াজ-মাহফিলের নামে রাত বারোটার সময় গলার রগ ফুলিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে চিৎকার করতে থাকা ধর্মান্ধ কিছু মানুষের তো আরও আগে জেলের ভাত খাওয়া উচিত ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল জায়গা জুড়ে নিজের আশ্রম খুলে বসে মুরিদদের নিয়ে ধর্মের বারোটা বাজানো কিছু মানুষের রিমান্ডে যাওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। নিজের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, অন্য ধর্মকে আক্রমণ করে যারা আসর গরম করে, তাদের বিরুদ্ধে কেন কেউ মামলা করে না? নাকি এদেশে ধর্মানুভূতির একচ্ছত্র অধিপতি কেবল মুসলমানেরা? অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতি থাকতে নেই?
এসব দেখে প্রচণ্ড হতাশ লাগে। যে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, তার মেয়ের শাসনামলে বসেই সেই স্বপ্নটাকে জ্বলজ্যান্ত একটা কৌতুক বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে অন্তত ‘গান বাজনা হালাল’ বলার অপরাধে একজন বয়াতিকে জেলে যেতে হতো না, রিমান্ডে নেয়া হতো না তাকে, তার সন্তানেরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ঘরে বসে আতঙ্কের প্রহর কাটাতো না। রাষ্ট্রের অন্তত শক্ত হয়ে শরীয়ত বয়াতির পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, কিন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রও মেরুদণ্ডহীনতার প্রমাণ দিলো। বাংলাদেশের মানুষের মূল্যবোধ আর ধর্মীয় শিক্ষা যে ক্রমশই নিম্নমূখী, সেটারই প্রমাণ দিয়ে গেল এই ঘটনাটা…
এর একটা এস্পারওস্পার হওয়া দরকার, আমি স্থির করেছি ক’জন বন্ধু বান্ধব দু/চার এর মধ্যে বয়াতির বাড়িতে যাবো। তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করবো, তাতে পরিবারটা একটু হলেও শান্তনা পাবে।। স্থানীয় তরুনদের সাথে রাখবো। সঙ্গপ্রিয় বন্ধুদের ইনবক্স প্রত্যাশা করছি।
Leave a Reply