লিখেছেন: হিরন্ময় দিগন্ত
হুঃ আহমেদ এর প্রশংসাকারীদের মুখে একটা কথা খুব বেশি শোনা যায়, সেটা হল- ‘হুঃ আহমেদ একটা প্রজন্মকে পাঠক হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাদের হাতে বই তুলে দিয়ে।’ অর্থাৎ যারা বই পড়ে না, পড়ত না তারা তার বই পড়া আরম্ভ করেছিল। [মজার বিষয় হল যাদের পাঠ্যাভ্যাস আগের থেকেই ছিল, যাদের ক্ষুধার শেষ নেই- তাদের জন্য ইনি কি করেছেন তা কেউ বলে না। করেছেন কি?] খুব অল্প সময়কালের ভেতরে তার পাঠক-ভক্ত সংখ্যা সকল লেখকের চেয়ে বেশি হয়ে দাড়ালো। তিনি হয়ে উঠলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক।
খুব ভাল কথা। আসুন, এবার হুঃ আহমেদ এর বিভিন্ন ক্যাটেগরীর ভক্তদের একটু সংস্পর্শে যাইঃ
মাদ্রাসার ছাত্রঃ এদের জন্য লেখা পানসে-ভুলে ভরা-মানহীন বিজ্ঞানের বইয়ের চেয়ে এরা ধর্মীয় বই ও হুমায়ূনের বই ভাল বুঝতে পারে। প্লানটাও অবশ্য তাই। নীলপদ্মের থিওরী এমন কিছু নয়। হিমুর পীর পীর ভাবটাও বেশ আকর্ষনীয়। আল্লাহর রহমত ছাড়া কে এমন অলৌকিক কাজ কারবার করতে পারে? তাছাড়া হিমু কোন মেয়ের সাথেই বেলাল্লাপানা করে নি। তাই না?
স্কুল ছাত্রঃ বড়’পা, ছোট মামাদের কোন আড্ডায় এরা হুঃ আহমেদ, হিমু, মিসির আলীর কথা কান পেতে শুনে থাকবে। এখন তো কোন ব্যাপারই না। স্কুল লাইফেই হুঃ আহমেদ এর সব ক্যাটেগরীর বই-ই বাচ্চারা গিফট পায়।পায়। [আমিও পেয়েছিলাম, ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’।এআমি আমার এক ক্লাসমেট বন্ধু জানতে চেয়েছিল- কেমন বই? আমি বলেছিলাম- ফানি বই, অনেক রসিকতা আছে। টাইম পাস করার জন্য দারুন।] মানুষ জন্মগত-প্রকৃতিগতভাবেই কৌতুহলী। তাই হিমুর মত একটা ভ্যাগাবন্ডকে কিভাবে ‘দেখলেই প্রেমে পরে যেতে ইচ্ছে করে’ টাইপ মেয়েরা ভালবাসে ফেলে ১০০ পৃষ্ঠা না যেতে যেতে- তা ভেবে কিশোরেরা আত্মবিশ্বাস পায়। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হলেও মারিয়া-ফারিয়া-রুপা কেউ একজন জুটে যাবে নিশ্চিত। মেয়েদের শিফটের অর্পিতা মেয়েটাও জোশ! হলুদ পাঞ্জাবী পড়লে তো আমায় ভালই লাগে। আরেকটু বড় হলে দাড়িও উঠবে। উঠবে তো?
কলেজ ছাত্রঃ যাই কস দোস্ত, শিবিরের মফিজ ভাই কইছে মিসির আলী আস্তিক!
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীঃ “এই! তুমি কিন্তু আজকে হলুদ পাঞ্জাবী পরে আসবা! না হলে আমি ফুস্কা খেতে আসবো না। তুমিও ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আমার ফুস্কা খাওয়া দেখতে পারবে না। মনে থাকে যেন। বাই জান্টু! ওহ! শোনো, আমি কিন্তু বোরকা পরেই আসবো। বাসার কেউ দেখলে খবর আছে।” ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়া রাতুলকে বললো তার স্কুলের সেই অর্পিতা।
কোচিং টিচারঃ “ওয়াও স্যার! আপনার বাসায় এত্তু এত্তু হুঃ আহমেদ এর বই। ওহ! হিমুর ঐ বইটাও আছে? আল্লাহ! দেখেছিস মিতু আমি জানতাম এই স্যার ভাল পড়ান।”- বলল তিতলি। থাম তো। শোন, প্রথম দিনেই আবার হুঃ আহমেদ এর বই চেয়ে বসিস না। সার এভারেজ মেয়ে ভেবে বসতে পারে।- ফিসফিসিয়ে বলল মিতু। [এক মাস পর ] তিতলি!… জ্বী স্যার? আজ পড়ান শেষ তুমি একটু দেখা করে যেও তো। আচ্ছা স্যার। [ দেড় ঘন্টা পর] তিতলি শোন! জ্বী স্যার!- তোমাকে দেখলে না, আমি রুপার কথা ভাবি।
রাজ-কান্না নদীঃ ইশ! আমি কেনু শ্যামলা হলাম? আমার …কেন আরেকটু… আমায় দেখলে তো রিকশাওয়ালারাও তাকায় না। ওয়া! ওয়া! ওয়া! [রাজ-কান্না কন্যা তো তাই]
‘দেখলেই প্রেমে পড়ার মত’ ফারিয়াঃ ঠাসস!!![চটকানার শব্দ] বেয়াদপ কোথাকার! তোর সাহস তো কম না! একটা রিকশাওয়ালা হইয়া তুই বারবার আড়চোখে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাস!
নিরক্ষর নজরুলঃ [রিকশা গ্যারেজে জমা দিয়ে, বাসায় ফিরে। তুলনামুলক ভাল একটা বস্তিতে] হুহ! আমার রিকশায় য্যান আয়না লাগান আছে! পেছনের গাড়িও দেখা যাবে না! কি খারাপ মেয়েরে খোদা! চড়স তো রিকশায়। ভাব দেখায় মনিকা চেলেছ! পড়ালেখা শিখে আমার পোলাও একদিন পেরাইভেট কিনবে। কিন্তু তোর মত কাউকে থাবড় দিবো না।-মনেমনে ভাবতেই লাগল নজরুল। কিছুতেই ঘটনাটা মাথা থেকে আজ যাবে না। কখনও কি আর যাবে? রুমে ঢুকে,- বাবা মশাল। কি কর বাবা? বই পড়ি। কি বই বাবা?-বুঝবে না। হুমায়ূন স্যারের বই ।
শিবিরের মফিজঃ হুজুর! হুঃ আহমেদ নাকি তার কোন নাটকে টিয়া পাখি রে দিয়া কওয়াইছিলো। তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!- তো কি হইছে? টিয়া পাখিরে দিয়াই তো কওয়াইছে! টিয়ারে তুই যা শিখাবি তাই শিখবো। আচ্ছা শোন, খেয়াল মত শুনিস নাদান। তোর বড়ই তাড়াহুড়া।- বলেন হুজুর, আর করমু না।-ধর তোর বাপেরে কেউ খুন করলো। তুই কি টিয়া পাখি দিয়া প্রতিশোধ নিবি?- হেঃ হেঃ জ্বিনা হুজুর। তা ওনার আব্বারেও কি খুন করছে?-আবার তাড়াহুড়া!! পাকিস্তানী মিলিটারী মারছে।…যাউজ্ঞা ওরে লইয়া টেনশান করিস না। তয় অর মাইঝা ভাই তো বড় বজ্জাৎ।-জ্বী হুজুর জানি, নাস্তিক!
মেঝো ভাইঃ আমি গনিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান-মেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। একটু তো দেরি হবেই। বই মেলার কথা কি আমি ভাবি না! এ যুগের আইন্সটাইন-সুকুমারদের হাতে বই তুলে দিতে আমার যে কি ভাল লাগে! আর ওদেরকে অটোগ্রাফ দেয়ার সময় তো মনে হয়, ইশ! আমার দাত যদি আরও ৪-৬ টা বেশি থাকত, চোয়ালটা আরেকটু বড় হত। বড় করে হাসিমুখ দেখাতে পারতাম ওদের।
আহমদ ছফাঃ কী! আমি কার ভক্ত!!! [ওহ! স্যরি গুরুজ্বী]
আমিসুল হকঃ আ’মা’র হিংসে হয় হুঃ আহমেদ সারের প্রতি। এত পাঠক! এত ভক্ত! এত কাটতি!আহা! কবে যে আ’মা’র সময় আসবে…কবে যে বাজার পাবো? কবে যে বাজারী হবো? দাও না বলে ‘মা’?
হিমুঃ- প্লীজ, হুঃ আহমেদ ভাই, আমাকে নিয়ে ফাজলামো বাদ দেন। আমার মহাপুরুষ বানানোর কারিগর মানসিক রোগী বাবার চেয়ে আপনি আমাকে এবিউজ বেশি করছেন। আমাকে ভ্যাগাবন্ড বানিয়েছেন, সমস্যা নাই। কিন্তু বুদ্ধিমান-রসিক-নির্লিপ্ত অলৌকিক মানব বানানোর ভন্ডামী কেন করছেন? আপনি জানেন রাস্তা হেটে হেটে আমার পায়ে কত জোর? অন্যায় দেখলে সেখানে কেন আমি রস খুঁজতে যাবো। এই পা দিয়ে লাত্থি দিলে দু একটা দূর্নীতিবাজ মন্ত্রী- সন্ত্রাসীদের কি অবস্থা হবে যানেন? নিজে ভ্যাগাবন্ড হতে পারেন নাই। গৃহ ধর্ম পালন করেছেন। যা হোক, আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাচ্ছি না। আমাকে তো রাস্তা দিয়ে হাটতে হবে। চারিদিকে আপনার যে ভক্ত। এই দেশে আপনার চর্চা ধর্ম চর্চার মতই। আপনার ভক্তরা কতটা উগ্র তা জানেন? আমি ভ্যাগাবন্ড, তবে সিরিয়াস ভ্যাগাবন্ড। আমার দায়বোধ আছে। রাস্তার মাটির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, যারা আমায় সাধারন হিসেবে নিতে পারে তাদের প্রতি, জীবনানন্দের প্রতি [একজন দুঃখী-নিভৃতচারী মানুষ কিভাবে সবাইকে আনন্দ দিয়ে বেড়াচ্ছেন- আমি ভেবে কুল পাই না, কে জানে একদিন হাটতে হাটতে তার দেখা পেয়ে যাবো] আর রাজ-কান্না নদীর প্রতি। এইত গতকাল ওর হাত ধরে ছবির হাটে হেটে বেড়ালাম। আর হ্যা, রুপা এখন আর আমার নেই। জাপার আন্ডালিফ পার্থকে বিয়ে করেছে।
মিসির আলীঃ শোনো ছেলে![কাকে বলছে?] হ্যা, তুমি। [জ্বী আমাকে বলছেন?] কেন? তুমি ভেবেছিলে তোমার সাথে আমি কথা বলতে পারি না? আমি তোমার কল্পনারও বাইরে অনেক কিছুই করতে পারি। ডু নট বদার ইমাজিন। [জ্বী স্যার, বলেন- কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি] তোমার কাছে হুমায়ূন আজাদ এর ফোন নম্বর আছে? [না স্যার, তবে ওনার ছেলের কাছ থেকে নিতে পারবো] -হ্যা, দিও তো। [কেন স্যার, জানতে পারি?]- আর বোলো না, এই হুঃ আহমেদ কে নি আর পারি না। আমাকে ভেবেছেটা কী! আমি একজন যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনষ্ক-অবিশ্বাসী ও প্রগতীবাদী মানুষ। আমাকে দিয়ে কিনা ও ওঝাগীরী করাচ্ছে!! বিরক্তিতে টাক মাথায় নতুন চুল গজাচ্ছে। সপ্তাহোখানেক পর টিকির মত হয়ে যাবে। [বলেন কী স্যার] -হ্যা, তুমি ওনার নাম্বার দিও। এরপর আমাকে নিয়ে সব লেখা হুমায়ূন আজাদকেই লিখতে অনুরোধ করবো। আই রেস্পেক্ট দিস ম্যান, হি ইজ দা ওয়ান হু ক্যান ফাইন্ড আউট দ্যা ট্রু মিসির আলী।
হুমায়ূন আজাদঃ CTN. সময় কি অদ্ভুত দুরন্ত গতিতে ছুটছে! এটা প্রগতীর যুগ, বিজ্ঞানকে চর্চা করে লালিত হাজার বছর অন্ধতা দূর করার সময়, এটা সাম হারিস, রিচার্ড ডকিন্স, ড্যান ডেনেটদের যুগ। আয়ান হারসি আলী, সালমান রুশদীর যুগ। পেছনে ফেরার অবকাশ কই? কত কাজ বাকী। বাঁচবো ক দিন? আর আমার পেছনে তো পাকি বীর্যজাত …হাহ! [দীর্ঘ শ্বাস]
হুঃ আহমেদ এর বই এর একজন প্রকাশকঃ এই… চানাচুর! চানাচুর! চানাচুর লাগবে চানাচুর?
জিব্রাইল দ্যা বুক রিভিউয়ারঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে হুঃ আঃ বাদে আর কোন বাবুর্চী নাই, এবং চানাচুর দেশের সর্বোৎকৃষ্ট খাবার।
হুঃ আহমেদ স্বয়ং- [কেন? নিজে কি নিজের ভক্ত হওয়া যায় না?] ঐ দিন এক পুঁচকে ছেলে আমার একটা ভুল ধরিয়ে দিল! আমি একটা বইয়ে লিখেছিলাম-‘মানুষই হল পৃথিবীর একমাত্র প্রানী যে অন্য মানুষের জীবন নেয় আবার নিজের জীবন দিয়ে হলেও অন্য মানুষকে বাঁচায়।’ কী আশ্চর্য! আমি জানতাম না এরকম অনেক প্রাণি পৃথিবীতে আছে! নাকি জানতাম। গুরুত্ব দিয়ে লিখি নি। বইমেলার যে চাপ! যা হোক, আমি ছেলেটাকে আমার সাথে নুহাশপল্লীতে যেতে বলেছিলাম। জোৎস্না- দেখার জন্য। ও বলে কি না, ও একবার জোৎস্না-রাত জেগেছে। ওর ঘোর নাকি এখনও কাটে নি। ও এখন জোৎস্নাকে বোঝার চেষ্টা করছে। জোৎস্না কি বোঝার জিনিস? তাছাড়া ও নাকি বিজি, কার্ল সাগান না জানি কে ওকে সাথে নিয়ে চন্দ্র-সূর্য পাড়ি দিয়ে কসমিক ওশানে ছুটে চলছে…. কী অদ্ভুত! আমি জীবনে কত না জোৎস্না দেখেছি! কিন্তু…
Leave a Reply