আবু সায়ী’দ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, একদা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সম্মুখে তাঁহার চাচা আবু তালেবের বিষয় উল্লেখ করা হইল। হযরত (সঃ) বলিলেন, আশা করি তাহার শাস্তি লাঘব করিতে, কেয়ামতের দিন আমার সুপারিশ সাহায্য করিবে। তাহাতে অল্প পরিমাণ দোযখের আগুনে রাখা হইবে; দোযখের আগুন তাহার পায়ের গিঁট পর্যন্ত থাকিবে, কিন্তু তাহা দ্বারাই তাহার মাথার মগজ পর্যন্ত টগবগ করিতে থাকিবে। (বোখারী শরীফ, খণ্ড ৬, হাদিস ১৬৯১, মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, মহাদ্দেছ জামিয়া কোরআনিয়া, লালবাগ ঢাকা কর্তৃক অনুদিত। ইংরাজি ৫.৫৮.২২৪, ২২৫)
কিন্তু মেয়ের [ফাকিতাহ্ বা উম হানি] বিবাহের ব্যাপারে আবু তালেবের অন্য পরিকল্পনা ছিল। আবু তালেবের মা ছিলেন মাখযুমি গোত্রের মহিলা। হুবায়রা ছিলেন আবু তালেবের মায়ের ভাই । তিনিও আবু তালেবের কাছে ফাকিতার (উম হানির) হাত চেয়েছিলেন। হুবায়রা শুধুমাত্র বিত্তবানই নয় আবু তালেবের মতই প্রতিভাবান কবি ছিলেন। মক্কায় তখন মাখযুমি গোত্রের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আর হাশিমি গোত্রের প্রভাব ক্রমশঃ অধঃপতনের দিকে যাচ্ছিল। ভেবে চিন্তে আবু তালেব শেষ পর্যন্ত হুবায়রার সাথেই তাঁর কন্যা ফাকিতার (উম হানির) বিবাহ দিয়ে দিলেন। আবু তালেবের ভাতিজা (নবী মুহাম্মদ) এই ব্যাপারে আবু তালেবকে মৃদুভাবে ভর্ৎসনা করলেন, তখন আবু তালেব উত্তর দিলেন: “তারা তাদের মেয়েকে আমাদের গোত্রে বিবাহ দিয়েছে—তাই একজন বদান্য পুরুষের জন্য অবশ্যই বদান্যতা দেখান প্রয়োজন।“ এই বাক্যের দ্বারা নিঃসন্দেহে আবু তালেব তাঁর মায়ের (মাখযুমি গোত্রের) সাথে আবু তালেবের গোত্রের বিবাহের ঘটনা বুঝাচ্ছিলেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যা খুব জোরালো ছিল না। কারণ, আবু তালেব যে ঋণের উল্লেখ করেছিলেন তা আবদুল মুত্তালিব পরিশোধ করেছিলেন তাঁর দুই কন্যা আতিকাহ্ এবং বারাহ্ কে মাখযুমি গোত্রের দুই পুরুষের সাথে বিবাহ দিয়ে। নিঃসন্দেহে বলা যায় তাঁর চাচা এই সিদ্ধান্তের দ্বারা সদয় ও ভদ্রভাবে মুহাম্মদকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে মুহাম্মদ তাঁর কন্যার যোগ্য ছিলেন না। যাই হোক, মুহাম্মদ এই পরিস্থিতি মেনে নিলেন। কিন্তু অল্পসময়েই মুহাম্মদের জীবনে পরিবর্তন এসে গেল (খদেজার সাথে মুহাম্মদের বিবাহ) (লিঙ্গস্, পৃঃ ৩৩)
আহমদ ইব্ন মুহাম্মদ মক্কী (র.)…আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (স.) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা এমন কোন নবী পাঠাননি, যিনি বকরী চরান নি। তখন তাঁর সাহাবীগণ বলেন, আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ; আমি কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম। (বুখারী শরীফ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১১২, হাদিস নম্বর ২১১৯, ইসলামিক ফাইন্ডেশন বাংলাদেশ)
মুহাম্মদ আবু তালেবকে প্রস্তাব দিলেন উম হানিকে বিবাহের জন্য। কিন্তু মুহাম্মদের প্রতি আবু তালেবের যথেষ্ট মায়া মমতা থাকে সত্ত্বেও তিনি এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন যেহেতু মুহাম্মদ ছিলেন দরিদ্র। মুহাম্মদের বয়স যখন পঁচিশ তখন আবু তালেব মুহাম্মদকে প্রস্তাব দিলেন খদেজাকে বিবাহ করার জন্য। খদেজা ছিলেন কুরাইশ গোত্রের এবং খুয়েলিদের কন্যা। ইতিপূর্বে খদিজার দুইবার বিধবা হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দুই পুত্র এবং এক কন্যার মাতা। এরা সবাই ছিল তাঁর ভূতপূর্ব দুই স্বামীর ঔরসজাত। সেই সময় মুহাম্মদ খদিজার অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন—তাঁর বাণিজ্যের দেখাশোনা করতেন। ইতিমধ্যেই খদিজার বাণিজ্যের জন্য মুহাম্মদকে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সিরিয়া যেতে হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দামেস্ক এবং আলেপ্পো শহর গুলিও। বাণিজ্যের উপর মুহাম্মদের প্রখর দক্ষতা খদেজাকে ইতিমধ্যে মুগ্ধ করেছিল। (ওয়াকার, পৃঃ ৯১)
আবু উসামা মাবিয়া বিন জুহায়ের বিন কায়েস বিন আল হারিস বিন দুবায়াব বিন মাজিন বিন আদিয় বিন জুশাম বিন মাবিয়া ছিলেন মাখযুম গোত্রের এক মিত্র। বদরের যুদ্ধে যখন হুবায়রা বিন আবু ওহব্ তার দলবলসহ পালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হুবায়রা ক্লান্ত থাকায় যুদ্ধের বর্ম ফেলে দিল। তখন মাবিয়া সেই বর্ম তুলে নিল। সে (অর্থাৎ হুবায়রা) নিচের কবিতা রচনা করল:
এই অবরোধ চলতে থাকল, কোন সত্যিকার যুদ্ধ ছাড়াই। কিন্তু কুরায়েশদের কিছু অশ্বারোহী সৈনিক, যথা বানু আমির বিন লুয়ায়ের ভ্রাতা আমর বিন আবদু ওদ বিন আবু কায়েস, দুই জন মাখযুমা গোত্রের ইকরিমা বিন আবু জহল ও হুবায়রা বিন আবু ওহব (উম হানির স্বামী)। আরও ছিল কবি দিরার বিন আল খাত্তাব, বানু মুহারিব বিন ফিহরের ভাই বিন মিরদাস। এরা সবাই যুদ্ধের বর্ম পরে অশ্বে আরোহণ করে বানু কিনানার স্থানে গেল এবং তাদেরকে বলল, ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক। আজই তোমরা জেনে যাবে কারা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিক।‘ তারপর তারা দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে পরিখার কিনারায় থামল। পরিখা দেখে তারা বলে উঠল, ‘এই ধরণের ফন্দি আরবেরা কখনই দেখে নাই।’
তারা বলল সেই সময় আবু বকর ছিলেন ডানে। আর যামা বিন আল আসোয়াদ মূর্তিপূজকদের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এদিকে ইয়াহিয়া বিন আল মুঘিরা বিন আবদ আল রাহমান তাঁর পিতার থেকে জেনে বললেন যে মূর্তিপূজকদের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল আল হারিস বিন হিশাম। আর তার দক্ষিণে ছিল হুবায়রা বিন আবি ওহাব। তার বামে ছিল যামা বিন আল আসোয়াদ। অন্য আরেকজন বলল যে দক্ষিণে ছিল আল হারিস বিন আমির আর বামে ছিল আমির বিন আবদ ওয়াদ। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৩০)
আবু মুরা ছিল আকিল বিন আবু তালেবের মুক্ত করা দাস। সায়ীদ বিন আবু হিন্দ আবু মুরার থেকে আমাকে বলল যে আবু তালেবের কন্যা উম হানি (উনি ছিলেন হুবায়রা বিন আবু ওহব আল মাখযুমির স্ত্রী) বলেছিলেন: ‘আল্লার রসূল যখন মক্কার উচ্চ প্রান্তে অবস্থান করছিলেন তখন আমার দুই দেবর যারা ছিল বানু মাখযুমি গোত্রের লোক তারা লুকিয়ে আমার গৃহে আসল। সেই সময় আলী আসলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে ঐ দুজনকে খুন করবেন। তাই আমি দুজনকে গৃহে আবদ্ধ করে দরজায় তালা মেরে আল্লার রসূলের কাছে গেলাম। সে সময় নবী এক গামলা থেকে পানি নিয়ে গোসল করছিলেন। ওই গামলায় মাখা ময়দার কিছু তালও দেখা যচ্ছিল। নবীর কন্যা ফাতেমা তাঁকে কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখছিলেন। নবী গোসল শেষ করে অঙ্গে কাপড় জড়িয়ে নিলেন। এরপর উনি ভোরের আট রাকাত নামাজ পড়লেন। তারপর নবী আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার আগমণের কারণ জানতে চাইলেন। আমি যখন ঐ দুই ব্যক্তির এবং আলীর ব্যাপারে জানালাম তখন নবী বললেন: ‘তুমি যাকে রক্ষা করতে চাও আমরাও তাকে রক্ষা করব। আর তুমি যাকে নিরাপত্তা দিবে আমরাও তাকে রক্ষা করব। আলী তাদেরকে খুন করতে পারবে না।’ (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৫৫১)
তারা বলল যে পৌত্তলিকেরা একের পর এক দৈনিক টহলের ব্যবস্থা করল। আবু সুফিয়ান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা একদিনের দায়িত্ব নিল। ঐ ভাবে টহল দিলেন হুবায়রা বিন আবি ওহব। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২২৯)
তাদের নেতারা একযোগে আক্রমণের জন্য পরিখার ধারে সমবেত হল। এই লক্ষ্যে আবু সুফিয়ান বিন হার্ব, ইকরিমা বিন আবু জহল, দিরার বিন খাত্তাব, খালিদ বিন আল ওলিদ, আমর বিন আল আস, হুবায়রা বিন আবি ওহব, নৌফল বিন আবদুল্লাহ আল মাখযুমি, আমর বিন আবদ, নৌফল বিন আবু মাবিয়া আল দিলি ছাড়াও আরও অনেকে এই উদ্দেশ্যে পরিখার তীরে ঘুরা ঘুরি করেত লাগল। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৩০)
ইকরিমা এবং হুবায়রা পালিয়ে গিয়ে আবু সুফিয়ানের সাথে যোগদান করল। আল যুবায়ের হুবায়রাকে আক্রমণ করে এবং তার অশ্বের পিছনে আঘাত করে। ফলে হুবায়রার অশ্বের পেটের নিচের বন্ধনী কেটে যায় এবং অশ্বের পিছনে যে বর্ম বাঁধা ছিল তা পড়ে যায়। আল যুবায়ের বর্মটি কুক্ষিগত করে নিলো। ইকরিমা বর্শা ফেলে চম্পট দিল। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৩১)
হুবায়রা বিন আবি ওহাব আল মাখযুমি হত্যা করেন সালাবা বিন ঘানামা বিন আদি বিন নাবী (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৪৩)
মুসলিমরা মক্কা দখল করার পর মুহাম্মদ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন, যার ফলে তারা কুরাইশ পৌত্তলিকদের আর তেমন হেনস্থা করল না। এই সময় আবদুল্লাহ বিন আবি রাবিয়া (অথবা যুবায়ের বিন আবদ ঊমাইয়া) এবং আল হারিস বিন হিশাম মাখযুমি গোত্রের এই দুই লোক যারা ইতিপূর্বে মুহাম্মদের খুজাদের উপর আক্রমণের নিন্দা করেছিল, তারা হুবায়রা বিন আবদ ওহবের গৃহে পলায়ন করে। হুবায়রার স্ত্রী ছিলেন আবু তালেবের কন্য। সেই সূত্রে এই মহিলা ছিলেন মুহাম্মদের চাচাত বোন। (ওয়াট, পৃঃ ৬৭)
হুবায়রা যখন দেখল যে তার পক্ষের সৈন্যরা পশ্চদাপসারণ করে যাচ্ছে তখন সে অত্যন্ত অসহায় বোধ করল। সেই সময় তার এক মিত্র তার নিজের বর্ম হুবায়রার গায়ে চাপিয়ে দিয়ে তাকে ঘাড়ে নিয়ে চলল। অন্যেরা বলে আবু দাউদ আল মাজনি তার তরবারি দ্বারা হুবায়রাকে আঘাত করে তার বর্ম কেটে ফেলে। হুবায়রা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। আবু দাউদ চলে যায়। তখন যুবায়ের আল জুশামির দুই পুত্র যাদের নাম আবু উসামা এবং মালিক তারা হুবায়রাকে চিনতে পারল। তারা ছিল হুবায়রার মিত্র। তারা হুবায়রার জীবন রক্ষা করল। আবু উসামা হুবায়রাকে ঘাড়ে নিয়ে নিলো আর মালিক তাকে প্রতিরোধ করল। নবী বললেন: “হুবায়রার দুই কুত্তা তাকে রক্ষা করল।” আবু উসামার বন্ধুত্ব ছিল তাল গাছের মতই দৃঢ়। আর এক জন বলল যে হুবায়রাকে যে আঘাত করেছিল তার নাম ছিল আল মুজাস্সার বিন দিয়াদ। (আল ওয়াকেদি, পৃঃ ৪৮)
Leave a Reply