একটা বিষয় ভেবে–যতটা না অবাক হচ্ছি, তারও বেশি ‘হা-হা-হা’ অবস্থা। বিষয়টা নিয়ে বড় করে লিখতে পারলে ভালো লাগত। তবে পরে সময় সুযোগ না পেলে একেবারে ভুলে যেতে পারি। তাই হালকা নোট করে রাখি–
মহাভারতের শুরুটা করে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, আর শেষ করে কৃষ্ণ। এই দুইজনই অনার্য। ‘কুরুক্ষেত্র-প্রজেক্ট’-এর পটভূমি রচিত করে দেয় ব্যাসদেব। আর সেটাকে বাস্তবায়িত করে কৃষ্ণ। প্রজেক্টটা ছিল ভারত থেকে সমূলে আর্যদের বিনাশ, নয়তো এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধ্বংস করে ভারতে আবার অনার্যদের ধারাটা ফিরিয়ে আনা।
মহাভারতের সবকিছুই হয় ব্যাসদেব আর কৃষ্ণের পরিকল্পনানুসারে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাসদেবের কর্মকাণ্ড চোখে না পড়লেও কৃষ্ণের কলকাঠি নাড়া বড় স্থূল আকারেই আমাদের চোখে পড়ে।
কৃষ্ণ আগাগোড়া বৈষ্ণব, নিরামিষাহারী, গো-রক্ষক কৃষিজীবী–আর্যদের উলটা। কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা। তার সাথে বিয়ে হয় ফুপাতো ভাই অর্জুনের। তাদের সন্তান অভিমন্যু। অভিমন্যুর সন্তান পরীক্ষিত। মহাভারতের মতে পরীক্ষিতের সময় থেকে কলিরযুগের শুরু। কলিতে সব বাদ; থাকে শুধু হরিনাম। এখানে উল্লেখ্য যে, আর্যপূর্ব অনার্যদের লোকায়তিক ধারাগুলোর একটা ধারা হলো এই বৈষ্ণব ধারা।
মহাভারত যুগের পরে আর্যদের দেবতা ব্রহ্মার পূজাও বাদ হয়ে যায়। বাদ হয়ে যায় সূর্য অগ্নি ইন্দ্র বরুন পবন অশ্বিনীদের মত প্রভাবশালী দেবতাদের পূজা। অনার্যদের পুরুষ-প্রকৃতি চিন্তাধারার সূত্র ধরে পুরুষ হিসাবে ফিরে আসে আদিদেব শিব, পূজিত হয় শিবলিঙ্গ আকারে–শৈব মতবাদ; প্রকৃতি ফিরে আসে মাতৃরূপে–শাক্ত মতবাদ। ফিরে আসে অনার্য নারায়ণ–শালগ্রাম শিলা রূপে। অনার্যদের কাছে অনার্য কৃষ্ণ পূজিত হতে থাকে ‘পালনকর্তা’ বিষ্ণুর আরেক রূপ হিসাবে। ফিরে আসে পুরুষতান্ত্রিক আর্য সমাজ-পূর্ব মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজের দেবীরা।
পরের দিকে হয়তো ‘কর্মগুণে বর্ণ পাল্টায়’–এই সূত্র প্রয়োগ করে নিজেদের যুদ্ধবাজ-ক্ষত্রিয় বলে দাবী করা আর্যদের অবশিষ্টাংশের কোনো কোনো চতুর আর্য ক্ষত্রিয়-বর্ণ পালটে ব্রাহ্মণরূপ ধারণ করে যুদ্ধ-হানাহানি-বিহীন অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য অস্ত্রসস্ত্র ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র রচনা শুরু করল। ক্রমে চালাকি খাটিয়ে লোকায়তিক সহজসরল মানুষগুলোকে বশে এনে এদের ঘাড়ে আবার চেপে বসল। তারপর জগাখিচুরি পাকিয়ে শুরু হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী “হিন্দুধর্ম”-এর পথ চলা। কিন্তু ততদিনে কৃষ্ণ সবার ঘরের ছেলের মত আপন হয়ে গেছে; সবাই বিভোর কৃষ্ণপ্রেমে। কৃষ্ণকে ‘হারামজাদা’ বলে গালি দিলেও জনসাধারণের কাছে সেটা পজেটিভ বিশেষণ। ব্রাহ্মণরা কোনো ভাবেই কৃষ্ণকে আর তার আসন থেকে নড়াতে পারলো না। এমনকি রাঙা-ফর্সা রাধাকে দিয়েও কৃষ্ণের গায়ে কালিমা লেপন করা গেলো না, উলটা কৃষ্ণের প্রেমে মজে রাধাই হয়ে গেলো ‘কলঙ্কিনী’!
Leave a Reply