লিখেছেন গোলাপ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০ > পর্ব ২১ > পর্ব ২২ > পর্ব ২৩ > পর্ব ২৪ > পর্ব ২৫ > পর্ব ২৬ > পর্ব ২৭ > পর্ব ২৮ > পর্ব ২৯ > পর্ব ৩০ > পর্ব ৩১
১০ই অক্টোবর, ৬৮০ সাল। ইরাকের ফোরাত (Euphrates) নদীর সন্নিকটে কারবালা প্রান্তরে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রাণপ্রিয় কনিষ্ঠ দৌহিত্র হুসেইন বিন আলী বিন আবু তালিব বিন আবদ আল মুত্তালিবের পরিবার সদস্য ও সহযাত্রীদের [প্রায় ৭২ জন যোদ্ধা] একের পর এক নৃশংস ভাবে খুন করেন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের সৈন্যরা। সেই যুদ্ধে ইমাম হুসেইনের পরিবারের সকল পরিবার সদস্য ও সহযাত্রীদের “পানি-বঞ্চিত অবস্থায়” প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায় তৃষ্ণার্ত ও পিপাসিত রাখা হয়েছিল। ছোট শিশু ও কিশোররাও এই নৃশংসতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ইয়াজিদের সৈন্যরা ফোরাত নদীর কিনারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য – ইমাম হুসেইনের লোকেরা যেন কোনোরূপেই ফোরাত নদীর পানি সংগ্রহ করে তাঁদের পিপাসা নিবৃত করতে না পারেন। পানির অপর নাম জীবন, পানি ছাড়া জীবন অচল! যুদ্ধে বিজয়ী হবার অমানবিক নৃশংস মোক্ষম কৌশল! বর্তমান পৃথিবীতে এমন একজন সুস্থ-মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্ক ইসলাম বিশ্বাসীকেও, বোধ করি, খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কারবালা প্রান্তরের সেই ভয়াবহ হৃদয়বিদারক ঘটনার উপাখ্যান কখনোই শোনেননি। কিন্তু পৃথিবীর ক’জন লোক জানেন যে, কারবালা যুদ্ধের সাড়ে ছাপ্পান্ন বছর পূর্বে, ৬২৪ সালের মার্চ মাসে, এই ইমাম হুসেইনেরই নানা স্বঘোষিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বদর অভিযানে অংশগ্রহণকারী কুরাইশদেরকে প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায় অনুরূপ পানি-বঞ্চিত, তৃষ্ণার্ত ও পিপাসিত রাখার কৌশলের গোড়াপত্তন করেছিলেন? মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ সাল), আল তাবারী (৮৩৯-৯২৩ সাল) ও মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (৭৮৪-৮৪৫ সাল) এর লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বদর অভিযানে “শত্রুপক্ষকে পানি-বঞ্চিত” করার যে অমানবিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তা ছিল নিম্নরূপ: [1]
কুরাইশদের পানি-বঞ্চিত করার কৌশল অবলম্বন:
‘কুরাইশরা তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে এবং উপত্যকার অন্য পাশের দূরবর্তী আল-আকানকিল পাহাড়ের পিছনে পৌঁছে যাত্রা বিরতি দেয়। উপত্যকার পাদদেশ (যাকে বলা হয় ইয়ালইয়াল) ছিল বদর ও বালুময় আল-আকানকিল পাহাড়ের মাঝখানে, যার পিছনে অবস্থান নিয়েছিল কুরাইশরা; যদিও বদরের কূপগুলি ছিল উপত্যকার মদিনা সন্নিকট অংশে। আল্লাহ বৃষ্টিবর্ষণ করেন, যার ফলে উপত্যকার নরম বালি হয় শক্ত, যা নবীর চলাচলে কোনোরূপ ব্যাঘাত ঘটায় না। কিন্তু কুরাইশদের চলাচলে তা সাংঘাতিক বাধা সৃষ্টি করে। তাই আল্লাহর নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে তাদের আগেই কূপের কাছে পৌঁছান এবং বদরের [মদিনার] নিকটবর্তী কুপগুলোর কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি দেন।
ইবনে হুমায়েদ < সালামাহ < মুহাম্মদ ইবনে ইশাক < বনি সালিমাহর কিছু লোক হইতে বর্ণিত:
আল-হুবাব বিন আল-মুনধির বিন আল-জামুহ বলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে এই স্থানটি বেছে নিয়েছেন, যার ফলে আমরা না পরবো সামনে অগ্রসর হতে অথবা পিছনে ফিরে যেতে; নাকি এটি একটি যুদ্ধকৌশল ও মতামতের বিষয়? নবী বললেন, “অবশ্যই নয়; এটি বিবেচনা ও মতামত যোগ্য যুদ্ধকৌশল”। তখন আল-হুবাব বিন আল-মুনধির বিন আল-জামুহ নবীকে বলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনার এই স্থানটি যথাযথ নয়। আপনি আপনার লোকজন সমেত উঠে দাঁড়ান এবং শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী কুপের কাছে যান। সেখানে যাত্রা বিরতি দিয়ে তার সামনের কুপগুলোকে ভরাট করুন। তারপর তার প্রায় পাশেই এক চৌবাচ্চা/জলাশয় নির্মাণ করে তা পানি ভর্তি করুন। এমতাবস্থায় আমরা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করব যেখানে আমাদের কাছে থাকবে পিপাসা নিবৃত্তের পর্যাপ্ত পানি, কিন্তু তারা থাকবে পানি-বঞ্চিত।” আল্লাহর নবী বললেন, “তোমার পরামর্শ সু-দূরদর্শী।”
তারপর আল্লাহর নবী ও তাঁর অনুসারীরা উঠে দাঁড়ালেন এবং শত্রুর সবচেয়ে কাছের কুপগুলির কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি দিলেন। তারপর তিনি অন্যান্য কুপগুলো ভরাট করার আদেশ জারী করলেন এবং তাঁরা যে কূপের কাছে যাত্রাবিরতি দিয়েছিলেন, তার প্রায় পাশেই এক চৌবাচ্চা/জলাশয় নির্মাণ করা হলো। তাতে পানি ভর্তি করা হলো এবং সেখান থেকে তাঁদের পানের পানির পাত্রগুলো তাঁরা ভর্তি করলেন।’ [2] [3] [4]
>>> বদর যুদ্ধে মুহাম্মদ ও তাঁর সহচরদের সেদিনের সেই নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন ১৪০ জন কুরাইশ। ৭০ জন কুরাইশকে নৃশংসভাবে করা হয় খুন ও ৭০ জনকে বন্দী। এই সেই ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার বিন আবু সুফিয়ান, যার দুইজন চাচা ও ছিলেন বদর প্রান্তে সেদিনের সেই হতভাগ্যদের তালিকায়।তাঁরা হলেন হানজালা বিন আবু সুফিয়ান এবং আমর বিন আবু সুফিয়ান। সেদিন বদর প্রান্তে মুহাম্মদ ও তাঁর সহচররা পানি-বঞ্চিত অবস্থায় প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায় আবু সুফিয়ান বিন হারব এর ছেলে হানজালা বিন আবু সুফিয়ানকে করেন খুন এবং আমর বিন আবু সুফিয়ানকে করেন বন্দী [বিস্তারিত আলোচনা করবো ‘লুণ্ঠন ও মুক্তিপণের আয়ে জীবিকা’ পর্বে]। আর, সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনার নায়ক স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর সাড়ে ছাপ্পান্ন বছর পর আবু-সুফিয়ান বিন হারব এর নাতি ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান কারবালা প্রান্তরে মুহাম্মদের নাতি হুসেইন বিন আলী ও তাঁর পরিবার এবং সহকারীদের একই কায়দায় তৃষ্ণার্ত-পিপাসিত অবস্থায় হত্যা করেন। ইসলামের ইতিহাস হলো রক্তাক্ত তরবারির ইতিহাস! যে ইতিহাসের গোড়াপত্তন করেছেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ও তাঁর সহকর্মীরা, যার বিস্তারিত বর্ণনা আগের চারটি পর্বে করা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এই বদর যুদ্ধে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা যে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তার আরও কিছু উদাহরণ:
আল-আসওয়াদ বিন আবদুল আসাদ আল-মাখযুমিকে হত্যা
‘ঝগড়াটে ও বদমেজাজি আল-আসওয়াদ বিন আবদুল আসাদ আল-মাখযুমি সম্মুখে অগ্রসর হন এবং বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি তাদের ঐ জলাশয় থেকে পানি পান করবো অথবা তা ধ্বংস করবো অথবা সেখানে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু বরণ করবো।”
হামজা বিন আবদ আল মুত্তালিব তাঁর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন এবং যখন তাঁরা একে অপরের সম্মুখীন হন, হামজা তাঁকে আঘাত করেন।
তিনি জলাশয়ে পৌঁছার আগেই হামজা তাঁর পা সহ ঠ্যাংয়ের অর্ধেক কেটে ফেলেন। তিনি ভূপাতিত হন এবং তার ঠ্যাং থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে তাঁর সহচরদের নিকটে গিয়ে পরে। তখন তিনি হামাগুড়ি দিয়ে জলাশয়ের দিকে যেতে থাকেন এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষার মানসে নিজেকে তিনি তার [জলাশয়] ভিতরে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু হামজা তাঁকে অনুসরণ করে সেই জলাশয়ের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করেন।’
ওতবা বিন রাবিয়া, তার ভাই সেইবা এবং ছেলে আল-ওয়ালিদকে খুন
‘আল-আসওয়াদ বিন আবদুল আসাদ আল-মাখযুমির পর ওতবা বিন রাবিয়া তাঁর ভাই সেইবা ও ছেলে আল-ওয়ালিদ কে তাঁর দুই পাশে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। যুদ্ধের স্থানে পৌঁছে তিনি একক দ্বন্দ্বযুদ্ধ আহ্বান করেন। আনসারদের মধ্য থেকে তিন ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন: হারিথের দুই ছেলে আউফ ও মুয়ায়িদ (তাঁদের মায়ের নাম ছিল আফরা) এবং আবদুল্লাহ বিন রাওয়া নামের অন্য এক ব্যক্তি।
কুরাইশরা বলেন, “তোমরা কে?”
তাঁরা উত্তর দেন, “আমরা আনসার দলের কিছু লোক।”
তখন সেই তিনজন কুরাইশ বলেন, “তোমাদের সাথে আমাদের কোনোই বিবাদ নেই।”
তারপর তাঁরা উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, “হে মুহাম্মদ! আমাদের বিপক্ষে আমাদেরই গোত্রের [কুরাইশ] কোনো ব্যক্তিকে পাঠাও।” আল্লাহর নবী বলেন, “হে ওবায়েদা বিন হারিথ, হামজা ও আলী উঠে এসো।” যখন তাঁরা উঠে সামনে এগিয়ে আসেন, কুরাইশরা বলেন, “কে তোমরা?” তাঁদের নামের ঘোষণা শোনার পর তাঁরা বলেন, “হ্যাঁ, এরাই হলো উচ্চ-বংশ এবং আমাদের সমকক্ষ।”
ওবায়েদা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক। তিনি ওতবা বিন রাবিয়ার, হামজা সেইবাহ বিন রাবিয়ার এবং আলী আল-ওয়ালিদ বিন ওতবার মুখামুখি হন। খুব শীঘ্রই হামজা সেইবাহকে এবং আলী আল-ওয়ালিদকে হত্যা করেন। ওবায়েদা এবং ওতবা একে অপরকে বার দুই আঘাত করে একে অপরকে ধরাশায়ী করেন। হামজা ও আলী তাঁদের তলোয়ার নিয়ে ওতবার দিকে ফিরে আসেন এবং তাঁকে সাবাড় [হত্যা] করে ওবায়েদা কে তাঁদের অনুসারীদের কাছে নিয়ে আসেন। তাঁর [ওবায়েদা] ঠ্যাং বিচ্ছিন্নভাবে কেটে গিয়েছিল এবং তা থেকে অস্থিমজ্জার ক্ষরণ হচ্ছিল।’ [5] [6]
>>> পাঠক, এই সেই ওতবা বিন রাবিয়া, যিনি চেয়েছিলেন মুহাম্মদ ও তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে না জড়াতে [পর্ব-৩১] । যিনি বদর প্রান্তে উপস্থিত কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যদি তোমরা তাদেরকে আক্রমণ করো, তোমরা সর্বদাই বিতৃষ্ণ চোখে প্রত্যেকেই প্রত্যেক সহচরদের দিকে তাকিয়ে দেখবে যে, তোমারই এক সহচর খুন করেছে তোমারই কোনো চাচাতো ভাইকে, কিংবা মামাতো ভাইকে বা আত্মীয়-স্বজনকে। সুতরাং ফিরে চলো এবং মুহাম্মদকে বাকি আরবদের হাতে ছেড়ে দাও।” এই সেই ওতবা বিন রাবিয়া, যার ছেলে আবু হুদেইফা বিন ওতবা মুহাম্মদের পক্ষপাতদুষ্ট আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছিলেন, “আমাদেরকে খুন করতে হবে আমাদের পিতাকে, পুত্রকে, ভাইকে এবং পরিবার-পরিজনদেরকে কিন্তু আব্বাসকে দিতে হবে ছেড়ে?”
নাখলা এবং নাখলা পূর্ববর্তী কোন অভিযানেই আনসাররা জড়িত ছিলেন না, শুধু মুহাজিররাই ঐ অপকর্মগুলো চালিয়েছিলেন। কিন্তু বদর অভিযানে আনসাররা ও মুহাজিরদের সাথে কুরাইশদের বিরুদ্ধে অনুরূপ লুট-তারাজে অংশগ্রহণ করেন। তা সত্ত্বেও কুরাইশরা আনসারদের সাথে কোনো সংঘর্ষ জড়াতে চাননি। তাঁরা আক্রমণ উদ্যত আনসারদের বলছেন, “তোমাদের সাথে আমাদের কোনোই বিবাদ নেই (We have nothing to do with you)”।
অর্থাৎ আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো – কুরাইশরা শুধু মুহাম্মদ ও তাঁর মক্কাবাসী সহচরদের বিরুদ্ধেই নয়, তাঁরা আনসারদের বিরুদ্ধে ও সংঘর্ষ ও খুন-খারাবীতে সম্পৃক্ত হতে চাননি।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ওতবা বিন রাবিয়া মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন একক দ্বন্দ্বযুদ্ধে। কিন্তু আলী ও হামজা তা লঙ্ঘন করে তাঁদের সহচর ওবায়েদার সহযোগী হয়ে ওতবা বিন রাবিয়াকে হত্যা করেন!
আবু আল বাখতারি (আল আস) বিন হিশাম কে খুন
‘আনসার বানু সালিম বিন আউফ গোত্রের মিত্র আল মুযাধধার বিন ধিয়াদ আল বালাওয়ি নামের এক ব্যক্তি আবু আল বাখতারি বিন হিশামের সাক্ষাৎ পান। আল মুযাধধার বিন ধিয়াদ তাঁকে বলেন যে, আল্লাহর নবী তাদেরকে বলেছেন, তারা যেন তাঁকে [আবু আল বাখতারি] হত্যা না করে। আবু আল বাখতারির সাথে ছিলেন তাঁর সহ-আরোহী (Rider) জুনাদা বিন মুলেইহা, যিনি তাঁরই সাথে মক্কা থেকে আগমন করেছিলেন। জুনাদা ছিলেন বানু লেইথ গোত্রের সদস্য এবং আবু আল বাখতারির পুরা নাম ছিল আল আস বিন হিশাম বিন আল হারিথ বিন আসাদ। তিনি [আবু আল বাখতারি] বলেন, “সে ক্ষেত্রে আমার বন্ধুর (সহ-আরোহী) কী হবে?” আল মুযাধধার বলেন, “না, আল্লাহর কসম। আমি তোমার সহ-আরোহীকে ছাড়বো না। আল্লাহর নবী শুধু তোমার ব্যাপারেই এই হুকুমটি দিয়েছেন।” তিনি [জবাবে] বলেন, “সেক্ষেত্রে, আমি তার সাথেই মরবো। মক্কার মেয়েরা যেন কখনোই বলতে না পারে যে, আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে আমার এক বন্ধুকে পরিত্যাগ করেছিলাম।” তিনি দৃঢ়কন্ঠে যুদ্ধ আহ্বান করেন। পরিণতিতে আল মুযাধধার তাঁকে করেন হত্যা। তারপর আল মুযাধধার নবীর কাছে যান এবং তাঁকে বলেন যে, তিনি আল বাখতারিকে বন্দী করে তাঁর কাছে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর যুদ্ধ-জেদের কারণে তাঁকে খুন হতে হয়েছে।’ [7][8]
>>> আবু আল বাখতারি ইচ্ছা করলেই অতি সহজে তাঁর জীবন বাঁচাতে পারতেন। তা না করে মৃত্যু অবধারিত জেনেও তিনি তাঁর সহ-আরোহীর সাথে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। সুতরাং আবারও সেই একই প্রশ্ন। কুরাইশদের অন্ধকার যুগের (আইয়্যামে জাহিলিয়াত) বাসিন্দা বলে ইসলাম বিশ্বাসীরা যে শতাব্দীর পর শতাব্দী তাচ্ছিল্য করে চলেছেন, তার কি কোনো সত্যতা আমরা দেখতে পাচ্ছি? আদি ইসলাম বিশ্বাসীদেরই ওপরে-বর্ণিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কি কুরাইশদের নিষ্ঠুর, অমানবিক, নীতিহীন, বিবেকবর্জিত অন্ধকার যুগের বাসিন্দা বলে আখ্যায়িত করা যায়? সত্য যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, তা আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই বর্ণনায় সুস্পষ্ট। এ ব্যাপারে যদি কোনো পাঠকের এখনও কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, তবে তাঁকে পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য একটু ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে।
উমাইয়া বিন খালাফ কে খুন
‘ইয়াহিয়া বিন আব্বাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আল জুবায়ের তাঁর পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে [মুহাম্মদ ইবনে ইশাক] যা বলেছেন, আবদুল্লাহ বিন আবু বকর এবং আরও অন্যান্যরা আবদ আল-রাহমান বিন আউফের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে সেই একই ঘটনা বর্ণনা করেছেন:
মক্কায় উমাইয়া বিন খালাফ আমার বন্ধু ছিল এবং আমার নাম ছিল আবদ আমর, কিন্তু মুসলমান হওয়ার পর আমাকে ডাকা হতো আবদ আল-রাহমান নামে। মক্কায় অবস্থানকালে যখন আমরা মিলিত হতাম, সে বলতো, “তুমি কি তোমার পিতা-মাতা প্রদত্ত নামকে অপছন্দ করো?” আমি বলতাম, “হ্যাঁ”; এবং সে বলতো, “আমার কথা হলো আমি আল-রাহমান জানি না, তাই এমন একটা নাম বেছে নাও, যে নামে আমরা নিজেদের আহ্বান করতে পারি। তোমার আসল নামে ডাকলে তুমি জবাব দাও না এবং আমি জানি না এমন নাম ব্যবহার করতে আমারও ইচ্ছা হয় না।” যখন সে ডাকতো, “এই আবদ আমর”, আমি তার জবাব দিতাম না। পরিশেষে আমি বলেছিলাম, “এই আবু আলী, তোমার যা ইচ্ছা, সে নামেই আমাকে ডেকো”; এবং সে আমাকে ডাকতো, “আবদ আল্লাহ” এবং আমি তার জন্য তাতেই সম্মত ছিলাম।
বদর যুদ্ধের দিন সে [উমাইয়া বিন খালাফ] তার ছেলে আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল এবং আমি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি একটা বর্ম-আবরণ (coats of mail) বহন করছিলাম, যেটা আমি লুণ্ঠন করেছিলাম। আমাকে দেখে সে বলে, “এই আবদ আমর”, আমি তার কোনোই জবাব দিইনি, যতক্ষণ না সে আমাকে “এই আবদ আল্লাহ” বলে ডাকে। তারপর সে বলে, “তোমার এই বর্ম-আবরণের চেয়ে আমি অনেক বেশি দামী, তুমি কি আমাকে বন্দী হিসাবে চাও না? আমি বলি, “আল্লাহর কসম, আমি চাই।” তাই আমি বর্ম-আবরণ ফেলে দিয়ে তার ও তার ছেলের হাত আঁকড়ে ধরি। তখন সে বলে, “আমি এমন দিন কখনোই দেখিনি। তুমি কি দুধ ব্যবহার করো না? (দুধ ব্যবহার বলতে সে বুঝিয়েছে যে দুগ্ধবতী উটের বিনিময়ে সে নিজেকে মুক্ত করাবে)।] আমি তাদের দু’জনকে নিয়ে হাঁটতে থাকি।
আবদ আল ওয়াহিদ বিন আবু আনু < সা’দ বিন ইবরাহিম < তার পিতা আবদ আল-রাহমান বিন আউফ হইতে বর্ণিত:
‘তাদের দু’জনের হাত আঁকড়ে ধরে যাওয়ার সময় উমাইয়া আমাকে বলে, “বুকে উটপাখির পালক পরিহিত ব্যক্তিটি কে?” যখন আমি তাকে বলি যে, সে হামজা, সে বলে, ঐ লোকটিই তাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেছে। আমি তাদের নেতৃত্ব নিয়ে যাবার সময় বেলাল তাকে আমার সাথে দেখতে পায়। উমাইয়া ছিল সেই লোক, যে মক্কায় বেলালকে নিপীড়ন করতো যেন সে [বেলাল] ইসলাম পরিত্যাগ করে। সে তাকে ঠা-ঠা সূর্যের তাপে নিয়ে আসতো, পিঠ-শোয়া করতো এবং বুকে বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখতো; এবং তাকে বলতো যে, যতক্ষণ সে মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ না করবে ততক্ষণ তাকে সেখানে থাকতে হবে। বেলাল বলতো, “এক! এক!” আমি বেলালকে দেখা মাত্র সে বলে, “শয়তান অবিশ্বাসী উমাইয়া বিন খালাফ! তাঁকে বাঁচিয়ে আমার স্বস্তি নাই (‘May I not live if he lives’)!” আমি বলি, “তুমি কি আমার বন্দীদের আক্রমণ করবে?” কিন্তু আমার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও বেলাল ঐ বাক্যগুলো বলতেই থাকে এবং পরিশেষে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলে, “হে আল্লাহর সাহায্যকারীরা, শয়তান অবিশ্বাসী উমাইয়া বিন খালাফ! তাঁকে বাঁচিয়ে আমার স্বস্তি নাই!” যেহেতু আমি তাদের রক্ষায় ছিলাম, লোকজন আমাদেরকে ঘিরে ধরে।
তারপর এক ব্যক্তি তলোয়ারের আঘাতে তার ছেলের পা কেটে ফেললে ছেলেটি পড়ে যায় এবং উমাইয়া এত জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, যা আমি কখনো শুনিনি। আমি তাকে বলি, “পালানোর চেষ্টা করো (যদিও তার পালাবার কোনো সুযোগই ছিল না), আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না।” তারা তলোয়ার দিয়ে তাদেরকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে যতক্ষণ না তাদের মৃত্যু হয়।
আবদ আল-রাহমান বলতেন, “আল্লাহ যেন বেলালকে দয়া করে। আমি আমার বর্ম-কোটটি খুইয়েছি এবং সে আমাকে বন্দী প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে।” [9][10]
>>> ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ক্রীতদাস বেলালের উপর মনিব উমাইয়া বিন খালাফের নৃশংস অত্যাচারের উপাখ্যান শোনেননি এমন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থমস্তিষ্ক ইসলাম বিশ্বাসী জগতে বিরল। এই উপাখ্যানের ফাঁকটি কোথায়, তার বিস্তারিত আলোচনা করবো “আইয়্যামে জাহিলিয়াত তত্ত্বে”। পাঠকরা যাতে বিভ্রান্ত না হন, তাই আপাতত সেই আলোচনাটি স্থগিত রেখে এই পর্বে বদর প্রান্তে উমাইয়া বিন খালাফ ও তাঁর ছেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার ওপরে-বর্ণিত ঘটনাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি। উক্ত বর্ণনার যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হলো – উমাইয়া বিন খালাফ তার ক্রীতদাস বেলালকে মক্কায় অবস্থানকালীন অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার করতেন। আর তারই প্রতিহিংসায়বেলাল ও তাঁর সহযোগী মুহাম্মদ অনুসারীরা উমাইয়া বিন খালাফ এবং তাঁর ছেলেকে বন্দী অবস্থায় তাঁদেরই একজন সহকারীর রক্ষা কবজ (protection) থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। এখন মুক্তমনা নিরপেক্ষ পাঠকদের কাছে আমার এক অতি সরল প্রশ্ন, “এখানে কে বেশী নৃশংস?মনিব উমাইয়া বিন খালাফ? যিনি অবাধ্যতার কারণে তাঁর ক্রীতদাসকে শাস্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু কাউকেই খুন করেননি; নাকি বেলাল ও তাঁর সহকারী মুহাম্মদ অনুসারী, যাঁরা তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে প্রাক্তন মনিব [বাবা] ও তাঁর ছেলেকে একই সাথে নৃশংসভাবে হত্যা করেন?” ভুললে চলবে না যে, মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা বদর প্রান্তে জড়ো হয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের মালামাল লুণ্ঠন (ডাকাতি) করতে, আর কুরাইশরা এসেছিলেন এই ডাকাতদের হাত থেকে তাদের মালামাল ও প্রিয়জনদের রক্ষা করতে।
আবু জেহেল কে খুন
‘ইবনে হুমায়েদ > সালামাহ < মুহাম্মদ ইবনে ইশাক < থায়র বিন জায়েদ <ইকরিমা < আব্বাস ও একই সাথে আবদুল্লাহ বিন আবু বকর হইতে বর্ণিত:
শত্রুদের সাবাড় করার পর আল্লাহর নবী নিহতদের মধ্য থেকে আবু জেহেলকে খোঁজার নির্দেশ জারি করেন এবং বলেন, “হে আল্লাহ, সে যেন তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে না পারে!” যে লোকটি সর্ব প্রথম আবু জেহেলকে দেখতে পান, তিনি হলেন সালামাহর ভাই মুয়াদ বিন আমর বিন আল-যুমাহ। তাঁদের বর্ণনা মতে তিনি [মুয়াদ বিন আমর] বলেছেন, “আমি শুনলাম, লোকেরা বলছে যে, আবু জেহেল ঝোপ (Thicket) বুঝে চলছে এবং তারা বলাবলি করছে, ‘আবু আল হাকামকে ধরা যাবে না।'” এটা শুনে আমি তাকে ধরার জন্য মনোনিবেশ করি। তাকে ঘা-মারার দূরত্বে পৌঁছে আমি তার উপর সজোরে আঘাত করি, এতে তার পা এবং ঠেং এর অর্ধেক ছিন্ন হয়ে ছিটকে পরে। সে ঘটনার তুলনা আমি শুধুই খেজুর গুঁড়া করার সময় খেজুর বিচি ছিটকে পরার সাথেই করতে পারি। তার ছেলে ইকরিমা আমার কাঁধে আঘাত করে এবং তাতে আমার বাহু কেটে যায়, ফলে সেটা আমার পাশে চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে এবং সে অবস্থায় আমি লড়াইয়ের প্রয়োজনে তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হই। কাটা হাতটাকে আমার পেছনে টেনে নিয়ে সারাদিন আমি যুদ্ধ করি এবং যখন তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে আমি আমার পা তার ওপর উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ না তা ছিন্ন হয়ে যায়।” মুয়াদ এই ঘা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং ওসমান বিন আফফানের খেলাফত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তারপর মুয়ায়িদ বিন আফরা আবু জেহেলকে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে আঘাত করতেই থাকেন, যতক্ষণ না আবু জেহেল নড়া-চড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় তিনি তাকে ফেলে আসেন। পরে ফিরে গিয়ে মুয়ায়িদ তাকে হত্যা করেন।
আল্লাহর নবী মৃতদের মধ্যে আবু জেহেলকে খুঁজে দেখার আদেশ জারি করার পর আবদুল্লাহ বিন মাসুদ আবু জেহেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি শুনেছি যে, আল্লাহর নবী তাঁদেরকে বলেছিলেন, “যদি তোমরা মৃতদের ভেতরে আবু জেহেলকে শনাক্ত করতে না পারো, তবে তার হাঁটুর দাগের খোঁজ করো। কারণ আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আবদ আল্লাহ বিন যুদানের দেয়া ভোজের দিন আমি তাকে ধাক্কা মেরেছিলাম। আমি তার চেয়ে একটু পাতলা ছিলাম। আমার ধাক্কায় সে তার হাঁটুর ওপর পড়ে যায় এবং তাতে তার এক হাঁটুতে এত গভীর খোঁচা লাগে যে তার দাগ কখনোই মিশে যায়নি।”
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ বলেন যে, তিনি আবু জেহেলের শেষ নিঃশ্বাসের সময় তাকে দেখতে পান এবং তাঁর পা তার [আবু জেহেলের] গর্দানের উপর ঠেসে ধরেন (কারণ সে মক্কায় তাকে একবার নখের আঘাত ও ঘুষি নিক্ষেপ করেছিল) এবং তাকে বলেন, “তুই আল্লাহর শত্রু। আল্লাহ তোকে কলঙ্কিত করেছে।” জবাবে সে বলে, “কীভাবে সে আমাকে কলঙ্কিত করেছে? তোরা যে মানুষদের খুন করেছিস, তাদের চেয়ে কি আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? বল্ তো, কে বিজয়ী হয়েছে?” আবদুল্লাহ তাকে বলেন যে, বিজয়ী হয়েছে আল্লাহ ও তার রসুল।
ইবনে হুমায়েদ < সালামাহ < মুহাম্মদ ইবনে ইশাক < বানু মাখযুম গোত্রের কিছু লোক বর্ণনা করেছেন যে:
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ বলতেন, “আবু জেহেল আমাকে বলেছে, ‘এই ছোট্ট মেষপালক, তোর বার বেড়েছে’। তারপর আমি তার কল্লা কেটে ফেলি এবং আল্লাহর নবীর কাছে তা নিয়ে এসে বলি, “এই সেই আল্লাহর শত্রু আবু জেহেলের মুণ্ডু।” তখন আল্লাহর নবী আমাকে বলেন, “আল্লাহর কসম, তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই, তাই না?” আমি বলি, “হ্যাঁ, এবং তার কল্লা আল্লাহর নবীর সামনে ছুড়ে মারি, তিনি আল্লাহ কে ধন্যবাদ জানান।”‘ [11] [12]
>>> কী নৃশংস বর্ণনা!
“আবদুল্লাহ বিন মাসুদ তাঁর পা আবু জেহেলের গর্দানের উপর ঠেসে ধরেন। তারপর, তাঁর কল্লা কেটে ফেলেন। তারপর, সেই সদ্য কাটা রক্তাক্ত ‘মুণ্ডু”-টা আল্লাহর নবীর কাছে নিয়ে আসেন। কাটা রক্তাক্ত ‘মুণ্ডু”-টা হাতে ধরে বলেন, ‘এই সেই আবু জেহেলের মুণ্ডু’। তারপর, কাটা রক্তাক্ত ‘মুণ্ডু” টা আল্লাহর নবীর সামনে ছুড়ে মারেন। আল্লাহর নবী আবদুল্লাহ বিন মাসুদকে ধন্যবাদ জানান।”
আর, সেই নৃশংসতার ন্যায্যতার সপক্ষে কী অদ্ভুত যৌক্তিকতা!
“কারণ, সে মক্কায় তাকে একবার নখের আঘাত ও ঘুষি নিক্ষেপ করেছিল!”
ইমাম বুখারির বর্ণনা: ভলিউম ৫, বই ৫৯, নম্বর ২৯৮
আবদুল্লাহ হইতে বর্ণিত:
বদর যুদ্ধের দিন উনি আবু জেহেলের সম্মুখীন হন, তখন আবু জেহেলের অন্তিম সময়। আবু জেহেল বলে, “আমাকে খুন করায় তোমার কোনোই গৌরব নেই, আর নিজের লোকদের হাতে খুন হয়ে আমি লজ্জিতও নই।”[13]
ইসলামী ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রতিটি ইসলাম বিশ্বাসী প্রকৃত ইতিহাস জেনে বা না জেনে ইতিহাসের এ সকল অমানবিক অধ্যায়গুলো যাবতীয় চতুরতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে এসেছেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় বাংলা অনুবাদের সাথে মূল ইংরেজি অনুবাদের অংশটিও সংযুক্ত করছি। – অনুবাদ, টাইটেল ও [**] যোগ – লেখক।]
Deprivation of water for the Quraysh:
‘Quraysh went on until they halted on the further bank of the wadi behind al-Aqanqal. The bed of the wadi (which is called Yalyal) lies between Badr and al-Aqanqil, the sand dune behind which were Quraysh, while the wells at Badr are on the bank of the Yalyal which is nearer to Medina. God had sent rain, which turned the soft sand of the wadi into a compact surface which did not hinder the apostle’s movements, but gravely restricted the movements of Quraysh. So the Messenger of God set out to get to the water before them, and when he got to the nearest well of Badr he halted.
According to Ibne Humayd <Salamah < Muhammad bin Ishaq <some men of Banu Salimah:
Al-Hubab b Al-Mundhir b al-Jamuh said, “O messenger of God, do you consider that this is a position in which God has placed you, and that it is not for us to move it forward or back, or do you consider that it is a matter of judgement, tactics and startagem?” He replied, “Certainly not; it is a matter judgement, tactics and stratagem.” Then Al-Hubab b Al-Mundhir b al-Jamuh said,
“O messenger of God, this is not the proper position for you. Arise with your men and go to the nearest well to the enemy. Halt there and then fill the other wells beyond it. Then build a cistern next to it and fill it with water. Then we will fight the enemy and have plenty of water to drink while they do not.” The Messenger of God said “You have given judicious advice.”
Then the messenger of God and the men who were with him arose and went to the well nearest to the enemy and halted there. Then he gave order to fill in the other wells, and to build a cistern next to the well at which he had halted. This was filled with water and then they drew water from it in their drinking vessels’. [2][3][4]
Killing of Al-Aswad b Abdu’l Asad al-Makhzumi:
‘Al-Aswad b Abdu’l Asad al-Makhzumi, who was a quarrelsome ill-natured man stepped forth and said, “I swear to God that I will drink from their cistern or destroy it or die before reaching it.” Hamza b Abd-Al Muttalib came forth against him, and when the two met, Hamza struck him and cut his foot together with half his leg before he had reached the cistern. He fell on his back with blood gushing from his leg toward his companions. Then he crawled toward the cistern and flung himself into it, intending to fulfill his oath; but Hamza followed him and smote him and killed him in the cistern’.
Killing of Utba bin Rabi’ah, his brother Shayba and his son al-Walid:
‘Then after him Utba bin Rabi’ah stepped forth between his brother Shayba and his son al-Walid b Utba. When he had drawn clear of the battle line, he issued a challenge to single combat. Three men from the Ansar came out against him: Auf and Muawwidh the sons of Harith (their mother was Afra) and another man called Abdullah b Rawaha.
The Quraysh said, “Who are you?” They answered, “Some of the Ansar,” where upon the three Quraysh said, “We have nothing to do with you.”
Then the herald of Quraysh shouted, “O’ Muhammad! Send forth against us our peers of our own tribe!” The apostle said, “Arise, O’ Ubayda b Harith, and arise O’ Hamza, and arise O’ Ali. When they arosed and approached them, the Quraysh said, “Who are you?” And having heard each declare his name, they said, “Yes, these are noble and our peers.” Now Ubayda was the eldest of them, and he faced Utba b Rabi’ah, while Hamza faced Shayba b Rabi’ah and Ali faced al-Walid b Utba. It was not long before Hamza slew Shayba and Ali slew al-Walid. Ubayda and Utba exchanged two blows with one another and each laid his enemy low. Then Hamza and Ali turned on Utba with their swords and finished him off and lifted up their companion Ubayda and brought him back to his companions. His leg had been cut off and the marror was oozing from it.’ [5][6]
Killing of Abu al Bakhtari (Al As) bin Hisham:
‘Abu al Bakhtari (Al As) bin Hisham was met by Al-Mujadhdhar b Dhiyad al-Balawi, an ally of the Ansar of the clan of Banu Salim b Auf. Al-Mujadhdhar b Dhiyad told him that the apostle had forbidden them to kill him. Abu Al-Baktari was accompanied by his fellow rider Junada b Mulayha, who had come wth him from Mecca. Junada was a member of the Banu Layth, and Abu Bakhtari’s full name was Al As b Hisham b al Harith b Asad. He replied, “What about my friend (fellow rider) here?” Al Mujadhdhar said, “No, by God. We will not spear your fellow rider. The messenger of God only gave us orders about you.” “In that case” he said, “I will die with him. The woman of Mecca shall not say that I forsook my friend to save my own life.” He insisted on fighting. The result was that al-Mujhadhdhar killed him. Then al Mujadhdhar went to the apostle and told him that he had done his best to take him prisoner and bring him to him, but that he had insisted on fighting and the result had been fatal to him.’ [7] [8]
Killing of Umaya bin Khalaf:
‘Yahaya b Abbad b Abdullah b al-Zubayr told me on the authority of his father; and Abdullah b Abu Bakr and others on the authority of Abd al Rahman b Auf told me the same saying:
Umayyya b Khalaf was a friend of mine in Mecca and my name was Abd Amr, but I was called Abd al-Rahman when I became a Muslim. When we used to meet in Mecca he would say, “Do you dislike the name your parents gave you?” I would say, “Yes,” and he would say, “As for me I do not know al-Rahman, so adapt a name which I can call you between ourselves. You won’t reply to your original name and I won’t use one that I don’t know.” When he said, “O’ Abd Amr” I would not answer him, and finally I said, “O’ Abu Ali, call me what you like,” and he called me, “Abd Allah” and I accepted the name from him.
On the day of Badr, I passed by him standing with his son Ali holding him by the hand. I was carrying coats of mail which I had looted; and when he saw me he said, “O’ Abd Amr”, but I would not answer until he said, “O’ Abd Allah.” Then he said, “Won’t you take me prisoner, for I am more valuable than these coats of mail which you have?” “By God, I will,” I said. So I threw away the mail and took him and his son by the hand while he said, “I never saw a day like this. Have you no use for milk?”(By ‘milk’ he meant, “I shall redeem myself from my captors with camels rich in milk.”) Then I walked off with the pair of them.
Abd al-Wahid b Abu Aun from Sa’d b Ibrahim from his father Abd Al-Rahman b Auf told me that the latter said: Umyya said to me as I walked between them holding their hands, “Who is that man who is wearing an ostrich feather on his breast?” When I told him it was Hamza he said that it was he who had done them so much damage.
As I was leading them away, Bilal saw him with me. Now it was Umayya he used to torture Bilal in Mecca to make him abandon Islam, bringing him out to the scorching heat of the sun, laying him on his back and putting a great stone on his chest, telling him that he could stay there until he gave up the religion of Muhammad, and Bilal kept saying, “One!One!” As soon as he saw him he said, “The arch-Infidel Umayya b Khalaf! May I not live if he lives.” I said, “Would you attack my prisoners?” But he kept crying out these words in spite of my remonstrances until finally he shouted at the top of his voice, “O’ God’s helpers, the arch-Infidel Umyayya b Khalaf! May I not live if he lives.” The people formed a ring round us as I was protecting him.
Then a man drew his sword and cut off his son’s foot so that he fell down and Umayya let out a cry such as I have never heard; and I said to him, “Make your escape (though he had no chance of escape), I can do nothing for you.” They hewed them to pieces with their swords until they were dead.
Abd Al-Rahman used to say, “God have mercy on Bilal. I lost my coats of mail and he deprived me of my prisoners.” [9][10]
Killing of Abu Jahl:
‘According to Ibn Humayd <Salamah <Muhammad Ibn Ishaq <Thawr b Zayd from Ikrima from Ibn Abbas: as well as Abd Allah b Abu bakr:
When the apostle had finished with the enemy he ordered that Abu Jahl should be looked for among the slain and said, “O’ God, let him not have escaped you!” The first man who encountered Abu jahl was Muadh b Amr b al-Jamuh, brother of Salamah, whom they reported as saying: “I heard the people saying when Abu Jahl was in a sort of thicket, ‘Abu al-Hakam can not be get at.’ When I heard that I made it my business and made for him.
When I got within a striking distance I fell upon him and fetched him a blow which severed his foot and half his leg flying. I can only compare it to a date stone flying from the pestone when it is beaten. His son Ikrima struck me on the shoulder and severed my arm and it hung by the skin from my side, and the battle compelled me to leave him. I fought the whole of the day dragging my arm behind me and when it became painful to me I put my foot on it and standing on it until I tore it off.” Muadh survived this wound and lived until the caliphate of Uthman b Affan.
Then Muawwidh b Afra passed Abu Jahl as he lay there helpless and struck him until he could no longer move, leaving him at his last gasp. Then Muawwidh faught him until he was killed. Abd Allah b Masud passed by Abu Jahl when the apostle had ordered that he was to be searched for among the slain. I have heard that the apostle had told them, “If you can not identify him among the dead, look for the mark of a wound on his knee, for I jostled against him at a feast given by Abd Allah b Judan when we were boys. I was little thinner than he was and I pushed him, so that he felt on his knees and got a scratch on one of them so deeply that the mark of which never went away.”
Abd Allah b Masud said that he found Abu Jahl at his last gasp and put his foot on his neck (for he had once clawed at him and punched him in Mecca) and said to him, “Has God put you to shame, you enemy of God?” He replied, “How has he shamed me? Am I anything more important than a man you have killed? Tell me, to whom is the victory?” Abdullah told him that it went in favor of God and his apostle.
According to Ibn Humayd <Salamh <Muhammd Ibn Ishaq <some men of Banu Makhzum assert that Ibne Masud used to say, “Abu Jahl said to me, ‘you have climbed high, you little shepherd’. Then I cut off his head and brought it the apostle saying, ‘This is the head of the enemy of God, Abu Jahl.’ Then the messenger of God said, “By God than whom there is no other, is it?’ ‘Yes’, I said and I threw his head before the apostle and he gave thanks to God.”’ [11] [12]
>>> ইসলামের ইতিহাসের আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, তৎকালীন ক্বাবা শরীফের মধ্যে ছিল ৩৬০ টি বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের দেব ও দেবী মূর্তি। সেই ক্বাবা শরীফের ভেতরে বসে সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষরা উপাসনা করতেন সহ-অবস্থানের মাধ্যমে। মক্কাবাসী কুরাইশরা কোনো বিশেষ ধর্ম ও বর্ণের মানুষদের “শুধু মাত্র ভিন্ন ধর্মমত অবলম্বন-পালন ও প্রচার”-এর কারণে কাউকে কখনো কোনো অবমাননা করছেন, এমন উদাহরণ ইতিহাসে নেই। তৎকালীন আরবে কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজের ধর্ম ও দেব-দেবীকে ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন ও দেব-দেবীর পূজা করলে মক্কাবাসী কুরাইশরা অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতি অত্যাচার করতেন, এমন উদাহরণ নেই। তৎকালীন আরবের কিছু কুরাইশ ছিলেন ধর্মান্তরিত একেশ্বরবাদী “হানিফ সম্প্রদায়”–এর সদস্য, যার মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদের ও কিছু পরিবার সদস্য। কিন্তু সে কারণে কোনো মক্কাবাসী কুরাইশ কিংবা তাঁদের কোনো পরিবার সদস্য তাঁদেরকে কোনোরূপ অবমাননা করেছেন বা অসম্মান করেছেন, এমন ইতিহাস কোথাও নেই। মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়ালিদ এর চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নওফল ছিলেন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান।মক্কাবাসী কোনো কুরাইশ কিংবা ওয়ারাকা বিন নওফল-এর কোন পরিবারের সদস্য ওয়ারাকাকে অবমাননা করতেন, এমন উদাহরণ কোথাও নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ওয়ারাকা বিন নওফল ছিলেন সম্ভ্রান্ত এবং কুরাইশদের অনেকেই যেতেন তাঁর কাছে ধর্ম-জ্ঞান শিক্ষা করতে। মুহাম্মদের কাছে সর্বপ্রথম কথিত ওহী আসার পর বিবি খাদিজা তাঁর এই চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নওফল এর কাছেই গিয়েছিলেন এর ব্যাখ্যা জানতে। [14]
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরম দৃষ্টান্তের অধিকারী সেই একই কুরাইশ জনপদ মুহাম্মদ এবং তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন! কেন? কেন তাঁরা মুহাম্মদ ও তাঁর ভাবাদর্শে আকৃষ্ট ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের প্রতি ছিলেন বিরক্ত? কেন তাঁরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন? এর জবাব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আদি মুসলিম ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো, মুহাম্মদ যতদিন শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর প্রচারণা চালিয়েছেন, ততদিন কুরাইশরা মুহম্মদের প্রচারণায় কোনোই বাধা সৃষ্টি করেননি। কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের ধর্মপ্রচারণায় তখনই বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তাঁরা কুরাইশদের ধর্ম ও পূজনীয় দেব-দেবীদের উপহাস এবং পূর্ব পুরুষদের “অবমাননা ও তাচ্ছিল্য” করা শুরু করেছিলেন।
মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের ওপর কুরাইশদের “যথেচ্ছ অকথ্য অত্যাচার” এবং তাঁদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করার পৌরাণিক উপাখ্যান গত ১৪০০ বছর যাবত পৃথিবীর সকল ইসলাম পণ্ডিত ও বিশ্বাসীরা উচ্চস্বরে প্রচার করে আসছেন! ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভর যোগ্য দলিল হলো কুরান। তাঁদের এই দাবির যে আদৌ কোনো সত্যতা নেই, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য হলো কুরান নিজেই। কুরাইশরা মুহাম্মদের কোনো অনুসারীকে খুন করেছেন, এমন একটি উদাহরণও মুহাম্মদের [আল্লাহ] বর্ণিত জীবনী গ্রন্থের [কুরান] কোথাও নেই। এমনকি, তাঁরা মুহাম্মদ কিংবা তাঁর কোনো অনুসারীকে কখনো কোনো “শারীরিক আঘাত” করেছেন,এমন একটি উদাহরণও নেই।
কিন্তু মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ যে মক্কাবাসী কুরাইশদের দেব-দেবী ও পূর্ব পুরুষদের প্রতি যথেচ্ছ অবমাননা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হুমকি, শাসানী ও ভীতি প্রদর্শন করতেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা কুরানের পাতায় পাতায় বর্ণিত আছে (বিস্তারিত ২৬ পর্বে)। কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর সহকারীদের সেই অবমাননা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সহ্য করেছেন সুদীর্ঘ ১২-১৩ বছর (৬১০-৬২২ সাল)। কুরান সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, কুরাইশরা নয়, মুহাম্মদ ও তাঁর সহকারীরাই ছিলেন আগ্রাসী, আক্রমণকারী, অবমাননাকারী ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকারী।
ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, কুরাইশরা বদর অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন রাতের অন্ধকারে তাঁদের বাণিজ্য-ফেরত কাফেলার ওপর মুহাম্মদ ও তাঁর সহচরদের পূর্ববর্তী আক্রমণাত্মক গর্হিত লুণ্ঠন কর্মের (ডাকাতি) হাত থেকে তাঁদের মালামাল রক্ষার্থে, মুহাম্মদ ও তাঁর সহচরদের হাতে তাঁদের পরিবার ও প্রিয়জনদের খুন অথবা বন্দিত্ব বরণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করতে (পর্ব ৩০)। মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চরম ক্ষতিগ্রস্ত (Victim) কুরাইশরা আবু জেহেলের পরামর্শে বদর প্রান্তে একত্রিত হয়েছিলেন মুহাম্মদ ও তাঁর মক্কাবাসী অনুসারীদের (মুহাজির) মোকাবিলা করতে। তাঁরা মোকাবিলা করতে এসেছেন ঐ লোকদের সাথে, যারা মক্কায় অবস্থানকালে সুদীর্ঘকাল তাঁদের ও তাঁদের দেব-দেবী ও পূর্ব-পুরুষদের করেছেন যথেচ্ছ তাচ্ছিল্য, হুমকি-শাসানী-ভীতি-অসম্মান ও দোষারোপ। তাঁরা মোকাবিলা করতে এসেছেন সেই লোকদের সাথে, যারা মদিনায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে [তাদেরকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি] এসেও তাঁদেরকে জ্বালাতন করা বন্ধ করেনি! শুরু করেছেন তাঁদের বাণিজ্য ফেরত মালামাল লুণ্ঠন, আরোহী, স্বজনদের খুন এবং সন্তানদের বন্দী করে নিয়ে এসে মুক্তিপণ দাবী [পর্ব-২৯]। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে কুরাইশদের অংশগ্রহণ ছিল নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ ও তাঁর সহকারীদের আগ্রাসী, নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা।তাই আবু সুফিয়ানের বুদ্ধিমত্তায় তাঁদের মালামাল ও প্রিয়জনরা রক্ষা পাওয়ার খবর পেয়ে আবু জেহেল ছাড়া বদর অভিযানে আগত প্রায় প্রতিটি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ মুহাম্মদ ও তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণাত্মক সংঘর্ষে অংশগ্রহণে রাজি ছিলেন না। (পর্ব-৩১)।
মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের [যাঁরা ছিলেন তাদেরই একান্ত পরিবার সদস্য, প্রতিবেশী বা বন্ধু-বান্ধব] প্রতি তাঁদের সেই সহনশীলতার উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি আদি মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই রচিত ইতিহাসে। কুরাইশদের এই মহানুভবতা, ধর্মান্তরিত স্বজনদের প্রতি তাঁদের ভালবাসা ও অনুকম্পার (Compassion) অকল্পনীয় চরম মূল্য তাঁদেরকে দিতে হয়েছিল এই বদর প্রান্তে! তাঁদের সেই মানবিক দুর্বলতার মূল্য যে কত করুণ ও হৃদয়বিদারক, তা তাঁরা চরম মূল্যের বিনিময়ে সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। ইতিপূর্বে তাঁরা ঘুণাক্ষরে কল্পনাও করতে পারেননি যে, মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ও তাঁর সহচররা কতটা নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর! মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের সেদিনের সেই নৃশংসতার প্রাণবন্ত (vivid) বর্ণনা আদি মুসলিম ঐতিহাসিকরা লিখে রেখেছেন মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থে। এ সকল বর্ণনার মাপকাঠিতে কুরাইশদেরকে নীতিহীন, অবিবেচক অন্ধকার যুগের [আইয়্যামে জাহিলিয়াত] বাসিন্দা আর মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদেরকে নীতিপরায়ণ, আলোকিত সম্প্রদায় রূপে আখ্যায়িত করার কোনই সুযোগ নেই। সত্য যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, তা বোঝা যায় অতি সহজেই।
(চলবে)
পাদটীকা ও তথ্যসূত্র:
[1] ক) “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ২৯৬-৩০৪ http://www.justislam.co.uk/images/Ibn%20Ishaq%20-%20Sirat%20Rasul%20Allah.pdf
খ) “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৭, ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-88706-344-6 [ISBN 0-88706-345-4 (pbk)],
পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩০৯-১৩৩১ http://books.google.com/books?id=efOFhaeNhAwC&printsec=frontcover&source=gbs_ge_summary_r&cad=0#v=onepage&q&f=false
গ) কিতাব আল-তাবাকাত আল-কাবির – লেখক: মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (৭৮৪-৮৪৫ খৃষ্টাব্দ)’, অনুবাদ এস মইনুল হক, প্রকাশক কিতাব ভবন, নয়া দিল্লি, সাল ২০০৯ (3rd Reprint), ISBN 81-7151-127-9 (set), ভলুউম ২, পার্ট- ১, পৃষ্ঠা ১৪ http://kitaabun.com/shopping3/product_info.php?products_id=4170
[2] Ibid আল-তাবারী- পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩০৯-১৩১০
[3] Ibid মুহাম্মদ ইবনে ইশাক – পৃষ্ঠা ২৯৬-২৯৮
[4] Ibid মুহাম্মদ ইবনে সা’দ – পৃষ্ঠা ১৪
[5] আল তাবারী – পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩১৭-১৩১৮
[6] মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ২৯৮-২৯৯
[7] মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২
[8] আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৪-১৩২৫
[9] মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০২-৩০৩
[10] আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৫-১৩২৭
[11] মুহাম্মদ ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৩০৪
[12] আল তাবারী -পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩২৯-১৩৩১
[13] সহি বুখারি: ভলিউম ৫, বই ৫৯, নম্বর ২৯৮
[14] খাদিজার পিতা ও ওয়ারাকার পিতা ছিলেন সহদর ভাই, তাঁদের দাদা ছিলেন আসাদ বিন আবদ উজ্জাহ। তাঁদের বড় দাদা [দাদার আব্বা] ছিলেন আবদ উজ্জাহ বিন কুছে বিন কিলাব; যিনি [আবদ উজ্জাহ] ছিলেন মুহাম্মদের দাদার [আবদ আল-মুত্তালিব] দাদা আবদ মানাফ [আরেক নাম-‘আল মুগিরাহ’] এর নিজের ভাই। অর্থাৎ, মাত্র চার পুরুষ আগে খদিজা, ওয়ারাকা ও মুহাম্মদের পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন একই পরিবার ভুক্ত।
Leave a Reply