বিশুদের গ্রামের প্রান্তে খালের পাড়ে ছিল মন্দিরটি। বিশাল বটগাছের তলাটা এমনিতেই অন্ধকার, তারপর আবার তিনদিক দিয়ে ঘেরা জঙ্গল। তারমধ্যে বিকট কালো কালি মূর্তিটি চোখ জিহ্বা হাত পা লাল করে আছে। তারপর আবার হাতে বিশাল একটি রক্তাক্ত খড়গ। কী ভয়ঙ্কর, কী ভয়ঙ্কর!
সেই শীতকালে পূজার সময়টা ছাড়া পারতপক্ষে কেউ ওদিকটা মাড়াত না। আমি বিশু এবং অন্যান্যদের সাথে গরমকালে খালপাড় যেতাম খইগাছ থেকে খই পাড়তে। তখন জায়গাটা আরো অনেক গাছপালা লতাপাতায় ভরা থাকত। আমরাও ঐ জায়গাটা এড়িয়ে চলতাম। সাপের ভয়ও ছিল। তবে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সবখানে পানি শুকিয়ে গেলে তখনো খালে কিছু পানি থাকত। কয়েকগ্রামের লোক দলে দলে তখন মন্দিরের পাশের ঘাটে গোসল করতে যেতাম।
একটা সময়ে হিন্দু-মুসলিম সবাই ওই কালিকে ভয় পেত। কালির অভিশাপ লাগবে, বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে–এরকম নানান কথা প্রচলিত ছিল। এলাকার চেয়ারম্যান হুট করে একদিন বটগাছটি কেটে ফেললেন। কিছুদিন পরে তার পাশেই এক ভ্যানচালক তার মালয়েশিয়া প্রবাসী ছেলের পাঠানো টাকায় বিল্ডিং করে ফেলল। এভাবে ধীরে ধীরে এলাকাটা সাফ হয়ে গেলো। তারপর ওখানে একটা মুসলিম পাড়া হয়ে গেছে। হিন্দুরাও আর পূজা দিতে যায় না। মন্দির-মূর্তি সব হাওয়া হয়ে গেলো দেখতে দেখতে।
কিন্তু এটাই প্রথম নয়। এরকম ভাবে শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষ থেকে অনেক মন্দির-মূর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাতে কারো কিছুই হয় নি। উলটো মন্দির-মূর্তি নিয়ে মানুষের ভয়টা দূর হয়ে গেছে। এখন অহরহ মন্দির-মূর্তি ভাঙা হয়। কারো উপর দেবদেবীদের অভিশাপ পড়ে না, কারো কোনো ক্ষতি হয় না।
এতোদিন আমরা এ-ও জেনে গেছি যে, নাস্তিক কোতল করলে, ইসলাম ত্যাগকারীদেরকে কোতল করলেও কারো কোনো ক্ষতি হয় না। আমাদের দেশে এটা অপরাধ নয়, বরং অনেক শোয়াবের কাজ।
ওদিকে কোরান নিয়েও অনেক ভয় ছিল আমাদের মনে–কোরান পোড়ালে, কোরানের উপর প্রস্রাব-পায়খানা করলে, চায়ের কাপ রাখলে, কোরানের অবমাননা করলে সরাসরি আল্যার গজব পড়বে! কিন্তু এই কাজগুলোও অনেকে করে দেখিয়েছে যে ভয়ের কিছু নেই, আল্যার গজব জিনিসটা ভূয়া। আইসিস অনেক মাজার-মসজিদ উড়িয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আল্যার গজব বলে কিছু নেই। এই বাংলাদেশেও এই সেদিন হেফাজতিরাও কোরান পুড়িয়েছে–কই আল্যার গজব তো নামে নাই তাদের উপর।
তো এই মন্দির-মূর্তি-মসজিদ ভাঙা, কোরান-হাদিস পোড়ানো–এতে লাভটা কী? কোনো লাভ নেই! নগদে কিছু টাকা-সম্পদ নষ্ট হয়, আর নষ্ট হয় কিছু ইতিহাস। দুইটাই মূল্যবান। তবে মানুষের মনে এসব নিয়ে যে একটা ভয়-ভীতি কাজ করত, সেটাও দূর হয়ে যায়। এসব জিনিসকে যেভাবে পবিত্রভাবে দেখা হয়, সেই অহেতুক ভাব বা মোহটা কেটে যায়। কোরান আগুনে পোড়ে না, মসজিদ ধ্বংস হয় না–এরকম মিথ দূর হয়ে যায়। আবার অনেকে এসব নিয়ে নতুন করে জ্বালাও-পোড়াও খুনো-খুনি শুরু করে–এটা আরেকটা ক্ষতি।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া–এরকম আরো অনেক কিছু হয়তো ক্ষতির তালিকায় দেখানো যায়। তবে এই নষ্ট করা, ভাঙাভাঙিটার শুরুটা মূলত করে সংখ্যাগরুরা, এবং ক্ষমতাবানরা। অথচ আমরা শুনে আসছি–“With great power comes great responsibility”.
Leave a Reply