লিখেছেন জসীম উদদীন
ধর্ম: ১. আভিধানিক অর্থে ধর্ম বলতে বস্তুর গুণ, বৈশিষ্ট্য, স্বভাব বোঝায়। যেমন, লবণের ধর্ম অম্লত্ব, আগুনের ধর্ম দহন ইত্যাদি। ২. দেব-দেবী উপাসনার পদ্ধতি।
কিন্তু উৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃত √ধৃ (ধারণা) এর সাথে ম (কর্তৃ) প্রত্যয় যোগে ধর্ম শব্দের সৃষ্টি। উৎপত্তিগত অর্থে ধর্ম শব্দের অর্থ হচ্ছে “যাহা ধারণা বা পোষণ করে।” অর্থাৎ একটি ধারণা। সেই সূত্রে বলা যায় ধর্ম একটি মত বা ধারণা। দর্শন যেমন একটি ধারণা বা মত।
নাস্তিক: আভিধানিক অর্থে নাস্তিক বলতে বোঝায় ১. নিরীশ্বরবাদী, ২. যে বা যারা বেদে অবিশ্বাস করে। এই অর্থে খ্রিষ্টান, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মসমূহ সহ অন্যান্য ব্যক্তিই নাস্তিক।
হিন্দু ধর্মের মনুসংহিতায় বলা আছে, “যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূল স্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতি) প্রধান্য অস্বীকার করে সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে তাকে সকল কর্তব্য, কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কার করা। কারণ সে ব্যক্তি কেবল বেদের নিন্দাকারী। অতএব নাস্তিক।” (২:১১)
সেই সময়ে নাস্তিকতার দুটি ধারা ছিল – চরমপন্থী ও নরমপন্থী নাস্তিক। চার্বাক সম্প্রদায় ছিল চরমপন্থী নাস্তিক আর বৌদ্ধ দর্শন ও জৈন ধর্ম ছিল নরমপন্থী নাস্তিক। চার্বাক সম্প্রদায় ছিল চরমপন্থী নাস্তিক ছিল, কারণ সম্ভবত তারাই প্রথম প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থেলিছের পূর্বে বলেছিল যে, প্রাণের উৎপত্তি জড় পদার্থ থেকে।
নাসারা: বাইবেলের নতুন নিয়ম বা ইজ্ঞিল শরীফে উল্লেখ আছে যে, গালীল প্রদেশের একটি গ্রাম নাসারা। রাজা হেরদ মারা যাবার পর দৈব আদেশক্রমে যীশু বা ঈসার পিতা শিশু যীশু ও তার মা ম্যারি বা মরিয়মকে নিয়ে মিশর থেকে ঐ গ্রামে যান। সেখানেই যীশু বেড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে ধর্ম প্রচার শুরু করে। ঐ গ্রামের অধিবাসীগণ যীশুর প্রচারিত বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং তৎকালীন ইহুদি ধর্মে অবিশ্বাসী ছিল বলে তৎসময়ের ইহুদি ধর্মীয় নেতারা তাদের নাসারা বলতেন অন্য ধর্মের বুঝানোর জন্য।
কাফের: ইসলামের মতে, যে ব্যক্তি ইসলাম বিশ্বাস করে না, সেই ব্যক্তিই কাফের। ইসলামের মতে হিন্দু, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ব্যক্তিই কাফের।
ধর্মে অবিশ্বাসকারীর কোনো একক ও সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। অনেকেই ধর্ম অবিশ্বাসকারীদের ধর্মদ্রোহী বলে থাকেন। এখন ধর্মদ্রোহী কথাটা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কেননা দ্রোহ শব্দের অর্থ শত্রুতা, অপরের অনিষ্ট চিন্তা করা। এখন যারা ধর্মমতে বিশ্বাসী নয়, আসলেই কি ধর্মমতে বিশ্বাসীদের বা ধর্মমতের কোনো অনিষ্ট করেছেন?
কোনো মত বা দার্শনিক মত গ্রহণের যেমন যুক্তি আছে, তেমনি তা বর্জনেরও যথেষ্ট কারণ আছে। যেমন বলা যেতে পারে যে, হেগেলের ভাববাদ ও হিন্দু মতের সাথে কেউ একমত নয় বিধায় সেগুলোকে বর্জন করা হল, ঠিক তেমনি কারোর কাছে কার্ল মার্কসের বস্তুবাদ ও বৌদ্ধ দর্শনকে যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে বিধায় তিনি তা গ্রহণ করছেন। এমনটা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু হচ্ছে না। সময়ের স্রোতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আজকে যা বর্তমান, আগামীতে তা অতীত। এটি স্বাভাভিক নিয়ম। ঠিক তেমনি কোনো মতে পূর্বে যদি অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত বা চিরন্তন এই ধরণের কথাগুলো যোগ করা হয়, স্বাভাভিকভাবেই তা সংঘাতের সৃষ্টি করে।
মানুষের বন্যদশায় অসহায় মানুষ যে হিংস্র পশু ও প্রকৃতির রুদ্র রূপ দেখেছে, তা থেকে নিজেকে এবং নিজের দলকে রক্ষার জন্য এক অদৃশ্য রক্ষাকর্তার কাছে বিনীত নিবেদন করেছে। যখন মানুষ আগুন আবিষ্কার করলো, তখন তারা ঐ আগুনকে রক্ষাকর্তা জ্ঞানে প্রার্থনা করতে লাগল, কেননা আগুন দিয়ে তারা হিংস্র পশু থেকে নিরাপদ ছিল। অর্থাৎ ভয়কে কেন্দ্র করেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়:
হায় রে নির্বোধ নর
কোথা তোর আছে ঘর
কোথা তোর স্থান।
শুধু তোর ঐ টুকু
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান।
Leave a Reply