দেবী সরস্বতী নিয়ে আমার ভাবনা
লিখছেন : আকশ মালিক
উৎসর্গ – Pushpita Anandita
এই লেখাটি একটি নয় দশ বছরের শিশু বা কিশোরের মনের আকুতি অনুভুতি কল্পনা বিশ্বাস বলে ধরে নিলেই ভাল হয়। প্রায় একান্ন/বায়ান্ন বছর আগের কথা। আমাদের গ্রাম থেকে এক মাইল দূরে একটি গ্রামে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার বাস করতেন। আমার বাবার সব চেয়ে প্রীয় একজন বন্ধু ছিলেন সেই গ্রামের ডাক্তার সত্যেন চক্রবর্তী। ঠিক ডাক্তার নয় গরীবের বন্ধু, নিরুপায়ের সহায় বলা যায়। আমরা তাকে সত্যেন কাকা ডাকতাম। রোগীদের কাছ থেকে টাকা পয়সা তেমন নিতেন না। সেই সময়ে অনেকের টাকা দেয়ার মতো তেমন সম্বলও ছিলনা। কেউ লাউ কুমড়া, কেউ হাঁস মুরগি আর কেউ ডাল চালও দিতেন। পরিবারের কারো অসুখ বিসুখ হলে বাবার সাথে সত্যেন কাকার বাড়ি যেতাম। সত্যেন কাকার বাড়ি দেখার আগে আমি জানতামনা মুসলমানদের বাড়ির চেয়ে হিন্দুদের বাড়ি ঘর এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, বিশেষ করে উঠোন। প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির উঠোনের পাশে আর পুকুর পাড়ে ফুলের বাগান। আমাকে সব চেয়ে বেশি আকর্ষণ করতো সত্যেন কাকার বাড়ির উঠোনের পাশে সারি বাঁধা রক্তজবা ফুলের গাছ। কাকাকে অনুরুধ করে আমি প্রায়ই দু তিনটে রক্ত জবা ফুল বাড়ি নিয়ে আসতাম আর তা দিয়ে মালা বানিয়ে আমাদের নৌকার গলুইয়ে ঝুলিয়ে রাখতাম। একদিন কাকার বাড়ি ফুলের গাছের সামনে ঘুরাঘুরি করছি দেখে কাকার ছোট মেয়ে গৌরী এসে বললো, ফুল নিবে বুঝি, ফুল দিয়ে কি তুমি পুজো দাও? আমি বললাম, না নৌকার গলুইয়ে বেঁধে রাখি। সত্যকে অস্বীকার করায় কোনো মহত্ব নেই, স্বীকার করি গৌরীকে দেখলে আমার হৃদয় মাঝে এক বীণার সুর বেজে উঠতো, সেটা না জানতো গৌরী না বুঝতাম আমি, এরই নাম কি ভালবাসা। আরেক দিন গৌরী জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বরসতী পুজো হবে, তুমি আসবে আমাদের পাঠশালায়’? আমি বললাম, গান বাজনা হবে? সে মুখে উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। গৌরীদের পাঠশালায় জীবনে প্রথম দেখেছিলাম দেবী সরস্বতীর মূর্তি। আমি আসবো শুনে সত্যেন কাকা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পুজোয় কোন সময় বাণী অর্চনা, কোন সময় পুষ্পাঞ্জলি, কোন সময় প্রসাদ বিতরণ আর কোন সময় আরতি হবে। আমি আসলে এ সবের কিছুই বুঝি নাই।
খুব উৎসাহ নিয়ে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ অনুমান করে করে পাঠশালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একসাথে এতো নারী আমি জীবনেও দেখিনি। সমস্ত পাঠশালা ঘিরে প্যান্ডেল, নানা রঙ্গের কাগজে কাপড়ে সাজানো মঞ্চ, সামনে ফুলে ফলে সাজানো পুজো মন্ডপ। এতো মানুষের ভীড় আর পুজো মন্ডপ এর আগে কখনও দেখিনি। আমি একটু ভড়কে গেলাম। ভয়ে সংষয়ে ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছি আর ভাবছি যদি কোনো ভুল করে পাপকার্য করে ফেলি, আমি কি অভিশপ্ত হবো? কেউ কি আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিবে? এক সময় দেবী সরস্বতীর মূর্তির কাছাকাছি এসে দন্ডয়মান হলাম। পাশেই আমার সামনে একজন সাধু বা পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করছেন আর হাতের পাখা দিয়ে বাতাশ করে ধুপ বাতির ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছেন, বাম দিকে আগর বাতির মতো আরো কিছু জ্বলছিল। এই আড়ম্বর জাঁক জমকপূর্ণ বিশাল আয়োজন, এই পরিবেশ আমার সম্পূর্ণ অচেনা। পুরোহিতের ঠিক পেছনে দেবী সরস্বতীর মুখোমুখী হয়ে দাঁড়ালাম। কেউ দেবীর সামনে মাথা নত করে, কেউবা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন। আমি হাত জোড় করে, দেবীর চোখে চোখ রেখে নির্জীব কাষ্ঠের মতো অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি প্রার্থনার জন্যে নয়, অন্য কারণে। এই মুখাবয়ব, এই চেহারা, এই শাড়ি এই ঠোঁট নাক কান আর বিশেষ করে তার চোখের চাহনি ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার মনে হলো, কে যেন মায়ের ছবি দেখে দেখে এই মূর্তিটি তৈরি করে এখানে রেখেছেন। নাকি আমার মাকে কবর থেকে তুলে এনে এখানে বসিয়ে দিয়েছেন? আমি মা বলে ডাকলে তিনি এক্ষুণি আমার ডাকে সাড়া দিবেন? দুই সপ্তাহ আগে নানা বাড়ির পুকুর পাড়ে সাদা কাপড় পরিয়ে মাকে কবরের ভেতর শুইয়ে দেয়া হয়েছিল। কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন ‘বাবা তুমিও এক মুঠো মাটি কবরের ভেতরে আস্তে করে রেখে দাও’। গৌরীদের পাঠশালায় আমার সামনে উপস্থিত সাদা শাড়ি পরা দেবী সরস্বতী আর নানা বাড়ির পুকুর পাড়ে কবরে শায়ীত সাদা কাপড়ে ঢাকা আমার মা, আমি হিসেব মিলাতে পারিনা কী ভাবে কী হলো। নিবীড় মোহাবিষ্ট মোহাচ্ছন্ন হয়ে কতো সময় সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আজ আর মনে নেই। এই হিসেব মিলাতে মিলাতে কখন যে নীরবে একা একা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম তাও ঠিক করে বলতে পারবোনা। এর পরে প্রায়ই আমি সেই দৃশ্য ঘুমের মাঝে স্বপনে দেখতাম।
গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে এসে এক সময় যখন স্কুল জীবনে প্রবেশ করলাম, সেখানে আমার ক্লাসের সব চেয়ে নিকটতম বন্ধু ছিলো পরেশ আর নিতাই। নিতাই একদিন নিমন্ত্রণ করেছিল তাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজোয়। গৌরীদের পাঠশালায় সেদিন সত্যেন কাকার বলে দেয়া কিছুই করা হয়নি। না শুনেছি বাণী অর্চনা, না দিয়েছি পুষ্পাঞ্জলি, না দেখেছি প্রসাদ বিতরণ আর না জানিয়েছি আরতি। নিতাইকে বললাম, ‘আরে নিতাই, তুই আমাকে অঞ্জলি দেয়া শেখাবে, আমি যে অঞ্জলি দিতে জানিনা? আমি কোনো ফুল নিয়েও আসিনি’। সেদিন নিতাইদের বাড়িতে জীবনে প্রথ্ম দেবী সরস্বতীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলাম।
একদিন বলেছিলাম আমার একটি লেখায় যে, জীবনে ওস্তাদ শিক্ষক অনেক দেখেছি কিন্তু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভ্রত স্যারের সমতুল্য দ্বিতীয় আরেকজন পাইনি। আমার মতো মাদ্রাসা থেকে আসা একজন ছাত্রকে তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই ভালবাসতেন বলে মনে হয়েছে। নিজ উদ্যোগে অবসর সময়ে আমাকে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়াতেন আর এলজ্যাব্রা অংক শেখাতেন। স্কুলের বাৎসরিক উৎসবের দিন পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র এক ছোট ভাইকে নিয়ে কবি জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার নাট্যরূপ প্রদর্শন করেছিলাম। অভিনয়ের এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম সুভ্রত স্যার রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। অবশ্য আমিও পুরোপুরি কাঁদার ভঙ্গীতে কবিতা আবৃতি করেছিলাম। একদিন একেলা পেয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার ঐ দিন কবিতা শুনে কাঁদলেন কেন’? তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো তিনটি ছবি দেখায়ে বললেন- “ মাঝের ছবিটা দেবী সরস্বতীর, তার ডানে আমার স্ত্রী শুক্লা রাণী আর বামে আমার মেয়ে লক্ষী রাণী। বিয়ের দুই বছর পরে আমাকে এই ছোট্ট শিশুটি উপহার দিয়ে আমার স্ত্রী ইহজগত ত্যাগ করে পরলোকে চলে যান। দুই বৎসর বয়সে আমি আমার মাকেও হারিয়েছি ”। আমি হতবাক, বাকরুদ্ধ অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকি অনেক্ষণ তিনটি ছবির দিকে।
ইংল্যান্ড আসার আগে যতদিন দেশে ছিলাম, যতবার নানা বাড়ি গিয়ে মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়েছি ততবারই দেবী সরস্বতী আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন। আর এখন এতো বৎসর পরে এই বয়সেও যখনই সরস্বতীর ছবি অথবা মূর্তির দিকে তাকাই ততবারই আমার মায়ের চেহারা মায়ের প্রতিচ্ছবি আমার মনের মানসপটে ভেসে উঠে। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি বয়সকালে হারিয়ে গেলে বা মনের স্মৃতিকোটা থেকে মুছে গেলেও কিছু দৃশ্য বোধ হয় কখনই মুছে যায়না।
আমার এই স্মৃতিকথা আগে কোনোদিন কারো কাছে প্রকাশ করিনি। লেখাটি পড়ে কেউ
প্রশ্ন তুলতে পারেন আমার বর্তমান চিন্তা ভাবনা আর লেখালেখির সাথে এই লেখা
সাংঘর্ষিক কি না? বিশ্বাস আবেগ অনুভুতি আর ভালবাসার সার্বজনীন বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে কি না জানিনা, শুধু জানি এর কারণ ব্যাখ্যা করার জ্ঞান
বিদ্যে শক্তি সামর্থ আমার নেই। ধর্মের বাহিরে গিয়েও আমি বলতে পারি, জগতের
সকল শিশুর ইউনিভার্সিটি তো শুরুই হয় মায়ের কোল থেকে। দেবী সরস্বতীর মাঝে
আমার মতো মা হারা দুনিয়ার কোনো শিশু যদি তার মাকে খুঁজে পায় তাতে ক্ষতি কি?
Leave a Reply