বিশুদের গ্রামটির অবস্থান ঠিক বাংলাদেশের ম্যাপের মত। উত্তর-পূর্ব-পশ্চিমে তিনটি মুসলমান গ্রাম। মাঝের ছোট গ্রামটি বিশুদের। উত্তরের বড় গ্রামটি আমাদের। ছোট বড় তিনটি রাস্তা দিয়ে গ্রাম চারটির সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। বন্যার সময় উত্তর দিকের পানি যাতে দক্ষিণে নেমে যেতে পারে, সেজন্য আমাদের গ্রাম থেকে শুরু হয়ে মাঝের বড় রাস্তার ব্রিজের নিচ দিয়ে ওদের গ্রামের মাঝ বরাবর একটি ডাঙার মত আছে–অনেকটা উত্তরে আমাদের গ্রাম–আসাম-মেঘালয়; পূর্বের গ্রামটি ত্রিপুরা; পশ্চিমের গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গ; আর মাঝে বিশুদের গ্রাম–ডাঙাটি বাংলাদেশের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা-মেঘনার মত। গ্রামগুলোর দক্ষিণদিকটি বঙ্গোপসাগরের মত–ধূ ধূ প্রান্তর, ফসলি মাঠ।
ফসলি মাঠ গ্রামের ভিতরেও ছিল। বর্ষা বা বন্যার পানি নেমে যেতে থাকলে এই জমিগুলো জেগে উঠত। গ্রামের নারীরা এসব জমি পরিষ্কার করে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে সাধারণত শীতকালীন শাকসবজি ফলাত। বাড়ি থেকে একটু দূরের মাঠগুলো হত ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা। বিশুদের গ্রামের উত্তর দিকে অনেকখানি জায়গা খোলা থাকত। ওখানে আমরা চার গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে ফুটবল খেলতাম।
খেলার সময় ওদের গ্রামে হিন্দু-মুসলিম মিলিত হলেও আমাদের ছোটবেলায় ওদের গ্রামে কোনো মুসলমান ছিল না। তারপর একদিন ওদের গ্রামের দুই পরিবারের পারিবারিক কলহের জের ধরে এক পরিবার ভারত চলে যায়। সেই সুযোগে আমার এক চাচা নামমাত্র নগদ মূল্যে ওই পরিবারের বসতবাড়ি কিনে নিয়ে ওখানে গিয়ে থাকা শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে আরো কয়েকটি পরিবার চলে যায়। ততদিনে আশেপাশের গ্রামের মুসলমানদের হাতে মধ্যপ্রাচ্য-আরবে কামলা দেয়া নগদ টাকা আসা শুরু করে। তারা ওসব চলে যাওয়া হিন্দুদের জায়গা কিনে নিয়ে বাড়ি করা শুরু করে হিন্দু পাড়ায়। ওদের গ্রামের ফাঁকা জায়গাগুলোতে মুসলমানদের নতুন নতুন বাড়ি উঠতে লাগত।
আমাদের গ্রামগুলোতেও একই অবস্থা। পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগল। ছোটরা বড় হতে লাগল, কেউ বিদেশ গেল, কেউ শহরে গেল, টাকা জমিয়ে গ্রামে ফিরে এসে বাড়িসংলগ্ন শাকসবজির জমিতে, খেলার মাঠে নতুন নতুন বাড়ি করতে লাগল, বিয়ে করে নতুন বউ আনল। তাদের আবার ছেলে-মেয়ে হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। পরিবারের সদস্য বাড়ছে তো বাড়ছেই। সবার হাতে ক্যাশ টাকা, কেউ আর কৃষিকাজ করতে রাজি নয়। শাকসবজিও কেউ আর ফলাচ্ছে না–আসলে জায়গাই নেই। নারীরা ব্যস্ত রান্না-বান্না আর টিভি সিরিয়াল নিয়ে। পুরুষেরা ছুটছে ক্যাশ টাকার পেছনে, খবর রাখে কোন হিন্দু ভারতে যেতে চায়, কার জমির কী দাম… আর টাকা হলেই জমি কিনে নতুন বাড়ি। অবসর সময়ে আড্ডা মারে আর ফ্রিতে হেঁটে হেঁটে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়।
গাড়িতে চড়ে হাওয়া খাওয়ার মত অবস্থা অনেকের হলেও বেশিরভাগের ঝোঁকটা বাড়ি করার দিকেই বেশি। নজর থাকে হিন্দু পাড়ার দিকে। ওদিকে দাম কম। একটু ঠেলা দিলেই হয়ে যায়। ৭১-এ হিন্দুরা জানত ওটা সাময়িক–একদিন না একদিন দেশ স্বাধীন হবেই। অনেকে বাড়িঘর ফেলে পালালেও আবার ফিরে এসেছিল। ৯২তেও ভয় পায়নি। ওটাও সাময়িক ছিল, জানত এসব রাজাকারদের কাজ। হিন্দুরা বিশ্বাস করত এর পরে হাসিনা আসবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ২০০২-তেও ভয় পায়নি। হিন্দুরা জানত এর পরে হাসিনা এসে রাজাকারদের বিচার করবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২০১৪ থেকে হিন্দুরা ভয় পাচ্ছে। সেই যে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরেও সারাদেশে হিন্দুদের প্রতি যে নির্যাতন হলো, সেই শুরু। আর হিন্দুমেয়েদের প্রতি মুসলমানদের লোভটা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস না হলে হিন্দুমেয়েদের কথা ভাবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেহারাটা একটু দেখে নেবেন। হিন্দুরা এখন জঙ্গিদের আলাদা করে ভয় পায় না, তাদের কাছে এখন মুসলমান মানেই চরম আতঙ্ক।
২) জঙ্গিরা মাদ্রাসায় উৎপন্ন হয় না–এটা টেকনিক্যালি ঠিক হলেও সাম্প্রদায়িক কীট উৎপন্ন করতে মাদ্রাসার ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এই যুগে গুলশানের মত জায়গায় প্যাশন নিয়ে হামলা করতে না পারলে কেউ আর জঙ্গি বলে ক্রাশ খায় না। এই ক্রাশ খাওয়ানো জঙ্গি হতে হলে টাকা পয়সা থাকতে হয়, ইংলিশ জানতে হয়, স্মার্ট হতে হয়, আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র চালানো শিখতে হয়,–এ সবই ব্যয়সাপেক্ষ। মাদ্রাসার পোলাপানদের এসব নেই। তারা হাতে লাথি নিয়ে চড়াও হয় কোনো হিন্দু পাড়ায় বা গ্রামে–কিছু মন্দির-মূর্তি ভাঙে, কিছু দোকানপাট লুট করে, কিছু বাড়িঘরে আগুন দেয়। তাতেই কাজ হয় বেশি। সারাদেশের হিন্দুরা একযোগে ভয় পায়। দেশ ছাড়ে। আর জায়গাজমি দখল করে বা নাম মাত্র মূল্যে কিনে নেয় মুসলমানরা। জনসংখ্যা বাড়ছে… জায়গার দরকার। হিন্দু বিতাড়নের এটাই মূলত প্রধান কারণ। আর কোনো হিন্দুর ঘরে যদি সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যায় তো চৌদ্দপুরুষের বেহেস্ত কনফার্ম।
৩) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এর আগেও এ বছরের প্রথম দিকে মাদ্রাসার ছাত্ররা তাণ্ডব চালিয়েছিল। মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশ শেষে যারা ঢাকা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল তাদেরও প্রায় সবাই ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই যে নতুন করে হামলা হচ্ছে, স্থানীয় হিন্দুরা বলছে ‘দুর্বৃত্তদের’ কাউকে চিনতে পারছে না। তার মানে এরা আক্রমনের সময় কোথাও থেকে আসে, অর্ডার ফলো করে, আবার যথাস্থানে ফিরে যায়। কেউ খুঁজে পাচ্ছে না এদেরকে।
৪) একটা উদাহরণ দেই–দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সমস্যার উত্থানের মূলে রয়েছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা। সবাই জানে এটা। অথচ কেউ এই মাদ্রাসার ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পায় না। কেউ কাউকে এই মাদ্রাসার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করতেও ভয় পায়। তাই এদের সমস্ত কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে হওয়ার পরেও চাপা পড়ে যায় ভুক্তভোগীদের চাপা আর্তনাদের তলে। প্রতিবছর নিয়ম করে এই মাদ্রাসার নেতৃত্বে ২/৩টা সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। আর স্বয়ং শেখ হাসিনা এসব কিছু জেনেও তার প্রধান কাজ হয় কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলে সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া।
৫) অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ না করে উলটো ধামাচাপা আপনিও দিচ্ছেন, বা আপনি মনে করেন ব্লগ-ফেসবুকে লিখে বা প্রতিবাদ করে কিছুই হয় না। আপনার ধারণা ভুল। কিছু হোক বা না হোক, অন্তত প্রতিবাদটুকু তো হয়। আপনি সেইটুকুও হওয়াতে পারেননি, নিজেকে মানুষও হওয়ার পথেও নিতে পারেননি। তবে সময় শেষ হয়ে যায়নি… অন্যায়-অবিচার যেখানেই হোক, আপনার নজরে এলে প্রতিবাদ করুন, যেভাবেই পারেন… ঘৃণা আর লোভের চাষ না করে মানুষ হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যান…
৬) ভালো স্টুডেণ্ট হতে পারেন, ভালো চাকরি করতে পারেন, সুন্দরী বউ থাকতে পারে, টাকাওয়ালা বর থাকতে পারে, কর্মক্ষেত্রে প্রচণ্ড মেধাবী হতে পারেন, আপনার দেশে দশ/বিশটা ‘পদ্মা সেতু’ থাকতে পারে, বিশাল বিশাল অট্টালিকা থাকতে পারে, বড় বড় শপিং মল থাকতে পারে,…কিন্তু আপনি যা খান বা ব্যবহার করেন তার বেশিরভাগই ভেজাল, যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থায় যখন তখন আপনার মা-বোন ধর্ষিত হতে পারে, যখন তখন দুর্ঘটনায় পড়তে পারেন কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না, যখন তখন খুন হয়ে যেতে পারেন, হাসপাতালে সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও টাকা ছাড়া পাবেন না, সন্তানদের শেখাচ্ছেন ঘৃণা লোভ আর ধর্মান্ধতা, আপনার দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ-কর্মচারী ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ, বেশিরভাগ মানুষ ধর্মান্ধ, গার্মেণ্ট কর্মীদের রক্ত চুষে আর প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো শ্রমের রেমিট্যান্স বাদে দেশের আর কোনো উৎপাদন নেই, এত ছোটো একটা দেশ–লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই…সর্বোপরি আপনার দেশটা একটা সাম্প্রদায়িক দেশ। সামান্য আবেগ ছাড়া নিজেকে এবং দেশকে নিয়ে আপনার গর্ব করার কিচ্ছু নেই।
Leave a Reply