ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশন। ভার্সিটি পড়ুয়া এক পরিচিত নিয়ে গেল। রামকৃষ্ণের জন্মতিথি উপলক্ষে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠান চলবে। সব ধোয়া-মোছা চলছে। গেট দিয়ে ঢুকেই বাম দিকে প্রাইমারি স্কুল। তার সামনে বিশাল দুটি বকুল ফুলের গাছ। স্কুলের সামনে গিয়ে আরেকটু বাম দিকে এগিয়ে গেলেই গাছ দুটির আড়ালে পূর্বদিকে দোতলা বিল্ডিং–নিচতলায় লাইব্রেরি; উপরের তলায় অডিটরিয়াম। অডিটরিয়ামের জড়ো হয়েছে চারুকলার কয়েকটি ছেলে। পরিচিতের পরিচিত। অনুষ্ঠানের মঞ্চ এবং অন্যান্য সাজসজ্জার দায়িত্ব এদের। একজন আঁকাআঁকি করে দিল, ওদের সাথে সেসব কাটাকাটিতে লেগে গেলাম।
এভাবে কয়েক রাতে কাজ মোটামুটি শেষ। অনুষ্ঠানের আগের রাতে মেইন গেট বন্ধ হলে রাতভর চলল পুরো পথ জুড়ে আলপনা আঁকার কাজ। এর মধ্যে এক ব্রহ্মচারীর সাথে পরিচয় হয়ে গেল। বয়স কম। তখনো মহারাজ হননি। আমাদের কাজে আর খুব আগ্রহ। কাজের সময় খোঁজ-খবর নেন, এটা সেটা জিজ্ঞেস করেন, গানবাজনা জানেন, বড় মহারাজের সাথে সাথে থাকেন বেশিরভাগ সময়। ধর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। যদিও কেন এই পথে এসেছেন, অনেক জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। জিজ্ঞেস করলে শুধুই হাসতেন। নাম-পরিচয় কিছুই বলতে চাননি। হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে বেশ ভালোই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল।
অনুষ্ঠানের সময়টাতেও কয়েকবার যাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বাউল গানের আসর বসলেই দৌড়ে যেতাম। চারুকলা, ভার্সিটি থেকেও অনেকে আসত। অনুষ্ঠান দেখতাম, আড্ডা হত। ওই ব্রহ্মচারী মহারাজের সাথে দেখা হলেই জোর করে ভিতরে নিয়ে প্রসাদ না খাইয়ে ছাড়তেন না।
এরপর থেকে মহারাজের সাথে দেখা হতেই চেচিয়ে বলতাম, মহারাজ প্রসাদ দেন। মহারাজ প্রসাদ দিতেন। একবার সেই সাথে কী মনে করে সত্যিজিতের “গণশত্রু” সিনেমার গল্প শুনিয়েছিলেন। মনে আছে সেদিনই স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে এই সিনেমার ভিডিও ক্যাসেট কিনে এনে ভিসিআর-এ দেখেছিলাম।–হঠাত জলবাহিত রোগের প্রকোপ। হাসপাতালে রোগী বাড়ছে, মারাও যাচ্ছে অনেকে। ডাক্তার ভেবে পাচ্ছেন না হঠাত এমন কেন হলো। তারপর জল পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন এটা ছড়াচ্ছে মন্দিরের “চরণামৃত” থেকে–সাধারণ মানুষের বিশ্বাস মন্দিরের যে চরণামৃত, তাতে তুলসিপাতা দিলেই শুদ্ধ এবং দেবতার আশীর্বাদে পবিত্র হয়ে যায়। একদিকে সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাস এবং ধর্মানুভূতি, অন্যদিকে মন্দিরকে কেন্দ্র করে ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মব্যবসা–ডাক্তার একা কিছু করতে পারলেন না!…যৌবনে সত্যজিতের ধর্ম পচিয়ে অনেক ম্যাসেজ আছে, আর এই সিনেমাটা তার শেষ বয়সের দিকের। বয়সের সাথে বিপ্লব যে শেষ হয়ে যায় নি, নিজে যে অনেকের মত পচে যাননি, তারই এক অনবদ্য চিত্রায়ণ “গণশত্রু”। জানি এ মুভি কাউকে আবার দেখতে বলার অপেক্ষায় রাখে না।
সেদিন প্রসাদ-প্রসাদ করার এত পাগলামি করার পরে মহারাজ এই গল্প কেন বলেছিলেন, সেটা পরে বুঝেছিলাম। তারপর থেকে আর প্রসাদ খেতে চাইনি, কোনোদিন খাইওনি। যদিও সত্যি সত্যি বলছি, প্রসাদ খেতে কিন্তু সাংঘাতিক লাগত।
এরকমই সাংঘাতিক লেগেছে বিগত কয়েকদিনে ইসকন নিয়ে বছর দুই আগে করা দুটি কোলাজে কিছু ছুপা হিন্দু ধর্মাবালদের মন্তব্য। ইসকনের আয়ের উৎস জিজ্ঞেস করতে অনেকেই মিউ মিউ করলেও পরের কমেন্টেই আবার চোরের মা’র বড় গলার মত করে বলছে, জানেন অনেক গরীব-দুখীরা শুধু ইসকনের কারণে তিনবেলা খেতে পারছে, গরীবদের জন্য এরা অনেক কিছু করছে…হেন তেন…। (শুধু শুধু কি আর বলি–হরে কৃষ্ণ হরে হরে, গাধারা সব ইসকন করে!) তো একজন বলল, স্টিভ জব পর্যন্ত ইসকনের প্রসাদ খেত (প্রমাণ হিসাবে ইসকনের লিঙ্কও দিল!) আর ঠিক তখনই বুঝলাম স্টিভ জবের ক্যান্সারটা কোথা থেকে হয়েছিল! 😉
(জাস্ট কিডিং, আমার কাছে প্রমাণ হিসেবে কোনো লিঙ্কটিঙ্ক নেই।)
Leave a Reply