লিখেছেন অর্ণব খান
বিবর্তনতত্ত্ব বুঝতে হলে আগে ডিএনএ, জিন, মিউটেশন, জিন ডুপ্লিকেশন এই ব্যাপারগুলো বুঝতে হয়। এগুলোর সংজ্ঞা উল্লেখ না করে বরং উদাহরণের সাহায্যে সহজভাবে বুঝে নেয়া যাক।
যেমন, ২৬ টি ইংরেজি বর্ণমালা বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে হাজার হাজার অর্থপূর্ণ শব্দ লেখা যায়, এরপর এই শব্দগুলো সাজিয়ে অনেকগুলো গ্রন্থ লেখা যায়, আবার ২৬ টি বর্ণ উল্টাপাল্টা সাজিয়ে অর্থহীন শব্দও লেখা যায়। তেমন, এই উদাহরণের মত জীবজগতের প্রতিটি প্রাণীর দেহের প্রতিটি কোষের ভেতরও “জিনোম” নামে ইংরেজির মতই একটি ভাষা আছে, যার বর্ণমালা মাত্র ৪ টি A,T,C এবং G. একেকটি জীব-প্রজাতি জিনোম ভাষায় লিখিত একেকটি গ্রন্থ ছাড়া কিছুই না। গ্রন্থের শব্দগুলো পড়েই চোখ, নাক, কান ইত্যাদি তৈরি হয়। এই জৈব গ্রন্থগুলোর একেকটি অর্থপূর্ণ শব্দের নাম জিন। আর শব্দ অর্থপূর্ণ হোক বা না হোক, শব্দের একটি খণ্ডাংশকে বলে ডিএনএ। আরও সহজে বললে বলা যায় ACCGTA এই ছয়টি বর্ণ মিলে একটি অর্থহীন শব্দ বানালো, তার মানে এটা ডিএনএ, কিন্তু জিন নয়। CAT এই তিন অক্ষর মিলে একটি অর্থপূর্ণ শব্দ বানালো, তার মানে এটা জিন এবং ডিএনএ দুটোই। বোঝার সুবিধার্থে আমি মাত্র ৩-৪ টি বর্ণ দিয়ে শব্দ সাজালেও প্রকৃত প্রাণীদেহে শত শত বা হাজার হাজার বর্ণের সন্নিবেশে একেকটি শব্দ বা জিন গঠিত হয়।
এবার একটি গ্রন্থ থেকে কপি করে আরেকটি একই গ্রন্থ তৈরি করতে গেলে যেমন বানানভুল বা মুদ্রণত্রুটি হতে পারে, তেমনি একটি প্রাণীদেহ থেকে নতুন প্রাণীর জন্মের ক্ষেত্রে ডিএনএ বা জিনের কপি করার সময় বানান ভুল হতে পারে। এই বানান ভুল হওয়াকেই মিউটেশন বলে। আবার অনেক সময় জিন কপি করার সময় একটির জায়গায় দু’টি বা কয়েকটি কপি তৈরি হয়ে যায়, একে জিন ডুপ্লিকেশন বলে।
জিনের গুরুত্বটা এবার বুঝে নেয়া যাক। সুস্থ মানবদেহের একটি অঙ্গ থেকে ইনসুলিন তৈরি হয়, ডায়বেটিস রোগীদের সে অঙ্গটি নষ্ট হয়ে যায় বলে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন দিতে হয়। তাহলে কারখানায় ইনসুলিন ইঞ্জেকশন তৈরি করা হয় কীভাবে? প্রথমে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ বের করা হয়, তারপর মানুষের ইনসুলিনের জিন ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে জোড়া লাগিয়ে আবার সেটা ব্যাকটেরিয়াতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই ব্যাকটেরিয়াই পরে ইনসুলিন জিন পড়ে পড়ে ইনসুলিন তৈরি করে ফেলে, যা পরে ছেঁকে ইঞ্জেকশন বানানো হয়।
শুধু ইনসুলিনই না, মানুষসহ সকল প্রাণীর সকল জিনই ব্যাকটেরিয়া পড়তে পারে, কারণ সকল প্রাণীর জিনোমের ভাষা একই। এভাবে মানুষের চোখের সমস্ত গাঠনিক উপাদানও ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে দিতে পারবে। ক্লোন জিনিসটা এই মূলনীতি কাজে লাগিয়েই করা হয়। যেমন একটি মা-ভেড়ার ডিম্বাণু থেকে জিনগুলো ফেলে দিয়ে ডলি নামের আরেকটি ভেড়ার সমস্ত জিন সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে ডিম্বানুটি সেই মা ভেড়ার গর্ভে সঞ্চারণ করে ঠিক ডলির মত দেখতে নতুন একটি ভেড়ার জন্মদান করা সম্ভব হয়েছিল। এখানে মা-ভেড়াটির গর্ভ ডলির জিনগুলো পড়ে পড়ে নতুন একটি ডলি বানিয়ে ফেলেছিল।
এবার নতুন প্রজাতির উদ্ভবের ক্ষেত্রে জিন মিউটেশন তথা বানানভুলের গুরুত্বটা বুঝে নেয়া যাক। “আম” লিখতে গিয়ে ভুল করে “আলু” লিখে ফেললে যেমন পুরোপুরি ভিন্ন একটি জিনিস পাওয়া যায়, জিন মিউটেশনের ফলেও তেমনি জীবদেহে পুরোপুরি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে। যেমন, লেজওয়ালা বেড়াল থেকে শুধুমাত্র একটি মিউটেশনের কারণে লেজবিহীন মান্স্ক প্রজাতির বিড়ালের উদ্ভব হয়। মিউটেশনের কারণে লেজ বিশিষ্ট মানবশিশু জন্মেরও অনেক উদাহরণ আছে। এভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উদ্ভব হওয়া সম্ভব এবং এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে পুরোপুরি নতুন একটি প্রজাতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।
এবার বরং কিছু প্রাকৃতিক এবং ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে বিবর্তনের ব্যাপারটা আরও ভাল করে বুঝে নেয়া যাক। তবে তার আগে “এককোষী বা ছোটখাট কোনো জীবে কম সংখ্যক জিন থাকে আর বহুকোষী বা বড়সড় জটিল জীবে বেশি সংখ্যক জিন থাকে” – এ ধারণাটা যে কত বড় ভুল, তা একটু পরিষ্কার হয়ে নেয়া দরকার।
এতক্ষণের আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবে এটাই মনে হতে পারে যে, বিবর্তনের পথে জীবে যত নতুন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হয়, সেগুলো নতুন নতুন জিন তৈরি হওয়ার মাধ্যমে হতে পারে। আসলে জিনের সংখ্যার সাথে দৈহিক গঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, খালি চোখে দেখতে কষ্ট হয় এমন জীবে ~৬০ হাজার জিন থাকে, আর মানুষের জিনের সংখ্যা ~২৩ হাজার। মুরগির জিনসংখ্যাও মানুষের জিনসংখ্যা থেকে বেশি, যা ~২৫ হাজার। আসলে জিনসংখ্যা নয়, মূলত হোক্স নামের এক শ্রেণীর জিনের কাজের বৈচিত্র্যের কারণেই এত বিচিত্র গঠনের সব প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। হোক্স জিনগুলো পড়ে পড়ে অন্য অঙ্গ তৈরি না হয়ে বরং সুপারভাইজার টাইপ কিছু প্রোটিন তৈরি হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় যাদের রেগুলেটরি প্রোটিন বলে। ছোট্ট একটু জায়গা আর অল্প কিছু সময় পেলে যেমন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে ইট-সিমেন্ট দিয়ে একটি পিলার নির্মাণ করা যায়, তবে জায়গা আর সময়ের পরিমাণ বাড়ালে অনিন্দ্য সুন্দর দালানও নির্মাণ করা যায়। তেমনি রেগুলেটরি প্রোটিনগুলো ভ্রূণে বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন জিন পঠন নিয়ন্ত্রণ করে ভ্রূণকে বিভিন্ন গঠনের প্রাণীতে পরিণত করে। বাস্তবেও দেখা যায়, এত বৈচিত্র্যময় প্রাণীকূলের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর হোক্স জিনগুলো প্রায় একই রকম, পার্থক্য খুব সামান্য। সরল প্রাণীগুলোতে হয়তো ৪ টি হোক্স জিনের সেট থাকে তবে জিন ডুপ্লিকেশন এবং তারপর মিউটেশনের মাধ্যমে জটিল থেকে জটিলতর প্রাণীগুলোর হোক্স জিনসেটগুলোতে জিনের সংখ্যা অল্প পরিমাণে বাড়তে থাকে, আর নতুন নতুন অঙ্গের উদ্ভব হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। এবার ল্যাব এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে হোক্স জিনগুলো কীভাবে জীবের গাঠনিক পরিবর্তন আনতে পারে তা দেখে নেয়া যাক।
ড্রসোফিলা নামের ফলের মাছির হোক্স জিনগোষ্ঠিতে মিউটেশন ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত সব রেজাল্ট পেয়েছেন। যেমন, একজোড়া পা বেশি তৈরি হওয়া, একজোড়া পাখা বেশি তৈরি হওয়া, মুখের স্থানে পা তৈরি হওয়া, পায়ের স্থানে পাখা তৈরি হওয়া, পাখার স্থানে অন্য অঙ্গ তৈরি হওয়া, মাথার এন্টেনার স্থানে পা তৈরি হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সব গাঠনিক পরিবর্তন। পতঙ্গের পা এবং পাখার হোক্স জিন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পার্থক্য খুব সামান্য, অর্থাৎ মিউটেশনের কারণে পতঙ্গে পাখার উদ্ভব হয়েছে যা খাবার সংগ্রহ এবং খাদকের হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে পতঙ্গকে বেশি সুবিধা দিয়েছে। তাই এরা বেশিদিন বেঁচে বেশি প্রজনন করতে পেরেছে আর এই বৈশিষ্ট্যটি টিকে গিয়েছে। চিংড়ি, ফড়িং, কাঁকড়াবিছা, মশা, মৌমাছি, ঘাসফড়িং, পিঁপড়া ইত্যাদি পতঙ্গের দৈহিক গঠন আর তাদের হোক্স জিন তুলনা করে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, অল্প কিছু মিউটেশনের মাধ্যমে কীভাবে এই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিগুলোর উদ্ভব হয়েছে। শুধু পতঙ্গ নয় মেরুদণ্ডী প্রাণীতেও পরীক্ষা করে একই রকম ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। যেমন ইঁদুরের একটি হোক্স জিনের মিউটেশন করে পায়ের সামান্য পরিবর্তন পাওয়া গেলেও দু’টি হোক্স জিনের মিউটেশন করে পায়ের জায়গায় সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের অঙ্গ পাওয়া গিয়েছে। আবার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের একটি সাধারণ জিন থাকে যা পড়ে পড়ে দেহের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত রিব্স বা বুকের খাঁচা তৈরি হতে পারে। তবে মানুষ, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণীগুলোয় এই সাধারণ রিব্স জিনের নিয়ন্ত্রণকারী একটি হোক্স জিন আছে যার রেগুলেটরি প্রোটিন বুক ছাড়া বাকি দেহে রিব্স জিনের পঠন নিষিদ্ধ করে দেয়, তাই শুধু বুকের মাঝেই খাঁচা তৈরি হয়। পরীক্ষাগারে ইঁদুরের এই হোক্স জিনটি মিউটেশন করে দেখা যায় ইঁদুরের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত রিব্সের উদ্ভব ঘটে। সাপের জিনোমে প্রাকৃতিকভাবেই এই হোক্স জিনটি নেই, তাই প্রাকৃতিক ভাবেই সাপের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত রিব্স বিদ্যমান।
এতসব যুক্তি ও প্রমাণের পরও কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, প্রকৃতিতে কেন বিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না। এর কারণ প্রুফ রিডার। একটি গ্রন্থ থেকে কপি করে আরেকটি গ্রন্থ তৈরি করে প্রকাশ করার আগে একজন প্রুফরিডার ভুলভ্রান্তিগুলো চেক করে ঠিক করে দেয়। জিন ও ডিএনএ কপি করার পরেও জীবদেহে এদের প্রুফরিডিং হয় আর ভুলভ্রান্তি ঠিক করা হয়। তাই মিউটেশন ঘটা এত সহজ নয়। তার পরও প্রুফরিডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক মিউটেশন ঘটে যায়, যার বেশিরভাগই প্রাণীদেহে উপকারী পরিবর্তন না এনে বরং ক্ষতিকর পরিবর্তন আনে, তাই প্রাণীগুলো বেঁচে থাকতে পারে না। এদের মৃত্যুর সাথে সাথে মিউটেশনগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু মিলিয়ন বছর সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু উপকারী মিউটেশন ঘটে যায় যার কারণে প্রাণীরা বেশি সুবিধা পেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকে, আর তারা প্রজননের মাধ্যমে এই উপকারী মিউটেশন প্রজন্মান্তরে টিকিয়ে রাখে। একটি মিউটেশন ছড়ানোর জন্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে যেতে হয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতে দীর্ঘ সময় লাগে।
যারা বলে, বিবর্তনতত্ত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণ করা যায় না, তারা না জেনে এই কথা বলে, কারণ কথাটি সত্য নয়।
- জিন-এর তথ্য থেকে অঙ্গ তৈরি হয়, এটা ল্যাবে প্রমাণিত; প্রাকৃতিকভাবে জিন মিউটেশন ঘটে, এটাও ল্যাবে প্রমাণিত;
- জিন মিউটেশনের ফলে অঙ্গের বিকৃতি হয়ে নতুন অঙ্গের উদ্ভব হয়, এটাও ল্যাবে প্রমাণিত;
- এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণী পড়তে পারে, এটাও ল্যাবে প্রমাণিত;
- দুটি ভিন্ন প্রাণীর জিন মিশ্রিত করে একটি সংকর জীব সৃষ্টি করা যায়,এটাও ল্যাবে প্রমাণিত (যেমন লায়ন+টাইগার = লাইগার);
- একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর জিন দিয়ে ক্লোন করে হুবহু সেই প্রাণীটি সৃষ্টি করা যায়, এটাও ল্যাবে প্রমাণিত।
এর বাইরে আর কী প্রমাণ দরকার? সরাসরি এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণী বানানো? সরকারীভাবে ক্লোন করার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন, সেটাও হয়ে যাবে। কিভাবে? শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জিনের ৯৫% মিল। প্রাকৃতিক মিউটেশনে যেহেতু দীর্ঘ সময় লাগে বিজ্ঞানীরা শিম্পাঞ্জির জাইগোটের বাকি ৫% জিনে নিজ হাতে মিউটেশন করে দেবেন। এটা এখন গর্ভে সঞ্চারণ করে দিলেই শিম্পাঞ্জির পেট থেকে মানুষের বাচ্চা বের হবে। ডলির ক্লোন এভাবেই করা হয়েছে, তাই এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
Leave a Reply