মহাভারতে বর্ণিত সমুদ্রমন্থন অধ্যায়টা দিয়া শুরু করা যাক-
সমুদ্রমন্থনে বরুণদেবের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। বরুনদেব কে? হিন্দুধর্মের পানিসম্পদ-মন্ত্রী। বলা হইছে, বরুণদেবের ক্ষেত্র থিকা যে সূর্যের উদয় হয়। বরুনদেবের ক্ষেত্র কী? সিন্ধু…সিন্ধুনদ। [এখানে খিয়াল কৈরা, নদী না কিন্তু, নদ। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। খুব সম্ববত ভারতে পুরুষতন্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল এই সিন্ধুনদের নামকরণের মধ্যে দিয়া। আর এটা করেছিল তারা, যারা বাইরে থেকে এই সিন্ধুতীরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।] সূর্য্যের উদয় হয় পূর্বদিকে। তারমানে এই গোষ্ঠীটা তখন সিন্ধুর পশ্চিমতীরে অবস্থান করছিল। সেখান থেকেই দেখত সিন্ধুনদের ভিতর থেকে সূর্যদেব উদিত হচ্ছে।
এবার হিন্দুধর্মে বর্ণিত স্বর্গের দৃশ্যটা কল্পনা করুন। ইন্দ্রের রাজসভা, ঊঁচু এলাকা, পাহাড়-পর্বত ঘেরা, কাছাকাছি মেঘ উড়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে স্নো পড়ছে, প্রচুর ফলফলাদি… কাশ্মীরের সাথে মিল পান? এখনও কাশ্মীরকে ভূ-স্বর্গ বলা হয়। তখনকার দিনে এইটাই যে স্বর্গ ছিল না, কে বলতে পারে! মিলাতে থাকেন– ভব-সিন্ধু পার হয়ে স্বর্গে যেতে হয়। এই ভব-সিন্ধুই যে সিন্ধুনদ, আশা করি আর খুলে বলতে হবে না। আবার গরুর লেজ ধরে ভব-সিন্ধু পারি দিয়ে স্বর্গে যেতে হয়। সিন্ধুনদ পার হতে তখনকার দিনে গরুই ছিল একমাত্র ভরসা। এই গরুর সাথেই সাঁতরে পার হয়ে তারা এপাড়ে আসতে অর্থাৎ সিন্ধুর পূর্বতীরে আসতে পেরেছিল। গরুরে এত গুরুত্ব দিয়ে পূজা-অর্চ্চনা করার এটাও হয়তো একটা কারণ।
সিন্ধু পার হয়ে এপাড় এলেই যে এলাকা, সেটাই ছিল মর্ত্য। এখানেই সাধারণ মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল। আর শীর্ষস্থানীয় লোকজনেরা উত্তরের পার্বত্য এলাকায় উঠে গিয়ে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করল, দেবতা সেজে বসল, তাদের রাজা অর্থাৎ ইন্দ্রনামে একটা পদ সৃষ্টি করল, বাকিদের তাদের সামর্থ বা ভূমিকানুসারে বিভিন্ন মন্ত্রনালয় দেয়া হলো। মুনিঋষিরা চলে গেল পূর্ব্ব দিকের হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমালয়ের দিকের পাহাড়িয়া এলাকায়।
এবার আসি পাতালের কথা। পাতাল দিয়ে এরা হয়তো দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নভূমির কথা বুঝাত। আর সেখানে বসবাসকারী মানুষদের রাক্ষস, দৈত্য ইত্যাদি নামে ডাকত। এই পাতালের অর্থাৎ নিম্নভূমির রাক্ষস-দৈত্যরাই আবার উপরে উঠে এসে মাঝে মাঝে দেবতাদের হারিয়ে দিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল করত। আবার তাদের মধ্যে যুদ্ধ হত। যেমন রাবণ রাক্ষস মর্ত্য থেকে স্বর্গে এসে দেবতাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের ব্যাপারটা বোঝা গেল। এবার আসি নরকের ব্যাপারে। সিন্ধুর আরো পশ্চিমে গেলে মরুভূমি, খাবার-দাবার নেই, বসবাসের অযোগ্য, গরম… গরম থেকেই আগুন… নরকের বর্ণনার সাথে কেমন জানি মিল পাই। যারা সিন্ধু পার হয়ে এপাড় আসতে পারত না, বলা হত তারা কৃতকর্মের ফলে চিরকাল ঐ নরকেই (পশ্চিমপ্রান্তে) থাকত। হয়তো বসবাসের অযোগ্য কিংবা খাবার ফুরিয়ে যাবার জন্যই পশ্চিমপ্রান্ত ত্যাগ করে সিন্ধু পাড়ি দেয়ার দরকার হয়েছিল। আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল শীর্ষস্থানীয় দেবতারা। এপাড়ে কাশ্মীরে এসে এরাই হয়তো বড় বড় দেবতার পদগুলো পেয়েছিল। ইন্দ্রপদ যে পেয়েছিল, তার ভূমিকা যে অনেক বেশি ছিল, সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষায় রাখে না।
হিন্দুধর্মের পরের দিকের ধর্মগ্রন্থে নরকের অবস্থান অবশ্য পালটে যায়। সেখানে দেখা যায়, পাতাললোক এবং সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থানে নরকের অবস্থান। মাঝে বৈতরণী নামের ভয়ঙ্কর একটা নদী। বর্তমানে উড়িষ্যা রাজ্যে এই নদীর অবস্থান। এর একদিকে সাগর আর অন্যদিকে পাতাল অর্থাৎ ভারতের মধ্যাঞ্চল। আবার কর্মগুণে অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলে দক্ষিণ থেকে কেউ এই নদী পার হয়ে স্বর্গের দিকেও ধাবিত হতে পারত। যেমনটি হয়তো রাবণের বেলায় বলা হয়েছে।
==============================
বিঃদ্রঃ সেদিন সমুদ্রমন্থন নিয়ে ঘাটাঘাটি করে একটা পোস্ট দেয়ার পর রাতে যখন আবার এতসব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল, তখন হাসি থামাতে পারছিলাম না।
Leave a Reply