• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

পাল্লাহু । pAllahu

দাঁড়িপাল্লা ধমাধম-এর বাংলা ব্লগ

  • পাল্লাব্লগ
  • চুতরাপাতা
  • মহাউন্মাদ
  • ধর্মকারী
  • রেফারেন্স
  • ট্যাগস

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ১৩)

You are here: Home / ধর্মকারী / সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ১৩)
November 21, 2016
লিখেছেন উজান কৌরাগ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২
বুকে ব্যথার ভারে দুজনেই মৌন, অনেকক্ষণ পর আমার পূর্বপুরুষ কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি বললেন, ‘শাহজালাল সাতশ অনুসারী নিয়ে ভারতে এসেছিল ইসলামী জিহাদের উদ্দেশে। কোনো সাধু উদ্দেশ্য তার ছিল না। তারও অনেক বছর আগে মহম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সাথে এসেছিল সুফিসাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতী। উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ। দিল্লী এবং আজমীরের শাসক তখন পৃথ্বীরাজ চৌহান। ঘোরী দিল্লী আক্রমণ করলে পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজপুত বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তরাইন নামক স্থানে। তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পৃথ্বীরাজের হাতে বন্দী হয় ঘোরী। কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাণহানি সত্ত্বেও দয়ালু পৃথ্বীরাজ ঘোরীকে সসম্মানে মুক্তি দেন। বিশ্বাসঘাতক ঘোরী সংগঠিত হয়ে পরের বছর পুনরায় দিল্লী এবং আজমীর আক্রমণ করে। তরাইনের এই দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘোরীর কাছে পরাজিত হয়ে বন্দী হন পৃথ্বীরাজ। বেঈমান ঘোরী পৃথ্বীরাজের চোখ উপড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী অস্ত্রহাতে ঘোরীর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর তিনি আজমীরের আনাসাগর লেকের কাছে আস্তানা গাড়েন, আশপাশের প্রচুর হিন্দুদের ইসলামে দীক্ষিত আর তাদের মন্দির ধ্বংস করেন। হিন্দুদের বিখ্যাত এক মন্দিরের সামনে তিনি প্রতিদিন একটি ক’রে গরু জবাই করতেন হিন্দুদেরকে অপমান এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য। 
শাহজালালের অনেক আগে বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের পর বঙ্গে এসেছিলেন আরেক সুফি শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজী, পান্দুয়ার (মালদাহ) দেবতলায় তিনি একটি মন্দির ধ্বংসের পর সেখানে খানকাহ্ নির্মাণ ক’রে প্রচুর হিন্দু এবং বৌদ্ধকে ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন।
সুফিরা কোথাও অস্ত্র হাতে সরাসরি জিহাদে অংশ নিতেন, আবার কোথাও পেছনে থেকে মুসলিম শাসকদের ইন্ধন জোগাতেন বিধর্মীদের মন্দির-উপসনালয় ধ্বংস ক’রে তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত অথবা হত্যা করার জন্য। কোথাও ইসলামের বিজয়ের খবর পেলে তারা উল্লাসিত হয়ে মুসলিম শাসকদের প্রশংসা করতেন আর বিধর্মীদের ওপর আরো জোরালো হামলা চালানোর জন্য উৎসাহিত করতেন। বিধর্মীদের রাজ্য থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ আল্লাহ্’র উপহার হিসেবে তারা গ্রহণ করতেন। দিল্লী, কাশ্মীর, গুজরাট, বঙ্গসহ ভারতবর্ষের মুসলিম শাসিত সকল অঞ্চলের চিত্র একইরকম ছিল।’ 
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘অথচ সকলে বলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলামের সাম্যবাদে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে।’
‘হুম, সাম্যবাদ! কীসের সাম্যবাদ? জাতপাতহীন ইসলামের সাম্যবাদ ছিল এক বাতাসের ঘর, তা আর চোখে দেখিনি কোনোদিন। ইসলাম যদি সাম্যবাদের ধর্মই হবে, তাহলে আশরাফ আর আতরাফ শব্দদুটোর প্রচলন হলো কী ক’রে? তুর্কি, আফগান আর পারসিকরা নিজেদেরকে উঁচুজাত মনে করে, ওরা নিজেদেরকে বলে আশরাফ; আশরাফরা আমাদেরকে মানে ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানদেরকে বলে আতরাফ অর্থাৎ নিচুজাত, নিচুজাত হিসেবেই ওরা আমাদেরকে অবহেলা, অপমান আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। হিন্দু তাঁতী মুসলমান হয়ে হলো তন্তুবায় জোলা, জেলে হলো নিকিরি; নাম পরিবর্তন হলেও সামাজিক অবস্থানের কোনো-ই পরিবর্তন হলো না। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে; কিছু দাগী চোর-ডাকাত আর উচ্ছৃঙ্খল স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। শাহজালালের শিষ্যদের মুখে ওরা যখন শুনলো যে, ইসলাম গ্রহণ করলে ব্রা‏হ্মণসহ সকল বর্ণের হিন্দুদের সম্পদ লুন্ঠন ক’রে ভোগ করা যাবে, তাদের অন্তঃপুরের নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে সম্ভোগ করা যাবে, সেবার জন্য তাদের বালক এবং কিশোর পুত্রদেরকে দাস হিসেবে রাখা যাবে; আর এসবে কোনো পাপ হবে না, হবে সোয়াব। আবার ইহজগতে এতোসব ভোগ-বিলাসিতার পরেও পরজগতে বেহেশতে যাওয়া যাবে, সেখানেও মিলবে ভোগ-বিলাসের অঢেল উপকরণ-ফলের বাগান, ঝর্ণা, দুধ আর মদের নহর, পদ্মরাগের মতো বাহাত্তরটা ষোড়শী হুরি, মুক্তার মতো আশি হাজার সুদর্শন গেলমান ইত্যাদি; তখন ওদের রক্তে যেন আগুন জ্বলে উঠলো; একদিকে এতো সব ভোগ-বিলাসিতা আবার অন্যদিকে মুসলমানদের হাত থেকে নিজের পরিবার-পরিজনকে রক্ষাও করা যাবে; তখন ওরা দলে দলে ছুটলো সুফির কাছে। ইসলাম গ্রহণের পর ওরা আরো উশৃঙ্খল হয়ে উঠলো; যারা কোনোদিন ব্রা‏হ্মণ কিংবা উচ্চবর্ণের মানুষের অন্তঃপুরে যাবার সাহস পায়নি, তারাই বিছানায় নিয়ে সম্ভোগ করলো ব্রা‏হ্মণ আর উচ্চবর্ণের নারীদের; বাদ গেল না হিন্দু নিম্নবর্ণের নারীরাও।
কিছু ভাল মানুষও ইসলাম গ্রহণ করেছে একান্ত বাধ্য হয়ে; জিজিয়া, খারাজ আর অন্যসব করের বোঝা টানতে আর অপমান-অবহেলা সহ্য করতে না পেরে। একদা যেসব হিন্দু আর বৌদ্ধরা ছিল সম্ভ্রান্ত ধনী, একসময় তাদেরকেই দেখেছি অতীতের চোর-ডাকাত নব্য মুসলমানের দ্বারে দ্বারে করুণা ভিক্ষে করতে; তবু তারা নিজধর্ম ত্যাগ করেনি। কিন্তু সবাই নিজধর্ম ধরে রাখতে পারেনি, অভাব আর অত্যাচারের কাছে হার মেনেছে। হিন্দু আর বৌদ্ধদের কাছ থেকে খারাজ আর জিজিয়া কর বাবদ ফসলের চার ভাগের তিন ভাগই নিয়ে নিলে কখনো আধপেটা খেয়ে কখনো বা না খেয়ে দিন কেটেছে তাদের; মন্দিরের সাথে সাথে হিন্দুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বৌদ্ধদের বিহার ধ্বংস ক’রে তার জায়গায় গড়ে উঠেছে মক্তব আর মাদ্রাসা, হিন্দু-বৌদ্ধ ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করার মতো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। দরিদ্র হিন্দু আর বৌদ্ধরা তো বটেই, অপেক্ষাকৃত ধনীরাও খারাজ আর জিজিয়া কর দিতে গিয়ে নানান অপমানের শিকার হয়েছে। সামর্থ্য থাকলেও কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ মূল্যবান পোশাক প’রে বা ঘোড়ায় চড়ে কর দিতে আসতে পারে না, অতি সাধারণ পোশাক পরিধান ক’রে তাদেরকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়। কর আদায়কারী বসে থাকে আর কর প্রদানকারী থাকে দাঁড়িয়ে। এরপর কর আদায়কারী তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘জিজিয়া পরিশোধ কর।’ 
জিজিয়া পরিশোধ করার পর তার মাথার পেছনে চড় মেরে তাকে তাড়িয়ে দেয়। অন্য নব্য মুসলমানরা তখন উল্লাস করে, হাসে। খারাজ প্রদানের সময় যদি কোনো আদায়কারীর মতে হয় যে, সে খারাজদাদার মুখে থুথু দেবে, তখন খারাজদাতাকে মুখ হাঁ করতে হয় আর আদায়কারী তার মুখে থুথু দেয়। অনেক সময়ই দেখা যায় যে, কর আদায়কারী অতীতে চোর-ডাকাত ছিল, নয়তো নিচুজাতের কোনো দরিদ্র শ্রমিক ছিল, যে হয়তো একদা কর প্রদানকারীর বাড়িতে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো; কিন্তু পরে তারাই নিপীড়ন করেছে পূর্বের মালিককের ওপর। কারো সাথে কোনো বিষয়ে পূর্ব শত্রুতা থাকলে তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কাফেরদের ওপর এইসব অত্যাচার করা নাকি সুন্নত, এইসব অবমাননা এবং অপমানজনক কাজ ওরা করে অন্য ধর্মকে হেয় আর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য। নানা জায়গায় বিধর্মীদের অপমান আর নিপীড়নের নানান রকম পন্থা ছিল। অনেক জায়গায় হিন্দু আর বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলে মুসলমানরা। হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর এই ঋণ যাতে শোধ না করতে হয়, সেজন্য তারা কাজীর কাছে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করে যে, মহাজন তাদের নবী এবং ধর্মের নামে গালিগালাজ করেছে। এই ধর্মীয় অবমাননার কথা শুনে ক্ষিপ্ত মুসলমানরা মহাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায়, মারধর করে, তারপর খৎনা ক’রে কলেমা পড়িয়ে তাকে মুসলমান বানায়। এইরকম নানাবিধ ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিপীড়ন-নির্যাতনের ফলে অনেকে বাধ্য হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছে, এখনো করছে।’
আমি শুনি আর হতবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে, মধ্যযুগের মুসলমানদের এই সব কৌশল একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশী মুসলমানরা এখনো কী অবলীলায় প্রয়োগ করছে! ২০১২ সালে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার সাজানো অভিযোগ তুলে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া; চট্টগ্রামের পটিয়াসহ আরো কিছু জায়গায় অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালায় মৌলবাদী মুসলমানরা; তাদের মন্দির, ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছারখার ক’রে দেয়। পাবনা এবং আরো কয়েকটি জেলাতেও হিন্দু কোনো যুবকের ফেইসবুক হ্যাক ক’রে ইসলামবিরোধী ছবি এবং লেখা পোস্ট দেয় মুসলিম মৌলবাদীরা, তারপর নিজেরাই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট ক’রে আগুন ধরিয়ে দেয়। 
এ যেন মহাকালের মঞ্চে ইতিহাসের পুনর্মঞ্চায়ন! পার্থক্য কেবল এটুকুই – হিন্দু এবং বৌদ্ধরা এখন ইসলাম গ্রহণ না ক’রে দেশ ছেড়ে চ’লে যাচ্ছে ভারতে কিংবা অন্য কোনো দেশে। 
কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ইসলামের কী দেখে মুগ্ধ হবে মানুষ! ইসলাম আমাদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম, ঘৃণার নাম। ভয়ে রাজ্যের মানুষ তটস্থ হয়ে থাকতো, ঘুমোতে পারতো না রাতে, ঘুমের মধ্যেও দুশ্চিন্তা – এই বুঝি যবনরা আক্রমণ করলো। কতো গুজব ছড়াতো বাতাসে যে, যবনরা আক্রমণ করেছে, এদিকেই ধেয়ে আসছে। শুনলেই আমরা বনে-জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম, বহুবার এমন হয়েছে। তবে আসল খবরটি পেতাম বাণিজ্য থেকে ফেরা মানুষদের কাছে। চেনা-জানা অনেকেই বড় বড় বণিকদের বাণিজ্য নৌকায় দাঁড় বাইতো নয়তো শ্রমিকের কাজ করতো, তারা ফিরে এলে মানুষ তাদের ছেঁকে ধরতো সংবাদ শোনার জন্য। তাদের মুখে শুনতে পেতাম কেবলই দুঃসংবাদ, অমুক রাজ্য যবনরা দখল ক’রে নিয়ে, তমুক রাজ্য যবনরা দখল ক’রে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, তারা কোনোক্রমে জীবন নিয়ে পালিয়েছে, এসব। তো এসব শোনার পর একসময় নিজেরাই যখন হামলার শিকার হয়েছে, তখন মানুষ কোন বুদ্ধিতে ইসলাম ধর্মের প্রতি মুগ্ধ হবে, আর কেনই বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে!’
কথা শুনতে শুনতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল, শুনতে হবে আরো অনেক কথা। কিন্তু আমার ভেতরটা আকুলি-বিকুলি করছে পূর্বপুরুষের আদি ভিটেটা দেখার জন্য। বললাম, ‘যেখানে আমার শিকড়, যেখানে আপনার জন্ম, যেখানে আমাদের আরো অনেক পূর্বপুরুষের নাড়িপোঁতা; আমি সেই বাড়িটি দেখতে চাই।’ 
‘দেখবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘দেখো না, দেখে সহ্য করতে পারবে না।’
‘তবু আমি দেখবো।’
‘বেশ, চলো।’
আমরা উঠে পড়লাম। সুরমার পার ধরে ইটের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম আমি আমার পূর্বপুরুষের কাঁধে হাত রেখে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে একটা মসজিদ চোখে পড়লো। মসজিদের আঙিনায় একজন বৃদ্ধ পাগল বিড়বিড় করছে, আমাদেরকে দেখে সে ছুটে এলো। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে আমার পূর্বপুরুষের দিকে তাকালাম তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘ভয় পেয়ে না, ও কাউকে আঘাত করেনা, শুধু প্রশ্ন করে।’
‘লা ইল্লাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, লা ইল্লাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ…..। হয় নাই?’ পাগলা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে আমার পূর্বপুরুষ ইশারা করলেন হ্যাঁ বলার জন্য। বৃদ্ধ পাগলের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, হয়েছে।’
বৃদ্ধ পাগল শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে হাততালি দিতে দিতে নাচতে লাগলেন, ‘তয় ব’লে পারি না, পারছি, পারছি!’
অল্পক্ষণ পরই নাচ থামিয়ে হাসি বন্ধ ক’রে খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লারে দেখছেন, আল্লা?’ 
মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, দেখি নাই।’
‘আল্লাহ্’র কাছে বিচার দেব, বিচার।’ আকাশের দিকে আঙুল তুললেন, ‘ওই সাত আসমানের ওপর থেকে যেদিন আল্লাহ্ নেমে আসবে এই ঘরে, সেদিন তার কাছে বিচার দেব।’ 
‘কীসের বিচার দেবেন আপনি?’
‘কেন জানেন না, আল্লাহ্’র লোকজন এসে আমার বাবাকে বলি দিল, তারপর মূর্তি ভাঙতে ভাঙতে বললো যে, এই মাটির মূর্তিতে আল্লাহ্ থাকে না, আল্লাহ্ থাকে সাত আসমানের ওপরে। তারপর তারা মন্দির ভেঙে এখানে আল্লাহ্’র ঘর বানালো। সেই থেকে বসে আছি আল্লাহ্’র অপেক্ষায়, কিন্তু আল্লাহ্’র ঘরে আল্লাহ্ আর এলো না। বৃষ্টির সময় আমি আল্লাহ্’র ঘরে ঢুকলেই আমাকে মেরে বের ক’রে দেয়। আমি ওদের কতো বলি যে, আমাকে থাকতে দাও, আল্লাহ্ এলেই আমি বাইরে গিয়ে শোব, ওরা শোনে না, আমাকে মেরে বের ক’রে দেয়। এই ঘরে কতো মানুষ আসে নামাজ পড়তে, কিন্তু আল্লাহ্’র ঘরে আল্লাহ্ কেন আসে না, কেন আসে না? বিচার দেব বিচার, বিচার…!’
বলতে বলতে চলে গেলেন বৃদ্ধ পাগল, আমরাও সামনের দিকে পা বাড়ালাম। আমার পূর্বপুরুষ বললেন, ‘ওর বাবা এখানকার মন্দিরের পুরোহিত ছিল। ওর সামনেই তাকে জবাই করেছিল শাহজালালের শিষ্যরা। এরপর ওর পরিবারের অন্যদেরকে হত্যা করেছিল। আমার সাথেই ওকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল শাহজালাল। কিন্তু এর পর থেকেই ও পাগল হয়ে গেল। ওর পরিবারের কেউ বেঁচে ছিল না, কোনো আত্মীয়-স্বজনেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ও এখানেই আছে, ক্ষুধা পেলে হাটে-ঘাটে কিংবা মানুষের বাড়িতে গিয়ে চেয়ে খায়।’ 
শুনতে শুনতে বুকটা ভার হয়ে যায়, না জানি কতো মানুষের জীবন এমন বিপন্ন হয়েছে ইসলামী আগ্রাসনে। কতো সম্পর্ক, কতো সংসার, কতো জনপদ ধুলোয় মিশেছে! 
আমার পূর্বপুরুষদের নাড়িপোঁতা ভিটেয় এসে দাঁড়ালাম আমরা দু’জন। ঘাস, লতা-পাতায় জঙ্গলাকীর্ণ একটি মাটির বাড়ি। আমার পূর্বপুরুষকে পেছনে ফেলে আঙিনার ঘাস, লতা-পাতার ভেতর দিয়ে আমি এগোলাম; আঙিনার একপাশে পড়ে আছে গরুর গাড়ির একটি পুরনো পচন ধরা চাকা, তার পাশে জবা গাছে ফুটে আছে দুটো রক্তজবা। কাছেই প্রায় বসে যাওয়া তুলসি-ভিটে; তুলসি-ভিটের ওপর দুটো কড়ি একটা তামার পয়সা, নিচে এক টুকরো ভাঙা শাখা। ঘরের সামনে একটা পোড়ামাটির পুতুল। ঘরের দেয়ালের মাটি জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে, দেয়াল বেয়ে লতা উঠেছে শণের চালায়; চালার শণ রোদে-বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও পচে ঝরে পড়েছে। হঠাৎ চমকে গিয়ে পুঁইপাচার কাছে থমকে দাঁড়ালাম বেশ লম্বা একটা কঙ্কাল দেখে! কঙ্কালটির মাথার খুলি ভাঙা। 
আমার পূর্বপুরুষকে বললাম, ‘এটা কার কঙ্কাল?’
কঙ্কালে চোখ স্থির রেখে তিনি বললেন, ‘আমার কাকার।’
কয়েক পা এগোতেই বারান্দার নিচে দেখতে পেলাম আরেকটি কঙ্কাল, এটা আগেরটার চেয়ে কিছুটা খাটো। জিজ্ঞেস করলাম ‘এটা কার?’
‘আমার জ্যাঠার।’
আমার দৃষ্টি আঁকড়ে ধরলো পইঠায় পড়ে থাকা একটি হুঁকো।
ঘরের উদ্দেশে পইঠায় পা রাখলাম, আমার পূর্বপুরুষ আঙিনাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম। মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে ঢোকা মোলায়েম আলো ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। ঘরের দক্ষিণপাশের মেঝেতে তাকাতেই আমি আঁৎকে উঠলাম কঙ্কালের স্তুপ দেখে! কোনটার মাথা কোনটা, কোনটার পা বা হাত কোনটা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। একটা কঙ্কালের বুকের পাঁজ ভেদ ক’রে রয়েছে একটা তরবারি। আমি নিথর চোখে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম কঙ্কালগুলোর দিকে তাকিয়ে। আমার হাত নড়ছে না, পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে, বুঝিবা থেমে গেছে বুকের স্পন্দন! কতোক্ষণ কেটে গেল আমি জানি না, নৈঃশব্দ্য খান খান ক’রে ডেকে উঠা একটি কাকের কর্কশ স্বরে শুনে আমি অবচেতন থেকে চেতনে ফিরলাম। দু-চোখ ঝাপসা, কপোল বেয়ে চিবুকে ঠেকেছে জল। আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। কোথায় আমার পূর্বপুরুষ, কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি! ডেকে সাড়া পেলাম না, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজেও তার দেখা পেলাম না। বুঝলাম তিনি আর আমার সামনে আসবেন না। আমার চোখ পড়লো উঠোনে পড়ে থাকা পুতুলটার ওপর, মেয়ে পুতুল। নিশ্চয় আমার কোনো পূর্বপুরুষের ছোট্ট মেয়ে খেলা করতো পুতুলটা নিয়ে, তুলতুলে হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো পুতুলটাকে, হয়তো মিথ্যে মিথ্যে বুকের দুধও পান করাতো। আহা, মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না। আমার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে আরো কতো কিছু জানবার ছিল, তাও জানা হলো না।
আমি নিচু হয়ে পুতুলটা স্পর্শ করতেই পুনরায় হলদে পাখি হয়ে গেলাম! আঙিনায় ঘুরে ঘুরে খুঁটে খুঁটে পূর্বপুরুষের ভিটের কিছু শস্যদানা খেলাম, নিমগাছের নিচে একটা ভাঙা মৃৎপাত্রে জমে থাকা জল পান ক’রে তৃপ্ত হলাম। তারপর উড়ে গিয়ে বসলাম কদমগাছের ডালে, শেষবারের মতো পূর্বপুরুষের ভিটেয় জলভরা দু-চোখ বুলিয়ে আবার উড়াল দিলাম আকাশে! 
(চলবে)
Category: ধর্মকারীTag: রচনা
Previous Post:হরর হাদিস – ১৬
Next Post:আমার বোরখা-ফেটিশ – ২০১

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাল্লাহু । pAllahu • ফেসবুক • পেজ • টুইটার

Return to top