ধর্মানুভূতি ব্যাপারটা কী আসলে? এর যথার্থ উত্তর হুমায়ুন আজাদ দিয়েছিলেন তাঁর ‘ধর্মানুভূতির উপকথা’ নামের নিবন্ধে। এতোদিন পরেও কী প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক তা এখনও! সেখান থেকে নির্বাচিত ১২ টি বাণী পোস্টার আকারে (নিচের ছোট ছোট ছবিতে ক্লিক করে দেখতে হবে) দেয়া হলো। প্রকাশ করা হলো তাঁর সেই পুরো নিবন্ধটিও।
কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানষের একটি অসাধারণ অনুভূতি, যার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি, স্বর্গচ্যুত মানুষেরা বাস করছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন, তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভূতি যে প্রতিমুহুর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভূতি আহত হবে না, ফুলের টােকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভূতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভূতি – এটা খুবই বেদনার কথা; এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান প্রাণী মহাবিশ্বে, শুধু এ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় রয়েছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে তার ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতরে বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত করে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে জেগে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে চিৎকার করে ওঠে এবং বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটা শিল্পানুভূতির মতো দুর্বল অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হ’লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।
আমার অজস্র অনুভূতি দিনরাত আহত হয়; পত্রপত্রিকায় গ্রন্থে গ্রন্থে নিকৃষ্ট উপন্যাসানুভূতি, রাজনীতিবিদদের অসততা ভণ্ডামোতে আহত হয় আমার রাজনীতিকানুভূতি, এবং আমার এমন অজস্র অনুভূতি নিরন্তর আহত রক্তাক্ত হয়, আমি ওগুলোর কোনো চিকিৎসা জানি না, ওগুলো নিয়ে আমি কোন জঙ্গলে কোন রাস্তায় চিৎকার করবো, তাও জানি না। রাষ্ট্র এগুলোকে অনাহত রাখার কোনো ব্যবস্থা করেনি, রাষ্ট্রর মনেই পড়েনি এগুলোর কথা।
আমার শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি রাজনীতিকানুভূতি কাব্যানুভূতি প্রভৃতি পাহারা দেয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু এখন রাষ্ট্র এক উদ্ভট দায়িত্ব নিয়েছে, মনে করছে ধর্মানুভূতি পাহারা দেয়া তার কাজ; তাই রাষ্ট্র দেখে চলছে কোথায় আহত হচ্ছে কার ধর্মানুভূতি।
ধর্ম কি যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ধার্মিকেরাই স্বীকার করেন যে যুক্তি দিয়ে ধর্ম চলে না, ধর্ম চলে যুক্তিরহিত অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে; ধর্মে কোনো প্রশ্ন নেই, নতুন কোনো উত্তর নেই; সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়ে গেছে পুরোনো বইগুলোতে, সব সত্যের আকর হচ্ছে ওই বইগুলো।
মানুষের শুধু একটি এলাকাই আছে, যেখানে যুক্তি চলে না; সেটি খুবই ভিন্ন রকম এলাকা, সেখানকার সব সত্য লাভ করা যায় অযুক্তি আর অন্ধবিশ্বাস দিয়ে। মানুষের এই অন্ধবিশ্বাসই অভিহিত হয়ে থাকে ধর্মানুভূতি নামে।
ধর্মানুভূতিতে যে আঘাত লেগেছে, তা যে আহত হয়েছে, তা বোঝার ও পরিমাপ করার কোনো উপায় নেই। অযৌক্তিক ব্যাপারকে যুক্তির সাহায্যে পরিমাপ করা যায় না। বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্র এখন যেভাবে চলছে, তাতে প্রতিটি ধার্মিকের ধর্মানুভূতি প্রতিমুহুর্তেই আহত হতে পারে, এবং হচ্ছে।
জ্ঞানের বিকাশের অর্থই হচ্ছে পুরোনো পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোকে আহত করা, শুধু আহত নয় সেগুলোকে সম্পূর্ণ বাতিল করা; কিন্তু রাষ্ট্রগুলো জ্ঞানের সুবিধাগুলো নিচ্ছে, কিন্তু পরিহার করছে তার চেতনাকে, এবং পোষণ ও পালন করে চলছে পৌরাণিক বিশ্বাস।
বাঙলাদেশ এখন একটি প্রবল ধার্মিক দেশ; প্রার্থনালয়ে দেশ ছেয়ে গেছে, চারপাশ উপচে পড়ছে ধার্মিকে, উদ্দাম নাচগানের মধ্যে টেলিভিশন ব্যস্ত থাকছে ধর্মপ্রচারে, নেতানেত্রীরা তীর্থযাত্রার পর তীর্থযাত্রা করছেন, দিকে দিকে চলছে ধর্মের অলৌকিক উদ্দীপনা; তাই বাঙলাদেশ ভরে ওঠার কথা সততায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাপক অসততা, অতুলনীয় দুর্নীতি, সীমাহীন ধর্ষণপীড়ন। ধর্ম ও সততা হওয়া উচিত ছিলো সমানুপাতিক; কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধর্ম, ও অসততা, দুর্নীতি, ধর্ষণপীড়ন হয়ে উঠেছে সমানুপাতিক। তাহলে ধর্মানুভূতি কী দিচ্ছে আমাদের শুধু একরাশ অযৌক্তিক বিশ্বাস ছাড়া?
রাষ্ট্রকে মুক্ত হওয়া দরকার পৌরাণিক আবেগ থেকে, কেননা পৌরাণিক আবেগ গত কয়েক সহস্রকে মানুষের কল্যাণ বিশেষ করে নি, ক্ষতিই করেছে বেশি; এবং আজো ক্ষতি করে চলছে।
Leave a Reply