লিখেছেন অর্ণব খান
একটি রংধনুতে ঠিক কোন পয়েন্টে লাল আর কমলা রং আলাদা হয়েছে, খুব উন্নত মানের মাইক্রোস্কোপের সাহায্য ছাড়া তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব না, কারণ সেখানে কমলা-লালের মিশ্রণে একটি শেড তৈরি হয়, হুট করে কমলা থেকে লাল হয়ে যায় না। বিবর্তন তত্ত্বেও একটি প্রজাতি থেকে হুট করে অন্য আরেকটি প্রজাতি উদ্ভূত হয়ে যায় না, বরং কমলা-লাল শেডের মতই খুব সূক্ষ্ম পার্থক্য বিশিষ্ট অনেকগুলো মধ্যবর্তী ধাপ পেরিয়ে একটি থেকে আরেকটি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব হয়। তাই “হঠাৎ করে একটি প্রাণীর দেহে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু এলো কোথা থেকে?”- এই ধরনের প্রশ্ন বিবর্তন তত্ত্বে অবান্তর।
শুক্রানু আর ডিম্বানুর সূচনা নিয়ে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা অযথাই জল ঘোলা করে বলে থাকে যে, বিবর্তন তত্ত্ব নাকি এটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ কথা সত্য যে, যৌনতার আবির্ভাব বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু তাই বলে এটা ব্যাখ্যা করা যায় না, একথা সম্পূর্ণ ভুল। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে একই প্রজাতিতে নারী-পুরুষ দু’টি জাত থাকার ব্যাপারটি খুব অসাধারণ লাগতে পারে, তবে প্রাণীবৈচিত্র্যের দিকে ভাল করে তাকালে এটি আর এত চমৎকৃত থাকে না। যেমন পৃথিবীর সিংহভাগ প্রজাতি বা প্রাণীতেই নারী-পুরুষ বলে আলাদা কোনো জাত নেই। আবার কয়েক প্রজাতির শামুক ও কেঁচো, বেশিরভাগ প্রজাতির কৃমি ও মোলাস্ক পর্বের জীব এবং কিছু গিরগিটি জাতীয় প্রাণীতে একসাথে একই দেহে পুং এবং স্ত্রী জননকোষ থাকে। এদিকে স্লাইম মোল্ড প্রজাতির জীবে শুধু নারী-পুরুষ এ দুটো জেন্ডার নয়, বরং ৫০০ এর অধিক জেন্ডার বিদ্যমান। আবার এক প্রজাতির আফ্রিকান ব্যাঙ পরিস্থিতি অনুযায়ী নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারীতে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে এতসব বৈচিত্র্যের ভীড়ে নারী-পুরুষ জাতের আবির্ভাব মোটেই অলৌকিক, অবাস্তব বা ব্যাখ্যাতীত কিছু নয়। জেনেটিক্স-এর দিক থেকে দেখলে বরং তা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক মনে হয়। নারী আর পুরুষের মাঝে পার্থক্য শুধুমাত্র ছোট্ট একটি ক্রোমোজোমে। পুরুষের সেই ছোট্ট ওয়াই ক্রোমোজোমটিও আবার নারীর এক্স ক্রোমোজোম থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। হরমোনের প্রভাবে নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারী হয়ে যাবার মত ঘটনাও প্রচুর ঘটতে দেখা যায়।
এসব নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর সূচনা হল কীভাবে? হঠাৎ করে যে হওয়া সম্ভব না, সেটা আগেই বলা হয়েছে, বরং এদের বিবর্তন হয়েছে পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে। এই ব্যাপারটি বুঝতে হলে আগে যৌনতা তথা শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মূল ব্যাপারটা জানতে হবে।
সমস্ত দেহকোষে দুই সেট জিন থাকে, কিন্তু শুক্রাণু আর ডিম্বাণু কোষে মাত্র এক সেট জিন থাকে। যৌন জননকারী প্রাণীকুলে চক্রাকারে ১ সেট জিন থেকে ২ সেট জিন তারপর ২ সেট জিন থেকে ১ সেট জিন তৈরি হওয়ার ব্যাপারটি ঘটতে থাকে। যেমন প্রাণীকুলের শুক্রাশয়/ডিম্বাশয়ে প্রথমে ২ সেট জিন সমৃদ্ধ কোষ থেকে ১ সেট জিন সমৃদ্ধ শুক্রাণু/ডিম্বাণু তৈরি হয়, পরে মায়ের গর্ভে এই ১ সেট জিন সমৃদ্ধ শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে ২ সেট জিন সমৃদ্ধ জাইগোট তৈরি হয়, যা বড় হয়ে নতুন শিশুর জন্ম হয়। ১ সেট জিন সমৃদ্ধ অযৌন জননকারী জীবের ক্ষেত্রে এই চক্র থাকার কথা নয়, তবুও এই চক্র থাকতে পারে, যার এভিডেন্স প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এককোষী জীবে বিদ্যমান। এই চক্রের আবির্ভাব ও টিকে থাকার কারণ হচ্ছে দু’টি এককোষী জীবের মাঝে জিন আদান-প্রদানের ঘটনা এবং ডুপ্লিকেট জিন সেটের উপস্থিতির সুবাদে ক্ষতিকর মিউটেশনের কুপ্রভাব থেকে সুরক্ষা। সহজ কথায় বলা যায়: মিউটেশন প্রক্রিয়ায় এক পর্যায়ে জিন যথেষ্ট পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ অবস্থায় কোনো একটি এককোষী জীবের জিন অপর একটি এককোষী জীবের জিনের সংস্পর্শে আসে, এতে এককোষী জীবটি ২ সেট জিন সমৃদ্ধ হয়। তারপর এককোষী জীবটি বিভাজিত হয়ে পূর্বের মত আবার ১ সেট জিন সমৃদ্ধ জীবে পরিণত হয়। তবে ২ সেট জিন থাকা সুবিধাজনক হওয়ায় এককোষী জীবটি ২ সেট জিন বনাম ১ সেট জিনের এক চক্র তৈরি করে ফেলে। এই চক্রের উদ্ভবই ছিল শুক্রাণু-ডিম্বাণুর সূচনা। ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়, প্রায় ১২০০ মিলিয়ন বছর আগে এককোষী এক প্রাণীতে প্রথম এই চক্রের সূচনা ঘটে।
এবার ধাপে ধাপে কীভাবে এই সূচনা থেকে পূর্নাংগ শুক্রানু-ডিম্বানু তৈরি হয়েছে, তা প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এভিডেন্সের ভিত্তিতেই আলোচনা করা যাক।
প্রথম ধাপে অযৌন জননকারী দুটি এককোষী জীব তাদের মাঝে জিন আদান প্রদান করা শুরু করে, যেমনটি এখনো ব্যাকটেরিয়ারা করে থাকে।
দ্বিতীয় ধাপে এককোষী জীবে ১ সেট ও ২ সেট জিনের চক্রটির উদ্ভব হয় এবং ফলশ্রুতিতে যৌনমিলন ছাড়াই যৌনপ্রজনন শুরু হয়, যেমনটি এখনো অ্যামিবার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে দুটি অ্যামিবা একটি করে স্পোর নির্গমন করে পরে স্পোর দুটি মিলিত হয়ে একটি নতুন অ্যামিবার জন্ম হয়। এই অ্যামিবাগুলোর মাঝে নারী-পুরুষ কোনো জাত নেই, কারণ সবগুলোই একই রকম ১ সেট জিন সমৃদ্ধ স্পোর তথা জননকোষ নির্গমন করে।
তৃতীয় ধাপে এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণীর বিবর্তন ঘটে এবং যৌনমিলন ছাড়াই যৌনপ্রজনন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, ঠিক যেমন বহুকোষী ফাঙ্গাস স্পোর নির্গমণের মাধ্যমে যৌনমিলন ছাড়াই যৌনপ্রজনন করে।
চতুর্থ ধাপে জীবের দৈহিক গঠনে পরিবর্তন না এসে শুধুমাত্র জনন কোষে পরিবর্তন আসে অর্থাৎ নারী ও পুরুষ আলাদা না হয়ে একই দেহে শুধুমাত্র স্পোর থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের শুক্রাণু আর ডিম্বাণু তৈরি হওয়া শুরু হয়, ঠিক যেমন বর্তমান সময়ের একই শামুকের দেহে ভিন্ন বৈশিষ্টের শুক্রানু আর ডিম্বানু তৈরি হয়।
একই বৈশিষ্ট্যের জননকোষ বা স্পোর থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের শুক্রাণু-ডিম্বাণুতে রূপান্তর প্রক্রিয়াটিও খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মিউটেশনের কারণে কিছু জনন কোষ বা স্পোর আকারে একটু বড় হয়ে যায়, আর সে কারণে সেগুলো বেশি পুষ্টি জমা করার সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। এই পরিস্থিতে ছোট জননকোষ বা স্পোরগুলো আরও ছোট হয়ে গিয়ে বড় কোষ থেকে খাদ্যপ্রাপ্তির সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। এভাবে ছোট কোষগুলো আরও ছোট আর চলনক্ষম হয়, কারণ বড় কোষ থেকে খাদ্য পেতে হলে অন্য ছোট কোষের সাথে প্রতিযোগিতা করে চলতে হয়। আর বড় কোষগুলো আরও বড় আর চলন-অক্ষম হয়, কারণ ছোট কোষগুলোর নিয়মিত ধাক্কায় তাদের চলনের সুযোগ বা প্রয়োজন হয় না। এই ছোট আর বড় কোষগুলোই শুক্রাণু আর ডিম্বাণুতে পরিণত হয় এবং এরা একই সাথে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবর্তিত হয় বা আলাদা হয়।
জননকোষ আলাদা হবার পর এবার পঞ্চম ও শেষ ধাপে প্রাণীর জননাঙ্গ তথা শারীরিক বৈশিষ্ট্যও আলাদা হতে শুরু করে অর্থাৎ প্রাণী শারীরিকভাবে নারী ও পুরুষ হতে শুরু করে ঠিক যেমন প্রকৃতিতে এখনো বহু প্রাণী জিনগত সাহায্য ছাড়াই শুধু হরমোন, খাদ্য, তাপমাত্রা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক অনুঘটকের প্রভাবে জন্মেরও অনেক পরে নারী বা পুরুষে রুপান্তরিত হয়। এভাবে শামুকের মত একই দেহে শুক্রানু-ডিম্বানু থাকার বদলে আফ্রিকান ব্যাঙ-এর মত শুক্রাণুর জন্য পুরুষ আর ডিম্বাণুর জন্য নারী দেহের বিবর্তন হয়। প্রকৃতপক্ষে মানবভ্রূণও শামুকের মত একই শরীরে শুক্রাণু আর ডিম্বাণু তৈরির তথ্য সমৃদ্ধ থাকে তবে ওয়াই ক্রোমোজোমের প্রভাবের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে মানব ভ্রূণ আফ্রিকান ব্যাঙ-এর মতই পুরুষ বা নারী দেহে রূপান্তরিত হয়।
ওপরোক্ত ধাপগুলোর প্রাকৃতিক উদাহরণগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর সমান্তরাল ক্রম বিবর্তনের পথে প্রজনন বা বংশবৃদ্ধি কখনো থেমে থাকেনি। তাই “শুক্রাণু ও ডিম্বাণু কী করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাপে বিবর্তিত হওয়া সম্ভব?”, “শুক্রাণু-ডিম্বাণুর আংশিক বা প্রাথমিক অবস্থায় জাইগোট বা ভ্রূণ তৈরি হয়েছিল কী করে?”, “এই অবস্থায় প্রাণীদের বংশবৃদ্ধি হবে কী করে?”, “প্রাণীদের দেহে পাশাপাশি বা সমান্তরালে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু বিবর্তিত হলো কীভাবে?” – এ ধরণের প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রকৃতিতেই বিদ্যমান।
Leave a Reply