হজ্বের নাম করে আসলেও ধমাধমের হজ্ব কেমন হতে পারে, সেটা আশা করি আর খুলে বলতে হবে না। তবুও চেষ্টা করে দেখা যাক-
প্লেনে ওঠার আগে থেকেই জ্বর আসছিল। তবে প্রথম দিকে আশেপাশের লোকগুলোর চোখ-মুখে যে বেহেস্ত আর হুরপরীর লোভে চিকচিক করছিল, সেটা দেখে বেশ মজা লাগলেও পরের দিকে জ্বর বাড়তে থাকলে বিরক্ত লাগছিল, কারণ, একটা পর্যায়ে আর চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম বলে অনেক বিনোদন মিস করেছি। প্লেন থেকে নামার পরও শুনি রাত অনেকটাই বাকি।
হঠাত করে নতুন জায়গায় এলে ঘুম কম হয়। তবে এখানে এসে হয়তো শরীর খারাপের জন্যই বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কেটেছে। তারপর জ্বরটা যখন সেরে গেল, তখন সবাই বলছিল, আল্লা-নবীর দেশে এসে ক্রমাগত জমজমের পানি পানের ফলেই জ্বরটা তাড়াতাড়ি কমে গেছে। নইলে নাকি আরো ভোগা লাগত। হুম, সবই তার লীলা!
জুম্মার দিন সবার ছুটি। ঠিক হয়েছিল মক্কায় জুম্মার নামাজ পড়া দিয়ে আমাদের মক্কা ভ্রমণের শুভ উদ্বোধন করা হবে। তাই কাল সকাল সকাল বের হয়ে পড়লাম। একে তো জুম্মার দিন, তার উপর আবার হজ্বের সময়, তাই ভিড়টা অনেক বেশীই। সবাই নামাজ পড়ে নিল। আমি আর বোরখাওয়ালী একপাশে নামাজের ভান করে কোনরকম সময়টা কাটিয়ে দিলাম। ইচ্ছে ছিল উম্মে হানির ইয়েটা থুক্কু হাজরে আসোয়াদ মানে সেই কালো পাথরটা একটু কাছে থেকে দেখা আসার। ভিড় ঠেলে অনেকটাই কাছাকাছি গিয়ে গা ঘিনঘিন করে উঠল- শুধু চুম্মা না, সবাই পর্ণমুভির স্টাইলে একেবারে চেটেপুটে খেয়ে লালা বইয়ে দিচ্ছে। ফিরে আসার সময় বোরখাওয়ালী মনে করাই দিলো- গাজীপুরে যে গার্মেন্টে আগুন লেগে আবার শ্রমিক মারা গেল, সেই গার্মেন্টের নাম নাকি আসোয়াদ গার্মেন্ট। মজা আর কারে কয়! আস্তে আস্তে কইলাম- হ, সবই তার লীলা!
কিছু কিছু লোকদের দেখে মনে হলো এরা দিনরাতই এখানে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকে! সবাই হা করে কাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দেশে মন্দিরে গেলে সাধারণত এমন দৃশ্য চোখে পড়ে- বুড়া-বুড়িসহ অসংখ্য লোভী মানুষ দেবদেবী বা মন্দিরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকে ইহকাল আর পরকালের জন্য কত কিছুই না চেয়ে থাকে। মুসলমানদেরও মন্দির সদৃশ্য কাবা কিংবা মসজিদ আছে। হিন্দুদের সাথে পার্থক্য শুধু ভিতরে মূর্তি নাই।
তবে আল্লার মূর্তির ব্যাপারে এখানে এসেও কানাঘুষা শুনছি। নবী কাবার আর সব মূর্তি ভেঙে দিলেও আল্লাসহ তার তিন কন্যা আল্লাত, উজ্জা এবং মানাতের চারটা মূর্তি ভাঙেন নাই। তিন কন্যার মূর্তি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলেও আল্লার মূর্তি সরাতে সাহস করেন নাই। সেই মূর্তি এখনো কাবা ঘরের মধ্যে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা আছে যা বাইরের কাউকে দেখতে দেয়া হয় না। এ নিয়ে আমার শ্বশুরের বক্তব্য হলো, কি ছিল বা কি কি আছে, সেটা এখন আর বিবেচ্য নয়; আমাদের যা শিখানো হয়েছে, সেইটাই আসল এবং মেনে চলা উচিত। আমি নিশ্চিত কোন ইসলামি পারিবারিক আড্ডায় এসব নিয়ে কথা উঠলে সবাই এরকমই মনে করেন।
২.
২য় পর্বে- হেরাগুহা দর্শনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। তার আগে খানাপিনা করা হলো। কাবা থেকে জাবাল-আল নূর পর্বতে অবস্থিত হেরাগুহার অবস্থান উত্তর-পূর্ব কোণে। কাবা থেকে বের হয়ে গাড়িতে আগে উত্তরে অনেকটা এসে তারপর ডাইনে কিছুদূর গিয়ে আবার দক্ষিণে অনেকটা উঁচুতে হেরাগুহার পূর্বপ্রান্তে ভিজিটর এরিয়া। এ পর্যন্ত গাড়িতে আসা যায়। মক্কা থেকে হেরাগুহা ৪ কিলোমিটার বলা হলেও কাবাঘর থেকে সোজাসুজি দুরত্ব ৫ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু কাবা থেকে প্রায় ২০-২৫ মিনিট গাড়িতে করে যেভাবে নিয়ে যাওয়া হলো তাতে মনে হলো দুরত্ব কমসে কম ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার। গাড়ি থেকে নেমে পশ্চিমদিকের পাহাড়টাতেই হেরাগুহা। সেখানে দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য পাহাড় কেটে সিঁড়ির মত বানানো হয়েছে। একটা সাইনবোর্ডে চোখে পড়ল হেরার উচ্চতা ৫৬৫ মিটার।
সিঁড়ি দিয়ে এঁকেবেঁকে বেয়ে উঠতে লাগলাম। মাঝে মাঝে খাড়া জায়গাগুলোতে রেলিং-এর ব্যবস্থা আছে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য বসার ব্যবস্থাও আছে কয়েক জায়গায়। শ্বশুর বললেন, আগে এসব ব্যবস্থা ছিল না। এগুলা নতুন হয়েছে। তাই এখন আগের চেয়ে এখানে আসা অনেক সহজ। জায়গায় জায়গায় ভিক্ষুকদেরও দেখা মেলে- শুয়ে বসে ভিক্ষা করছে। বিশ্রাম নেয়ার জায়গাগুলোতে চা-পানির দোকানও আছে। দেখে মনে হলো পাকিরা চালাচ্ছে এগুলো। তবে ময়লা-আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট ব্যবস্থা দেখলাম না। পথে দু-পাশেই সবাই খালি বোতল এবং আবর্জনা ফেলে নোংরা করে রেখেছে। ব্যাপারটা চোখে লাগে।
উঠতে উঠতে বোরখাওয়ালীর সাথে হিসাব করলাম- পাহাড়িয়া হাঁটা পথ ধরে মক্কা থেকে এখনকার ৪ কিলোমিটার ১৪০০ বছর পূর্বে তখনকার দিনে দুর্গম পথে নিশ্চয়ই ৬ কিলোমিটারের কম হবে না। তারপর এতটা উঁচুতে উঠতে হত, ছিল না এমন সিঁড়ি। তাহলে এতটা পথ এসে কিভাবে মহাম্মদ একা একা এখানে মাসের পর মাস ধ্যানে মগ্ন থাকতেন আর খাদিজা নিয়মিত মক্কা থেকে এসে কিভাবে খাবার দিয়ে যেতেন- ব্যাপারটা ঠিক মেলে না।
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে পৌঁছে গেলাম হেরাগুহার কাছে। ভিতরে ছোট একটা রুমের মত জায়গা। কয়েকজন লোকের একসাথে বসার মত অবস্থা হবে। সেই পুরানো সন্দেহটা আবার মাথায় উঠে এলো। কোন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে হয়তো ইসলামের যাত্রা শুরু হয় নাই। কোরানের প্রথম দিকের আয়াতগুলো ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেও দেখা যায় একটা শক্তিশালী লুটেরা বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যের ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল যাদের কাজ হবে সমাজের সুদখোর মহাজন, বনিক আর ধনিক শ্রেণীর ধনসম্পদ লুট করে সমাজের সাম্য বজায় রাখা। আর সেই উদ্দেশ্যেই এই হেরাগুহায় হত গোপন মিটিং। আইডিয়া হয়তো শুধু মহাম্মদের নয়, আরো অনেকেরই হবে। সেই ভাবেই অন্যান্য গোত্রগুলোকে আক্রমণের আয়াত নাজিল করা হয়েছে, লুটের মাল, গণিমতের মালের হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে। সব সিদ্ধান্ত হয়েছে এই হেরাগুহায় বসে। আর খাদিজার ধন-সম্পদের ফলে মহাম্মদের ইমেজটা তুলনামূলক ভাবে বেশী প্রভাবশালী হওয়ায় পাবলিকলি তাকেই হাইলাইট করা হয়েছে বেশী। নেমে আসার সময়ও বোরখাওয়ালীর সাথে এসব সন্দেহ নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল।
৩.
রাতে খেয়ে দেয়ে রুমে এসে একা একা শুয়ে শুয়ে গুণগুণ করছিলাম- চুম্মা চুম্মা দে দে, চুম্মা চুম্মা দে দে চুম্মা… আর এসব নিয়ে কিছু লেখা যায় কিনা ভাবছিলাম…
একটু পর বোরখাওয়ালী কাজ শেষ করে রুমে আসতেই বললাম, ওখানে চুম্মা-চাটি তো হইলো না, এবার আসো দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই।
বোরখাওয়ালী মুচকি হেসে চোখ টিপে বলল, উলটা করে বলো…
Leave a Reply