রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনগুলোর মূল মন্দিরে রামকৃষ্ণ, সারদা ও বিবেকানন্দর তিনটি মূর্তি থাকে। মিশনগুলোতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুইবার যে পূজা-প্রার্থনা হয় তা এই মূর্তিগুলোকে সামনে রেখেই। বিশু বলছিল, এসব বাদেও মন্দিরে প্রায়ই ধর্মালোচনা সভা এবং অন্যান্য ধর্মানুষ্ঠান হয়। তাতে মিশনের মহারাজরা পালাক্রমে আলোচনা করেন। এগুলোও মূলত ওই তিনজনের জীবন ও কর্মকে কেন্দ্র করেই হয়। তাতে একবার একটা গল্প বলা হয়েছিল–
বিশুর কাছে ঘটনাটা শুনছিলাম–গল্পটা এরকম–বিবেকানন্দ তখনো বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেননি। তখন নাম ছিল নরেন–দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের কাছে সবে আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। এর মধ্যে তার বাবা মারা গেলে নরেনরা খুব আর্থিক সংকটে পড়েন। তখন বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের কথা শুনতে আসতেন বটে, কিন্তু পূজা-টূজায় বিশ্বাস বা ভক্তি ছিল না। কথাপ্রসঙ্গে নরেনদের পারিবারিক অবস্থার কথা রামকৃষ্ণ জানতে পারেন এবং তাকে মা-কালীর কাছে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করতে বলেন। প্রথমে রাজী না হলেও মা-কালী সম্পর্কে রামকৃষ্ণের ভালো ভালো কথা শুনে শেষে রাজী হলেন। কিন্তু মা-কালীর সামনে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করার কথা ভুলে গেলেন।
নরেন রামকৃষ্ণের কাছে ফিরে গেলে রামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করেন সে কী কী চাইল। নরেন লজ্জা পেলেন–তিনি সাহায্য প্রার্থনার কথা ভুলে গেছিলেন। তখন রামকৃষ্ণ তাকে আবার পাঠালেন মন্দিরে। এবারও ভুলে গেলেন। তবে তৃতীয় বার নরেন চাইলেন বটে, তবে ‘মা, জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও’–এরকম চাইলেন।–ঘটনাটা বলার পর বিশু আরো বলছিল, এই গল্প শোনার পর থেকে সে নিজেও আর মন্দিরে প্রণাম করার সময় এসব বাদে অন্য কিছু চাইতে পারেনি।
২) অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘মানব-বন্দনা’ নামে একটা কবিতা আছে। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন এককালে স্কুলে পাঠ্য ছিল। মূল কবিতাটি অনেক বড়। সময় পেলে পরে একদিন টাইপ করে দেব। আপাতত এইটুকু দেই–
‘সেই আদি-যুগে যবে শিশু অসহায়,
নেত্ৰ মেলি’ ভবে,
চাহিয়া আকাশ-পানে—কারে ডেকেছিল,
দেবে, না মানবে?
কাতর-আহ্বান সেই মেঘে মেঘে উঠি,
লুটি’ গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর,
ধরায় আগ্রহে।
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকারে, মরুত-গর্জনে,
কার অন্বেষণ?
সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত—ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন।’
অক্ষয়কুমার বড়াল দেখিয়েছেন, মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে বিভিন্ন বিপদে-আপদে মানুষ শুধু মানুষেরই সাহায্য পেয়েছে, কোনো দেবদেবী বা অলৌকিক শক্তি মানুষের কোনো বিপদে কাজে আসেনি। [বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কালেও সেই একই অবস্থা।]
৩) স্বামী বিবেকানন্দর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তথ্যধর্মী বেশ কিছু বই লিখেছেন ‘চৌরঙ্গী’র লেখক শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)। স্বামী বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কী কী রোগে ভুগছিলেন, তার একটা লিস্টও তিনি তৈরী করেছেন–
• শিরঃপীড়া
• টনসিল
• সর্দিকাশি
• হাঁপানি
• টাইফয়েড
• ম্যালেরিয়া
• নানাবিধ জ্বর
• লিভার সংক্রান্ত ব্যাধি
• বদহজম ও অন্যান্য পেটের গোলমাল
• উদরী বা পেটে জল হওয়া
• ডায়ারিয়া
• ডিসপেপসিয়া
• পাথুরি
• লাম্বেগো বা কোমরের ব্যথা
• ঘাড়ে ব্যথা।
• ব্রাইটস ডিজিজ
• কিডনির গোলযোগ
• ড্রপসি–শোথ বা পা ফোলা
• অ্যালবুমিনিউরিয়া
• রক্তাক্ত চক্ষু
• একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা
• নিদ্রাহীনতা
• অকালে চুল দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া
• স্নায়ু রোগ–নিউরোসথেনিয়া
• রাত্রে খাবার পর প্রচণ্ড গরম অনুভব করা
• গরম সহ্য করতে না পারা
• অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
• সমুদ্রযাত্রা ব্যাধি বা সি-সিকনেস
• সান স্ট্রোক
• ডায়াবিটিস
• হৃদরোগ।
যে মায়ের কাছে এককালে ‘চাওয়া’ দিয়েই বিবেকানন্দর ‘বিশ্বাস’ শুরু হয়, এবং আর সব ভক্তবৃন্দও সেটাই বিশ্বাস করেন, সেই মা-ও তার এসব রোগ নিরাময় করে অকালে চলে যাওয়া আটকাতে পারেননি। বিবেকানন্দর গুরু রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর কারণও গলায় আলসার না ক্যানসার যেন। তিনিও অনেকটাই অকালে চলে যান। যে মা স্বয়ং–বিশ্বাস করা হয়–রামকৃষ্ণর হাতে খাবার খেতেন, সেই মা-কালীও তার সেই বিপদে এগিয়ে আসেন নাই। শংকর বরং অনুসন্ধান করে রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক হিসাবে ৩৮ জন ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ও নাড়িজ্ঞানীর নাম পেয়েছেন বলে আরেকটি বইতে উল্লেখ করেছেন। ‘মানব-বন্দনা’ কবিতাটি আবার মনে পড়ল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য–আমাদের মহানবীও যুদ্ধ গিয়ে দাঁত হারিয়েছিলেন, এবং বিষক্রিয়ায় কয়েকবছর মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে তারপর মারা গিয়েছিলেন।
৪) বলা হয় নরেন্দ্রনাথ প্রথম দিকে গোরা নাস্তিক ছিলেন। তাই রামকৃষ্ণ তাকে মা-কালীর সামনে গিয়ে পার্থিব ধন প্রার্থনা করতে বললেও হয়তো নরেনের নাস্তিক মন সেটায় সায় দেয়নি। সে যে জ্ঞান-ভক্তি ইত্যাদি চাইছিল, তারও প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ নেই। বরং নিজের বুদ্ধি-মেধা প্রসঙ্গে যোগেন মহারাজকে সাক্ষী রেখে বিকেকানন্দ বলেছিলেন, “আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ, আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে।…আমাদের পাগলাটে মাথা, হিসেব-ফিসেবের ধার ধারে না, যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”–অর্থাৎ এইসব জিনিস তিনি জন্মসূত্রেই নিয়ে এসেছিলেন, মা-কালীর কাছে চেয়ে পাননি।
৫) বলা হয়–ধার্মিকেরা ইহকালে পার্থিব লোভ আর পরকালে অপার্থব ভয়ের বশবর্তী হয়েই মূলত ধর্ম পালন করে। অর্থাৎ তারা যে মন্দির-মসজিদে মাথা ঠুঁকে সেটা মূলত ইহকালের লোভের লোভে আর পরকালের ভয়ের ভয়েই তা করে থাকে।
দেবদেবীদের মন্দির হলে তাও না হয় একটা কথা ছিল, কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনগুলোর মন্দিরে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ–যারা নিজেরাই সারাজীবন মা-কালীর সামনে মাথা ঠুঁকে ভয়ঙ্কর সব রোগের হাত থেকে রেহাই পাননি, সেখানে তাদের মূর্তির সামনে ভক্তরা মাথা ঠুঁকে কে কী চায়, আর কে কী পায়–সেটা জানতে ইচ্ছে করে। ওহ, দেবদেবীর মন্দিরই বা বাদ দেই কী করে–যেখান থেকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর মতো তথাকথিত অতি উচ্চস্তরের ভক্তরাই ফিরেছেন খালি হাতে, সেখানে আর সব পাতি ভক্তরা কী আশা করে! ওদিকে আমাদের মহানবী যিনি কিনা মহান আল্লাহতালায়ার অতিপ্রিয়ভাজন, যার বিপদে-আপদে ফেরেশতা জিব্রাইল আল্লাহর তরফ থেকে ওহি এনে হাজির করে দিতে দেরী করতেন না, সেই আল্লাহ-ফেরেশতাই কিনা নবীজির দাঁতভাঙা আর বিষখাওয়ার সময়ে চুপ রইলেন–সেখানে পাতি মমিনরাইবা আল্লাহর দরবারে মাথা ঠুঁকে কী আশা করে!
ধর্মজগত বড়ই আজব এবং বিচিত্রময়।
Leave a Reply