মাঝে মাঝে মানবতা-মানববাদ জিনিসটারে ভূয়া, অস্তিত্বহীন, বায়বীয়, শুধু একটি আবেগী ব্যাপার বলে মনে হয়। যুগ যুগ ধরে প্রাণীদের যে পৈশাচিকতার কথা শুনি, সেটা যতটা না লোভ লালসা হিংসা বর্বরতার কারণে, তারও বেশি মনে হয় “প্রয়োজনে”। দুর্বলেরা চিরকাল পিছিয়ে থেকেছে, হারিয়ে গেছে… তাদের সবাইকে নিয়ে আগাতে গেলে সবাই হারিয়ে যেতে পারত।
ধরেন কোনো দুর্যোগে দৌড়াতে হবে–যে দৌড়াতে পারবে, সে বেঁচে যাবে; দুর্বলেরা মারা পড়বে। আপনি দুর্বলরে কাঁধে নিয়ে দৌড়ালে সাথে আপনিও পিছিয়ে পড়বেন। মহাবিশ্ব-প্রকৃতি উদাসীন! কে মরল, কে বাঁচল–তার কিছুই যায় আসে না!ত
উদাহরণ স্বরূপ–আজ রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী বা তাদের সবল সমর্থকদের জায়গার দরকার। দুর্বলদের জায়গা সবচেয়ে সহজলভ্য। তাই পাহাড়ি, সাঁওতাল, হিন্দু–এসব সংখ্যালঘুদের হটিয়ে তাদের জায়গা দখল করছে রাষ্ট্রশক্তি। আবার এই রাষ্ট্রশক্তিও অন্য কোনো রাষ্ট্রশক্তির তুলনায় কোনো না কোনো ভাবে দুর্বল।
ধরেন জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। এই দুর্যোগে বাংলাদেশ তলিয়ে যেতে পারে। বেঁচে থাকবে কোনো কোনো দেশ। আবার যদি আরো বড় কিছু হয়–ধরেন পৃথিবীই ধ্বংস হয় যাবে–তখন যাদের সামর্থ আছে, যারা সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে, তারা নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে ফেলবে বেঁচে থাকার।
কেনো এই বেঁচে থাকা? জীবনের উদ্দেশ্য কী? এক কথায় বলতে গেলে–কিছুই না; শুধু বেঁচে থাকা। সবাই বাঁচতে চায়। উন্নতদেশগুলো এখন থেকেই ভাবছে–যদি পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়, তাহলে মানবজাতির কী হবে?
গতবছর থ্যাঙ্কস-গিভিং-ডেতে ইলন মাস্ক (Elon Musk)-এর কথা বলছিলাম। তিনি মনে করেন মানুষের যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবী ত্যাগ করা উচিত। তিনি মঙ্গলগ্রহে দ্রুত বসতি স্থাপনের পক্ষে। সেখানে কিভাবে ‘ওজোন স্তর’ তৈরী করে তাপমাত্রাকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করা যায়, তাই নিয়ে ভাবছেন। এজন্য দরকারে সেখানে এটম-বোম ফেলে তাপমাত্রা বাড়ানোর আইডিয়াও দিয়েছেন। উন্নতদেশগুলোর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই এরকম নানান চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। এই যে তাদের দেশগুলোতে গবেষণা ও প্রতিরক্ষা খাতে এত বাজেট ঘোষণা করা হয়, সেটা তো আর এমনি এমনি না। সবই যোগ্যতার দৌড়ে এগিয়ে থাকা, সেই বেঁচে থাকার তাদিগ…
বেঁচে থাকার তাদিগে, প্রয়োজনে বাংলাদেশ এবং তার সংখ্যাগুরুরা দিন দিন বর্বর হচ্ছে, দুর্বলদের উপর অত্যাচার করছে, সংখ্যালঘুদের হটিয়ে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই বেঁচে থাকার দৌড়ে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
আপডেট–
মানবতা-মানববাদ জিনিসটারে ভূয়া ধরে নিয়ে যে ফেসবুকে এই পোস্টটা দিয়েছিলাম, তাতে Susupto Pathok মন্তব্য করেছেন। উত্তর দিতে গিয়ে বড় হয়ে গেলো বিধায় ফেসবুকে আবার আলাদা পোস্ট দিয়েছি–প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে যোগ করে রাখা হলো।
উনার মন্তব্য–
//আগের পোস্টে সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে দুর্বলকে হটিয়ে সবলের টিকে থাকা ‘প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম’ গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। দাস প্রথাও সভ্যতার এক পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং সভ্যতার উন্নত অবস্থায় তাকে বাতিলও করেছিল। বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশ পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনে ৫০ বছরের মধ্যে (বা তারও বেশি পরে) সাগরের নিচে হারিয়ে যাবে বলেই বিজ্ঞানীদের অভিমত, তখন এই অঞ্চলের মানুষ দেশান্তরিত হবে পৃথিবীর উচু জায়গাগুলোতে। আজকের সভ্যতাই মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে সাপোর্ট করবে। যদিও এখনো সভ্যতা কিছু অমানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমরাও সেই লড়াইয়ের একেকজন যোদ্ধা। কাজেই আপনার হতাশমূলক রচনাটা কাম্য নয়। দুর্বলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সভ্যতার গর্ব।//
উত্তরে দেয়া মন্তব্যটা ছিল এরকম–
লেখার দিক দিয়ে অবশ্যই হতাশমূলক, বা হতাশা থেকেই লেখা বলতে পারেন। বর্তমানে আমরা যে ‘সভ্যতার চর্চা’ করছি সেটা চরম হতাশার তো বটেই, সেই সাথে চরম অসভ্যতারও লক্ষণ। আপনার কমেণ্টের সাথে ১০০% একমত হয়ে আরেকটু এড করি–পোস্টে যে দুর্যোগ এবং দৌড়ানোর কথা বলছি, সেটা আদিম কালের হিসেবে। যেমন কয়েকজন শিকারে গেছে, নেকড়ে এসে তাড়া করছে, তখন যে যার জান নিয়ে দৌড়েছে, দুর্বলেরা মারা পড়েছে। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা ভিন্ন। এখন কেউ বিপদে পড়লে সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়াটাই সভ্যতা। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার মোকাবিলাটাও সবাই মিলে করার চেষ্টা করছে।
আবার যারা বা যেসব দেশ সব কিছুতে এগিয়ে গেছে, ক্রেডিটটা কিন্তু তাদের একার নয়। আমেরিকায় একক কোনো জাতি নেই, সারা পৃথিবী থেকেই এরা মানুষকে জায়গা দেয়। তাদের মধ্যে থেকে যারা মেধাবী, তারাই দেশটাকে এগিয়ে নেন। এভাবেই আমেরিকা বেশি সফল। সেখানে নানান জাতের মানুষ আছে, তারা একেকজন একেক রকম ভাবে একেক কর্মক্ষেত্রে মেধাবী, এবং দক্ষ–সভ্যতা এগিয়ে নিতে এরকম নানান জাতের ও পদের মানুষের দরকার হয়।
নানান দোষ-ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে ভারতীয় সভ্যতাও একটা উদাহরণ হতে পারে–এই যে হাজার হাজার বছর ধরে ‘ভারতীয় সভ্যতা’ আজ যে পর্যায়ে আসছে বা যেভাবে টিকে আছে, তার পেছনেও মুচি, কামার, কুমার, সুতার, ধোপা, নাপিত–এরকম সব জাতের মানুষের অবদান আছে। এমনকি সাঁওতালদেরও ভূমিকা প্রচুর। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের সাঁওতাল বিদ্রোহ…সমাজের আরো নানান ক্ষেত্রে এদের থেকে উঠে আসা মানুষের অবদান আছে। যেমন রামকিঙ্কর বেইজ–এই সাঁওতাল ছিলেন আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যকলার অন্যতম অগ্রপথিক; ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক।
আবার আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে এই ভারতীয় সভ্যতাকেই পিছিয়ে দিয়েছে ভারতের জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ। আসলে তা মনে করি না। পিছিয়ে দিয়েছে এক জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের মানুষদের প্রতি অন্য জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের মানুষদের অবজ্ঞা, ঘৃণা, হিংসা, শত্রুতা।
আমাদের চোখের সামনেই আরেক বাস্তব উদাহরণ–সার্বিকভাবে আমেরিকা এই অবজ্ঞা, ঘৃণা, হিংসা, শত্রুতা জিনিসগুলারে এড়িয়ে চলতে পারছে বলেই সভ্যতার দৌড়ে তারা এগিয়েই চলছে। এরা কারো অবদানকে অস্বীকার করে না। এটা ঠিক, প্রথম দিকে এরা আমেরিকার আদিবাসীদের উপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল। তারা সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেককাল আগেই। শুনেছি সেই আদিবাসীদের অনেকদিন হয় সমস্ত রাষ্টীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, এবং তাদেরকে কোনো ট্যাক্স দেয়া লাগে না। যদি তারা ওই সবাইকে নিয়ে চলার ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারে তাহলে শেষ পর্যন্ত যদি কেউ টিকে থাকে তো এই আমেরিকাই।
Leave a Reply