লিখেছেন : শাহরিয়ার ইসলাম রঞ্জন
ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত পাবলিক প্লেসে; আমাকে সবচেয়ে বেশিবার যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয়েছে তা হলো ‘আমি হিন্দু নাকি মুসলিম ‘। এই প্রশ্নের প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্নটি করার একমাত্র কারণ ছিল আমার নাম। আমাকে অপরিচিত কেউ যখন জিজ্ঞেস করে আপনার/তোমার নাম কি? আমি আমার নাম ‘রঞ্জন’ বলার সাথে সাথেই – আমি হিন্দু নাকি মুসলিম এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত থাকি। কারণ ছোটবেলা থেকে এই পরিস্থিতিতে সিংহভাগ সময়ই আমাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
‘রঞ্জন’ একটি খাঁটি বাঙলা শব্দ। যার অর্থ রাঙানো অথবা রঞ্জিত করা। মনেপ্রাণে বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতি ধারণ করা আমার আব্বা যদি জানতো; খাঁটি একটা বাঙলা শব্দে তার পুত্রের নাম রাখার জন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দেশে তার পুত্রকে বারংবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে তাহলে সে তার পুত্রের নাম রঞ্জন রাখতো কি’না জানিনা, তবে রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয় দোষারোপ করতো সে কেন তার ‘রক্তকরবী’ নাটকে নায়কের নাম রেখেছিল রঞ্জন!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে এক শিক্ষিকা ভদ্রমহিলা আমাকে শ্রেণীকক্ষে সবার সামনে একবার এইরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন। সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল। স্কুলে পড়া পর্যন্ত আমার নামটি নিয়ে বেশ হীনমন্যতায় ভুগতাম৷ আমাকে ভোগাতে বাধ্য করেছিল এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধার্মিকেরা৷ এরপর থেকে আর কোন সমস্যা হয়নি। আর এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম তাহলে এমন উত্তর সে শোনে যে তার দ্বিতীয়বার আমার সাথে কথা বলার রুচি অথবা সাহস কোনটাই হয়না।
গতস্য শোচনা নাস্তি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পেজে একটা পোস্ট দেখলাম। কয়েকদিন ধরে তারা দেখে আসছে যে কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে বিশ্বাসী পেজ থেকে তাদের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অপপ্রচারের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে অন্যতম একটা বিষয় হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নাম এবং প্রতিষ্ঠাতা সনাতন ধর্মাবলম্বী। উগ্রবাদীদের ধারণা তারা ইসকন মতাদর্শে বিশ্বাসী। যদিও এখন পর্যন্ত ইসকন কোন ধরনের নাশকতা করেছে অথবা কোন নাশকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল এমন কোন তথ্য এখন পর্যন্ত আমার জানা নেই।
তো, ওই ব্যক্তিগুলার প্রথম সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘বিদ্যানন্দ’ কেন? বিদ্যানন্দ শব্দটি তাদের কাছে হিন্দুয়ানী মনে হয়েছে তাই তারা এর বিপক্ষে। আর তারপরের অভিযোগ প্রতিষ্ঠাতা যেহেতু সনাতন ধর্মাবলম্বী তাই এদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত। এই বিষয়টি নিয়ে যে একটা ক্যাচাল লাগবে আমি তখনই বুঝেছিলাম যখন বিদ্যানন্দ যাকাত দেবার জন্য ফান্ড কালেক্ট করছিল এবং হলো ও তাই। কারণ আমার দেশের মুসলমানদের আমি খুব ভালো করে চিনি। হাড়, রক্ত, মাংস চিনি।
পাশের বাড়ির তারই স্বজাতি একজন মুসলমান না খেয়ে থাকুক তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু অন্য ধর্মের কেউ এসে তাকে সাহায্য করলে তারমধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজবেই।
বিদ্যানন্দ একটি বাঙলা শব্দ। যে শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায় বিদ্যার আনন্দ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ (যাদের বেশিরভাগের জ্ঞান দুই পাতা আমপারা পড়া পর্যন্ত) মানুষের কাছে এই শব্দটা হিন্দুয়ানী তো বটেই সাথে যোগ করেছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি মিথ্যাচার। বাঙালি হয়ে বাঙলা শব্দের অর্থ না জানাটাকে তারা কিছু মনে করেনা৷ সংশয়ে পড়ে যায় ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের নামটি কেন আরবের মরুভূমি থেকে এলো না!
যায় হোক, বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা বেশ জ্ঞানী এবং দূরদর্শী। সে এই ঘটনার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে এবং ভদ্রলোক বিধায় তিনি তার এই ভালোবাসার সংগঠনের স্বার্থে তার পদ ত্যাগ করে তার সংগঠনের মুসলিম কাউকে নিয়োগ দেবে বলেছে।
এই পোস্ট পড়ে অনেকেই দুঃখপ্রকাশ করছে, অনেকে তাকে থেকে যেতে বলছে। কেউবা বলছে কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষের কথায় কান না দিতে।
কিন্তু বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর দাস জানে এই দেশের সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র রুপ।
আর আরবের অর্ধেক সংস্কৃতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলে, আমার মতো অনেক রঞ্জন জানে বাঙলা শব্দে নিজের পরিচিতি দিতে গেলে কি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
============
[এখানে বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজে দেয়া ঘটনাটি শেয়ার করা হলো]
“বিদ্যানন্দ” নামটি দিয়েছেন এক মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্ট। “আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন” স্লোগানের সাথে মিল রেখে তিনি নামটি দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ব্যক্তির নাম থেকে ভেবে ভুল করেন। এজন্য আমরা দুই বছর আগে নাম পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটে করি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ভোট দেয়।
বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০% মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই চালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। যাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কার্যক্রম, অনুদানের গতি।
গত মাসেই বিদ্যানন্দের প্রধান পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবকদের। সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করার এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত। আর তিনি প্রধানের পদ ছাড়লেও বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না, বরঞ্চ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন।
আমরা বিষয়টি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম চলমান ক্যাম্পেইনের পরে। কিন্তু কিছুদিন ধরে চলা মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে জল ঢালতে খবরটি আজকে শেয়ার করলাম।
আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিষয়টি হতাশার নয়। বরঞ্চ পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার এই সমাজে উল্টা পথে হাঁটতে পারার জন্য গর্ব হচ্ছে। আর বিদ্যানন্দে পদে কি যায় আসে? এখানে তো কাজটাই আসল, আর সেটাই আমরা করে ছাড়বো।
শহীদুজ্জামান সরকার
ফেসবুক থেকে হাওয়া কেন?