বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানের ভূমিকায় ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন (৩০/৩/৬৪ইং) (১ম অংশ)–
“বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানে প্রাচীন গৌড় বা বরেন্দ্র এবং বঙ্গ বা বঙ্গাল দেশ লইয়া গঠিত। প্রাচীন বাংলা ভাষার আদিলেখক মৎস্যেন্দ্রনাথ চন্দ্রদ্বীপের (বাখরগঞ্জ জেলার) অধিবাসী ছিলেন। তিনি ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে নেপালের রাজা নরেন্দ্রদেবের সভায় উপস্থিত হন। মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য জালন্ধরি-পা, তাঁহার শিষ্য কাহ্নপা বা কানুপা সোমপুরী বিহারে (বর্তমান পাহাড়পুরে) থাকিয়া তাঁহার গ্রন্থ রচনা করেন (খ্রীষ্টীয় ৭০০ হইতে ৭৫০-এর মধ্যে)। মৎস্যেন্দ্রনাথের রচিত চারি চরণযুক্ত একটি শ্লোক ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’-এর টীকায় উদ্ধৃত হইয়াছে এবং কাহ্নপার রচিত তেরটি চর্যাপদ আশ্চর্যচর্যাচয়ে উদ্ধৃত হইয়াছে। পরলোকগত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক সম্পাদিত ‘বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’য় এই আশ্চর্যচর্যাচয় ছাপা হইয়াছে। খণ্ডিত পুস্তকে কাহ্নপার একটি পদ পাওয়া যায় নাই। চর্যাপদগুলির অধিকাংশ রচয়িতা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। সুতরাং আমরা বলিতে পারি যে বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি পূর্ব পাকিস্তানে।
“এই প্রদেশ বৌদ্ধ ধর্মের লীলাভূমি ছিল। ময়নামতি, মহাস্থান ও পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ তাহার পরিচয় বহন করিতেছে। বৌদ্ধ রাজগণ দেশী ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যদিও তাঁহারা সংস্কৃতের বিরোধী ছিলেন না। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ় দেশে প্রথমে শূর রাজবংশ এবং পরে সেন রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এইজন্য তাঁহারা দেশী ভাষাকে অবজ্ঞা করিতেন এবং সংস্কৃতের উৎসাহদাতা ছিলেন। এই কারণে রাঢ় বা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে প্রাচীনকালে বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব সম্ভব হয় নাই; কিন্তু প্রাচীন গৌড় এবং বঙ্গে বা বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম রাজত্বের পূর্বেই বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল। গৌড় হইতে গৌড়ী প্রাকৃত (দণ্ডী, কাব্যাদর্শ ১/৩৫) এবং গৌড় অপভ্রংশের (মার্কেণ্ডেয়, প্রাকৃতসর্বস্ব) নামকরণ হইয়াছিল। আমীর খুস্রও (১৩৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) দেশীয় ভাষাগুলির মধ্যে গৌড় ও বঙ্গালের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। রাজা রামমোহন রায়ের বাংলা ব্যাকরণের নাম ছিল গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ। প্রাকৃত পিঙ্গলের (১/৪) ‘এও জে’ বাক্যকে টীকাকার রবিকর বারেন্দ্রী ভাষা বলিয়াছেন। পুরা শ্লোকটি এই :
মাণিণি মাণহিঁ কাঁইঁ ফল এও জে চরণ পড়ু কন্ত।
সহজে ভুঅঁগম জই ণমই কিং করিএ মণি মন্ত।।
[অর্থাৎ মানিনি, মানে কি ফল? এই যে কান্ত চরণে পতিত। সহজে ভুজঙ্গম যদি নত হয়, মণিমন্ত্রে কি করে?]
“কতিপয় প্রাকৃত বৈয়াকরণ ঢক্কী অপভ্রংশের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। R. Pischel ঢক্কীকে পূর্ব বাঙ্গালার ঢক্ক নগর হইতে ব্যুৎপন্ন মনে করিয়াছিলেন (Grammatic der Prakit Sprachen, প্যারা ২৫)। ইহাতে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাচীন দেশী ভাষার নাম পাইয়াছি; কিন্তু কোনও স্থানে রাঢ়ী প্রাকৃতের বা রাঢ় অপভ্রংশের নাম আমরা পাই না। আধুনিক বাংলা নামও পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত প্রাচীন বঙ্গাল দেশের নাম হইতে ব্যুৎপন্ন। ‘বঙ্গাল’ শব্দটি রাজেন্দ্র চোলের একাদশ শতকের শিলালিপিতে ব্যবহৃত হইয়াছে। এই বংগাল দেশের রাজার নাম গোবিন্দচন্দ্র বলা হইয়াছে। ইনি চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন এবং নাথগীতিকার গোপীচাঁদ হইতে ভিন্ন।
বৌদ্ধ গানে ভুসুকুর পদে বঙ্গাল শব্দের প্রয়োগ আছে :
‘বাজ নাউ পাড়ি পঁউয়াখালে বাহিউ,
অদয় বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।
[অর্থাৎ বজ্রযান রূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। অদ্বয়রূপ বঙ্গাল দেশ লুট করিলাম।]
“বৌদ্ধ গানের রাগ-রাগিণীর মধ্যে গৌড় ও বঙ্গাল রাগের উল্লেখ আছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান প্রাচীনকালেও সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশ ছিল।
“সেন রাজাদের সময় হইতে বাংলা ভাষা অনাদৃত হইতে থাকে। মুসলমান রাজত্বের প্রথমে প্রায় দেড়শত বৎসর কাল দেশ যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য অশান্তিময় থাকায় কোনও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয় নাই। এই সময়ে বাংলা ভাষার প্রতি উচ্চ সমাজের মনোভাব পরলোকগত শ্রেদ্ধেয় ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন কর্তৃক উদ্ধৃত নিম্নের সংস্কৃত শ্লোক হইতে বুঝ যায় :
অষ্টদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।।
[অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ এবং রামের চরিত দেশী ভাষায় শ্রবণ করিলে মানব রৌরব নরকে যায়।]
“গৌড়ের সুলতানগণ রাজনৈতিক কারণে জণগনের ভাষা বাংলার পৃষ্ঠপোষক হইলেন। বঙ্গের কাব্য কুঞ্জের আদিপিক বড়ু চণ্ডীদাস সুলতান সিকান্দর শাহের (১৩৫৭-৮৯ খ্রীষ্টাব্দ) সভায় সমাদৃত ছিলেন। তাহার পুত্র গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৯৮৯-১৪০৯ খ্রীষ্টাব্দ) শাহ মুহম্মদ সগীরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সময় পীর নূর কুত্বে আলম ফারসী ও বাংলা মিশ্রিত গযল রচনা করেন। কৃত্তিবাস গৌড়ের জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-১৪৩১ খ্রীষ্টাব্দ) আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। পশ্চিম বঙ্গের কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণ বিজয় রচনা করিয়া (১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে) গৌড়ের সুলতান শমসুদ্দীন য়ুসুফ শাহ (১৪৭৮-৮২ খ্রীষ্টাব্দ) কর্তৃক গুণরাজখান খেতাব পান। আরও অনেক কবি গৌড়ের সুলতানগণের বিশেষতঃ হুসযন শাহ, নসরত শাহ ও ফীরোয শাহের সভায় সমাদর লাভ করেন। সুলতানগণের দেখাদেখি অনেক আমীর ওমরা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হন। এইরূপে গৌড়ের সুলতান ও প্রধাণগণ গৌড়ের বৌদ্ধ পালরাজগণের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখেন।
“সেন রাজাদের সময়ে রাজধানী নবদ্বীপ সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। নবদ্বীপ-নিবাসী শ্রীচৈতন্য দেবের প্রভাবে তাহা বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র হইয়া উঠে। ষোড়শ শতকের চৈতন্যভাগবতে বৃন্দাবনদাস নবদ্বীপ সম্বন্ধে বলিয়াছেন :
নানা দেশ হইতে লোক নবদ্বীপে যায়।
নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায়।।
অতএব পঢ়ুয়ার নাহি সমুচ্চয়।
লক্ষ কোটি অধ্যাপক নাহিক নির্ণয়।।
“এই সময় হইতে নদীয়ার ভাষা বাঙ্গালার সাহিত্যিক ভাষা হইয়া উঠে। এই ভাষা গৌড়ের বাংলা ভাষারই এক নূতন সংস্করণ। এখন পূর্ববঙ্গের উপভাষা সাহিত্যিকদের নিকট নিন্দনীয় হয়। চৈতন্যভাগবতে তাহার প্রমাণ আছে :
সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
কহিলেন যেন মত আছিলেন বঙ্গে।।
বঙ্গ দেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙ্গালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া।।
বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া।
কদর্থেন সেই মত বচন বলিয়া।।
“বলা কর্তব্য প্রাচীন ও মধ্য যুগে বঙ্গদেশ বলিতে পূর্ববঙ্গ বুঝাইত। পূর্ববঙ্গের ভাষার প্রতি নিন্দা নিম্নলিখিত সংস্কৃত শ্লোকেও পাওয়া যায় :
আশীর্বাদং ন গৃহ্নীয়াৎ বঙ্গদেশনিবাসিনঃ।
শতায়ুরিতি বক্তব্য হয়াহুর্বদতি যতঃ।।
[অর্থাৎ বঙ্গদেশবাসীর আশীর্বাদ গ্রহণ করিবে না, কারণ বঙ্গদেশবাসী শতায়ু বলিতে গিয়া হতায়ু বলিয়া ফেলে।]
“গৌড় ও নবদ্বীপের প্রভার বিশেষতঃ চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস, বিপ্রদাস, বৃন্দাবনদাস প্রমুখ পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যাচার্যগণের অনুসরণে পাঠান রাজত্বের শেষে একটি সাহিত্যিক বাংলা সাধুভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বীরভূম হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এমন কি বাঙ্গালার বাহিরে আরাকানেও এই ভাষা সাহিত্যে ব্যবহৃত হইতে থাকে। মুসলমানী পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় আরবী ফারসী ও হিন্দির মিশ্রণ থাকিলেও তাহা মূলতঃ ব্যাকরণে এই সাহিত্যিক ভাষারই আদর্শে রচিত। তবে ইহা অনস্বীকার্য যে সাহিত্যিক ভাষা বিরাট জণগণের মুখের ভাষাকে কাড়িয়া লইতে পারে নাই। এইজন্য লোক সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা অনেকটা রক্ষিত হইয়াছে, যদিও তাহা সাহিত্যিক ভাষার প্রভাব হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইতে পারে নাই।
“মুসলমান রাজত্বের শেষে বাংলা দেশে নবদ্বীপের সাহিত্যিক গৌরব কৃষ্ণনগরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাদ্বারা রক্ষিত হয়। ইহার পরে যখন কলিকাতা রাজধানী হইয়া শিক্ষাকেন্দ্র হইয়া উঠে, তখন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-রথীদের প্রভার সাহিত্যিক সাধু ভাষার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সাহিত্যিক সাধু ভাষার সহচর একটি সাহিত্যিক চলিত ভাষাও গঠিত হইয়াছে। ইহার বিশেষত্ব ক্রিয়াপরের সংক্ষিপ্ত রূপে,–যেমন ‘করছি’ ‘করিতেছি’ হইতে, ‘করছিলাম’ ‘করিতেছিলাম’ হইতে।”
Leave a Reply