হুমায়ুন আজদের ‘আমার অবিশ্বাস’ নামের বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম বেশ আগে। ধর্মকারী তখন স্থগিতাবস্থায়। কিন্তু কিছুদূর পড়ার পরে লক্ষ্য করলাম, বইটিতে উদ্ধৃতিযোগ্য ছত্রের ছড়াছড়ি। পড়া তখনই থামিয়ে দিয়ে স্থির করলাম, ধর্মকারী আবার সচল হলে ধর্মকারীর পাঠকদের (অনেকেরই বইটা পড়া আছে, জানি, তবুও…) সঙ্গে টাটকা পাঠমুগ্ধতা ভাগাভাগি করবো। তাই পড়তে শুরু করলাম আবার। বিসমিল্যা।
১১.
‘পবিত্র’ শব্দটিই নিরর্থক, এর কোনো সর্বজনীন তাৎপর্য নেই, একজনের কাছে যা পবিত্র আরেকজনের কাছে তা ঘৃণার বস্তু হ’তে পারে, সাধারণত হয়ে থাকে; যেমন উগ্র ধার্মিকের কাছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের সবকিছুই ঘৃণ্য।… আসলেই ‘পবিত্রতা’ নিরর্থক শব্দ; কোনোকিছু পরিচ্ছন্ন হতে পারে, পবিত্র হতে পারে না, পবিত্রতার কোনো বাস্তব রূপ নেই।
১২.
বিশ্বাসের কোনো শেষ নেই, এবং বিশ্বাসগুলো পরস্পরবিরোধী। এগুলোর একটি ধ্রুব হতে পারে, সবগুলো ধ্রুব হতে পারে না; কিন্তু এগুলোর প্রতিটিই এতো ত্রুটিপূর্ণ যে এগুলোর একটিকেও ধ্রুব মনে করতে পারি না।
১৩.
সাহিত্য প্রধানত অপবিশ্বাসের জগত; এখনো সাহিত্যে যে-প্রবণতা দেখতে পাই, তা অন্ধকারের প্রবণতা, ভুল ধারণা সৃষ্টির প্রবণতা। অজস্র বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ ক’রে সাহিত্য হয়ে আছে ভুলের এক বিশ্ব, যদিও তার সৌন্দর্য অশেষ। শুধু সত্যের নয়, মিথ্যেরও সুন্দর রূপ রয়েছে; অনেক সময় মিথ্যের রূপই বেশি সুন্দর সত্যের রূপের চেয়ে, তাই কবিরা ও নানা ধারার লেখকেরা মিথ্যের সৃষ্টি করেছেন সুন্দর রূপ।
১৪.
অধিকাংশ কবিই পরিবার ও সমাজ থেকে পাওয়া বিশ্বাস যাচাই করেন নি, যাচাই করার শক্তি নেই অনেকেরই, তারা ভেসে গেছেন আবেগে।
১৫.
বিশ্বজগতের রহস্যীকরণের কাজ রবীন্দ্রনাথ করেছেন বিচিত্ররূপে; এবং এ-কাজে তিনি একটি শব্দ বারবার ব্যবহার করেছেন, শব্দটি হচ্ছে সত্য। বিশ্ব রহস্যকরণে তার চাবিশব্দ সত্য, যখনই তিনি তাঁর বুঝতে-না-পারা পরম উপলব্ধি বা বিশ্বাসের কথা বলতে চেয়েছেন, যা সম্পর্কে তাঁর নিজেরই ধারণা অস্বচ্ছ, তখনই তিনি ব্যবহার করেছেন এ-শব্দটি; এবং অনুরাগীরা এক সুখকর বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করার স্বাদ পেয়েছেন। ‘সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ বা ‘সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে’ ইত্যাদি উক্তিতে কবিতা কম, বিভ্রান্তি বিপুল; তবে রহস্যীকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে, সত্য একরকম অলৌকিক সামগ্রী, এ বোধ তৈরি হয়েছে চমৎকারভাবে।
Leave a Reply