বাঙালীর আছে হাজার বছরের ঐতিহ্যর অহংকার। কিন্তু সময়ের দাবিতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে আসছে। আসুন জেনে নেই প্রাচীন বাংলার ফ্যাশন সংক্রান্ত কিছু তথ্য।
দশম-একাদশ শতকে বাংলাদেশ থেকে ছাত্ররা কাশ্মীরে যেতেন পড়ালেখার জন্য। কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্র এই ছাত্রদের চরিত্র অংকন করেছেন তার কিছু লেখায়। তার মতে এই ছাত্ররা ছিল রূঢ়, অমার্জিত, ছুঁৎমার্গী, কঙ্কালসার ক্ষীণ দেহ। ধাক্কা লেগে ভেঙে যাবে – এই ভয়তে সবাই এদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন। পরে কাশ্মীরি আবহাওয়ায় এদের স্বাস্থ্য ভালো হতো। তবে পড়াশুনায় উচ্চারণে খুব একটা ভালো না হলেও সমস্ত বিষয়েই এদের পড়া চাই।
এবার আসা যাক এদের চালচলনে। এরা পথ চলত ধীরে ধীরে এবং মাঝে মাঝে মাথাটা এদিক-সেদিক দোলাত। ময়ুরপঙ্খী জুতায় মচমচ শব্দ করে হাঁটত। গলায় থাকতে লাল মাফলার। গায়ের রঙ কালো আর সাদা দাঁতের জন্য চেহারা দেখতে ছিল বানরের মত। অল্পতেই রেগে গিয়ে ঝগড়া, এমনকি কারো পেটে ছুরি বসিয়ে দিতে জুড়ি মেলা ভার। গর্ব করে পরিচয় দেয় ঠক্কুর বা ঠাকুর বলে। কম দামে বেশি জিনিস চেয়ে দোকানদারদের উত্যক্ত করত।
এই ছিল মোটামুটি বিদেশে বাঙালী ছাত্রদের লাইফস্টাইল।
কাপড়-চোপড় ও পরার স্টাইল
আদি রীতি ছিল সেলাইবিহীন একবস্ত্র। সেলাই করে জামা-কাপড় উত্তর-পশ্চিম ভারত হতে আমদানি হয়। কিন্তু সেটা অনেক পরে। পুরুষেরা ধুতি, মেয়েরা শাড়ি। অবস্থা ভালো হলে গায়ের উপর একখণ্ড কাপড়ের ব্যবহার ছিল। এটা পুরুষের ক্ষেত্রে উত্তরীয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওড়না। এই ওড়না প্রয়োজনে ঘোমটার কাজ করত। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তে এক কাপড়ই যথেষ্ঠ ছিল এবং এরা প্রয়োজনে এর আঁচল দিয়েই ঘোমটার কাজ চালাত।
ধুতি এখনকার তুলনায় ছিল অনেক ছোটো। হাঁটুর উপর পর্যন্ত ছিল প্রস্থ। ধুতির মাঝখানটা কোমরে জড়িয়ে দুই প্রান্ত পিছনে টেনে কাছা দেয়া হত। নাভির নিচে অন্য এক টুকরা কাপড় দুই-তিন প্যাচে গিঁট দেয়া হত যাতে ধুতি খুলে না যায়। কেউ ধুতির এক প্রান্ত পিছনে নিয়ে কাছা দিত, অন্য প্রান্ত সামনে কোঁচার মত ঝুলিয়ে দিত। নারীরাও প্রায় একই ভাবে কাপড় পরত। তবে কাপড় ছিল পায়ের কব্জি পর্যন্ত ঝোলানো। প্রায় পুরা কাপড়টা কোমরে পেচিয়ে নিত। কাছা দিত না। আঁচল দিয়ে দেহের উপরের অংশ ঢাকার ব্যাপার ছিল না। তবে উচ্চস্তরের অনেক মেয়েরা ওড়না দিয়ে বুক ঢেকে রাখত। পরে উত্তম-পশ্চিম ভারতের আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রেরণায় কেউ কেউ উত্তরী বা চোলি দিয়ে বুক বেঁধে রাখত।
৭ম ও ৮ম শতকের দিকে কাপড়ে ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির নকশার প্রচলন হয়, যা পশ্চিম ভারত থেকে আসে।
বিশেষ উপলক্ষে বিশেষ পোষাকের ব্যবস্থা তখনো ছিল। নর্তকীরা কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আঁটসাঁট পাজামা, আর গলায় বড় একটা ওড়না ব্যবহার করত।
সাধু-সন্ন্যাসী ও দরিদ্র শ্রমিকেরা পরত ন্যাঙ্গোটি।
সৈন্য ও মল্লবীররা হাঁটু পর্যন্ত আঁট পাজামা।
শিশুরা পরত হাঁটু পর্যন্ত ধুতি নয়তো আঁট পাজামা।
চুলের স্টাইল
বাঙালীরা কোনো কালেই মাথায় কোনো আবরণ দেন নাই। ছিল লম্বা বাবরী চুল; কোঁকড়া কোঁকড়া চুল কাধের উপর থোকায় থোকায় ঝুলত। কেউ কেউ আবার মাথার উপর প্যাচানো ঝুঁটি রাখত। মেয়েদেরও লম্বা চুল; ঘাড়ের উপর খোঁপা করে বাঁধা। কেউ কেউ পিছনে এলিয়ে দিত।
সাধু-সন্নাসীদের লম্বা জটা দুই ধাপে মাথার উপর জড়ানো থাকত।
শিশুদের চুল তিনটি ‘কাকপক্ষ’ গুচ্ছে মাথার উপর বাঁধা থাকত।
সৈন্য ও প্রহরীরা ফিতাবিহীন, পায়ের কন্ঠা পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার জুটা পড়ত। সাধারণ লোকেরা জুতা ব্যবহার করত না। ধনীরা কাঠের পাদুকা ব্যবহার করত।
প্রসাধন
বিবাহিত নারীরা কপালে কাজলের টিপ, সিঁথিতে ও ঠোঁটে সিঁদুর, পায়ে লাক্ষারস, দেহ ও মুখে চন্দনের গুড়া ও চন্দন বাঁটা এবং জাফরান ব্যবহার করত। পুরুষেরা হাতের নখ বড় রাখত এবং নখে রঙ লাগাত; মেয়েরা লাগাত কিনা জানা যায় না। তবে বিলাসিনীরা ঠোঁটে লাক্ষারস ও খোঁপায় ফুল গুঁজে দিত। অনেকে গলায় ফুলের মালা দিত। অনেক সময় বুকের কাপড় সরে গেলে ফুলের মালা দিয়ে বুক ঢেকে লজ্জা নিবারণ করত। উচ্চসমাজের বিবাহিতা নারীরা সন্ধ্যায় স্নান করে প্রসাধন ও অলংকার দিয়ে খুব সাজত।
বারাঙ্গনারা দেহে পাতলা কাপড় পড়ত, বাহুতে সোনার বাজু, সুগন্ধি তেল দিয়ে চুল চূড়া করে বেঁধে তাতে ফুলের মালা জড়িয়ে নিত। কানে পড়ত কচি তালপাতার দুল।
গ্রামের মেয়েরা আবার নগরের মেয়েদের সাজসজ্জা পছন্দ করত না। নগরের মেয়েরা বাঁকা ভাবে পা ফেলে কোমর দুলিয়ে হাঁটত আর সেটা গ্রামের মেয়েরা যদি নকল করার চেষ্টা করত তাহলে শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। তাদের বলা হত সোজা পা ফেলে চলতে। এরাও কপালে কাজলের টিপ পরত, বিবাহিতারা হাতে দিত শঙ্খের সাদা বালা, কানে কচি রীঠাফুলের দুল, চুলে তেল। পুরুষেরা মাঠে আর মেয়েরা সংসারের হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে সব কাজ করত।
সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম কাপড়ের জন্য বাংলাদেশ ছিল বিখ্যাত। তবে এসব ছিল উচ্চবিত্তের জন্য। সারারণ দরিদ্রের কপালে জুটত মোটা ছিন্ন ও জীর্ণ কার্পাস কাপড়।
তথ্যসূত্রঃ “বাঙালীর ইতিহাস – আদি পর্ব” – নীহার রঞ্জন রায়।
========================
কৃতজ্ঞতা: পোস্টটি প্রথম আলো ব্লগ থেকে অনেক আগে রেফারেন্স হিসাবে নোটপ্যাডে সেভ করে রেখেছিলাম। ব্লগারের নাম মনে হয়। ব্লগে এবং গুগলে সার্চ করেও সেই পোস্টটি আর পেলাম না। তবে অন্য দুইটা সাইটে এই লেখাটা কিছুটা রিরাইট করে লেখা হয়েছে দেখলাম, সেখানেও সেই ব্লগারের নাম উল্লেখ করা নাই।
Leave a Reply