লিখেছেন গোলাপ
“যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।”
হিজরি ৬ সালের জিলকদ মাসে মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে হুদাইবিয়া সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন শেষে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করার মাত্র দুই মাস পর হিজরি ৭ সালের মহরম মাসে (মে-জুন, ৬২৮ সাল) খায়বারের নিরীহ জনপদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ ও পরাস্ত করার পর; অতঃপর হুমকির মাধ্যমে ফাদাক আগ্রাসন সম্পন্ন ও অতর্কিত আক্রমণে ওয়াদি আল-কুরার জনপদবাসীদের পরাস্ত করার পর স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর তাঁর আদেশে উমর ইবনে আল-খাত্তাব এবং আবু বকর ইবনে কুহাফা তুরাবা ও নাজাদ অঞ্চলের নিরীহ জনপদের ওপর কীভাবে তাদের আগ্রাসী আক্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন, তার বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, মুহাম্মদ তাঁর হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় থেকে (মার্চ, ৬২৮ সাল) তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত (জুন, ৬৩২ সাল) সময়ের মধ্যে আরব, পারস্য, রোমান (বাইজানটাইন) ও অন্যান্য শাসনকর্তাদের উদ্দেশে চিঠি লিখেছিলেন ও সেই চিঠিগুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি তাঁর কিছু অনুসারীকে নিযুক্ত করেছিলেন।
এ বিষয়ের যে বিস্তারিত বর্ণনা ইবনে ইশাক তাঁর ‘সিরাত’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, তা ইবনে হিশাম সম্পাদিত ‘ইবনে ইশাকের সিরাত’ ভার্সন, “সিরাত রাসুল আল্লাহ” গ্রন্থে অনুপস্থিত; কিন্তু আল-তাবারীর রেফারেন্সে A. GUILLAUME তা বর্ণনা করেছেন এই বইটির ইংরেজি অনূদিত গ্রন্থে (পর্ব-৪৪)। আদি উৎসে এ বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে ইবনে ইশাকের ছাত্র সালামাহ বিন ফাদল আল-আবরাশ আল-আনসারী হইতে প্রাপ্ত মুহাম্মদ ইবনে যারির আল-তাবারী সম্পাদিত ভার্সন “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক” গ্রন্থে।
আল-তাবারীর (৮৩৯-৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) বর্ণনা: [1] [2]
‘এই বছর [হিজরি ৬ সাল] আল্লাহর নবী পত্রবাহক প্রেরণ করেন। তিনি জিলহজ মাসে (যার শুরু হয়েছিল ১২ই এপ্রিল, ৬২৮ সাল) ছয়জন লোককে প্রেরণ করেন, যাদের তিনজন একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে:
[১] তিনি লাখমের হাতিব বিন আবু বালতা-কে, যিনি ছিলেন বানু আসাদ বিন আবদ আল-উজ্জা গোত্রের সাথে জোটবদ্ধ, প্রেরণ করেন আল-মুকাওকিস এর কাছে (আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা);
[২] বদর যুদ্ধ অংশগ্রহণকারী শুজা বিন ওহাব-কে, যিনি ছিলেন বানু আাসাদ বিন খুযায়েমা গোত্রের হারব বিন উমাইয়ার সাথে জোটবদ্ধ, তিনি প্রেরণ করেন আল-হারিথ বিন আবি শিমর আল-ঘাসানির কাছে (‘ঘাসানিদরা ছিলেন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যারা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অধীন বানটা ঘাসান নামের এক আরব উপজাতীয় রাজ্য শাসন করতেন, যার রাজধানী ছিল সিরিয়ার বসরায়’ [3]); ও
[৩] দিহায়া বিন খালিফা আল-কালবি-কে তিনি প্রেরণ করেন সিজারের কাছে (বাইজানটাইন সম্রাট)।
[৪] তিনি সালিল বিন আমর আল-আমিরি (আমি বিন লুয়াভি গোত্রের) কে প্রেরণ করেন হাওদা বিন আলি আল-হানাফি এর কাছে (যিনি ছিলেন বানু বকর বিন ওয়ায়িল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ‘বানু হানিফা বিন লুজায়েম গোত্রের প্রধান, যাদের অবস্থান ছিল আল-ইয়ামামা [মধ্য আরব] নামক স্থানে। স্পষ্টতই হাওদা ছিলেন খ্রিষ্টান, পারস্য শাসকদের সাথে জোটবদ্ধ ও তাদের জন্য তিনি করতেন কাফেলা বৃত্তি’ [4]);
[৫] আবদুল্লাহ বিন হুদাফা আল-সাহমি কে প্রেরণ করেন, ‘কিসরা’ এর কাছে (‘কিসরা’ [“খসরু”] হলো আরবদের ভূষিত সাসানিয়া [পারস্য] শাসন কর্তাদের উপাধি।); ও
[৬] আমর বিন উমাইয়া আল-দামরি কে প্রেরণ করেন ‘নিগাস’ এর কাছে (আরবদের ভূষিত ইথিওপিয়ার শাসনকর্তা, আল-নাদজাসি)।
ইবনে ইশাক যা বর্ণনা করেছেন, তা হলো এই যে, (ইবনে ইশাক হইতে > সালামা হইতে > ইবনে হুমায়েদ হইতে বর্ণিত): আল্লাহর নবী হুদাইবিয়ার (চুক্তি স্বাক্ষর) সময় থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাঁর কিছু অনুসারীকে বিভিন্ন আরব ও বিদেশী শাসনকর্তাদের কাছে প্রেরণ করেন, উদ্দেশ্য – তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান।
ইবনে ইশাকের মতে: আল্লাহর নবী তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ন্যস্ত করেন। তিনি সালিত বিন আমর বিন আবদ শামস বিন আবদ উদ্দ (বানু আমির বিন লুয়াভি গোত্রের এক লোক) কে আল-ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওদাহ বিন আলি এর কাছে প্রেরণ করেন। তিনি আল-আলা বিন আল-হাদরামি কে প্রেরণ করেন আল-বাহরাইনের শাসনকর্তা আল-মুনধির বিন সাওয়া (বানু আবদ-কায়েস গোত্রের এক লোক, যিনি ছিলেন দারিম বিন তামিম উপজাতীয় গোত্রের প্রধান, পারস্য শাসকদের সাথে যার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ করতেন হাজার [বর্তমান আল-হাসা] ও বাহরাইন এর বাজার [5]); এবং আমর বিন আল-আস কে প্রেরণ করেন ওমানের শাসনকর্তা জাফর বিন জুলানদা আল-আযদি ও আববাদ বিন জুলানদা আল-আযদি এর কাছে।
তিনি হাতিব বিন আবু বালতা- কে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা আল-মুকাওকিসের কাছে প্রেরণ করেন। হাতিব তার কাছে আল্লাহর নবীর চিঠিটি হস্তান্তর করেন; আর আল-মুকাওকিস আল্লাহর নবীকে দান করেন চার জন ক্রীতদাসী, যাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল আল্লাহর নবীর পুত্র ইবরাহিমের মাতা মারিয়া [পর্ব-১০৮]।
আল্লাহর নবী দিহায়া বিন খালিফা আল-কালবি কে (ও আল-খাযরাজি; আল কালব গোত্রটি আল-খাযরাজ গোত্রেরই এক শাখা) প্রেরণ করেন রোমান শাসনকর্তা সিজারের কাছে, যার নাম ছিল হিরাক্লিয়াস (বাইজানটাইন সম্রাট, শাসনকাল ৬১০-৬৪১ খ্রিষ্টাব্দ)। যখন দিহায়া তার কাছে আল্লাহর নবীর চিঠিটি হস্তান্তর করেন, তিনি সেটির দিকে তাকান ও অতঃপর তা তিনি তার দুই উরু ও পাঁজরের মাঝখানে রাখেন।’
ইমাম বুখারীর (৮১০-৮৭০ সাল) বর্ণনা: [6]
‘আনাস বিন মালিক হইতে বর্ণিত: এক সময় আল্লাহর নবী চিঠি লিখেছিলেন বা চিঠি লিখার জন্য মনস্থির করেছিলেন। আল্লাহর নবীকে বলা হয়েছিল যে, তারা (শাসকরা) কোনো চিঠি পড়বে না, যদি তার ওপর কোনো সীল-মোহর না থাকে। তাই আল্লাহর নবী একটি সিলভারের আংটি তৈরি করান, যার ওপর খোদাই করা ছিল “আল্লাহর নবী মুহাম্মদ“। আল্লাহর নবীর হাতের সেই সাদা চিকচিক ঝলক যেন আমি এই মুহূর্তেও দেখতে পাচ্ছি।’
ইমাম মুসলিম (৮২১-৮৭৫ সাল) এর বর্ণনা: [7]
‘আনাস যা বর্ণনা করেছেন, তা হলো, যখন আল্লাহর নবী (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) অনারবদের (অর্থাৎ, পারস্য ও বাইজানটাইন সম্রাট) কাছে (চিঠি) লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে জানানো হয় যে অনারবরা চিঠি গ্রহণ করতে রাজি হবে না, যদি তার ওপর কোনো ‘সীল-মোহর’ না থাকে; তাই তিনি (নবী সাঃ) একটি সিলভারের আংটি তৈরি করান।—-’
– অনুবাদ, টাইটেল ও [**] যোগ – লেখক।
>>> কী লেখা ছিল মুহাম্মদের সেই চিঠিগুলোতে?
সেই চিঠিগুলোতে কি লেখা ছিলো মক্কা ও হিজরত পরবর্তী প্রাথমিক মদিনা সময়ের তাঁর আপাত শান্তিপ্রিয় ‘মক্কায় মুহাম্মদ (পর্ব-২৬)’ -এর বাণীসদৃশ্য বক্তব্য? যেমন:
“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই (২:২৫৬); আপনাকে তাদের সংরক্ষক করিনি এবং আপনি তাদের কার্যনির্বাহী নন (৬:১০৭); তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্য? (১০:৯৯); তুমি তো শুধু সতর্ককারী মাত্র (১১:১২); আপনি তাদের উপর জোরজবরকারী নন (৫০:৪৫); যার ইচ্ছা, সে একে স্মরণ করুক (৭৪:৫৫); আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা, আপনি তাদের শাসক নন (৮৮:২১-২২); তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্যে এবং আমার ধর্ম আমার জন্যে (১০৯:৬)” – ইত্যাদি? ইত্যাদি? ইত্যাদি?
নাকি তাতে লিখা ছিলো,
বানু কুরাইজার নৃশংস গণহত্যার (পর্ব: ৮৭-৯৫) পর থেকে তাঁর মৃত্যুকাল অবধি সময়ে বিভিন্ন অবিশ্বাসী জনপদের ওপর তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের নৃশংসতার ফসল উপর্যুপরি একের পর এক সফলতায় উজ্জীবিত ‘মদিনায় মুহাম্মদ (পর্ব-২৭)‘ এর ত্রাস ও হুমকি সাদৃশ্য আগ্রাসী আহ্বান? যেমন:
“আমিই নবী! বশ্যতা স্বীকার করো ও পুরস্কৃত হও, নতুবা পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকো!”
ইসলাম নামক মতবাদটিকে জানতে হলে স্বঘোষিত আখেরি নবী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (সেইবাহ) ইবনে হাশিম (উমর) ইবনে আবদ মানাফ (আল-মুগিরা) ইবনে কু’সে (যায়েদ) ইবনে কিলাব (হাকিম) ইবনে মুররাহ কে “জানতেই হবে”! এর কোনো বিকল্প নেই!
(চলবে)
[কুরানের উদ্ধৃতি সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ (হারাম শরীফের খাদেম) কর্তৃক বিতরণকৃত বাংলা তরজমা থেকে নেয়া, অনুবাদে ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় অনুবাদকারীর। কুরানের ছয়জন বিশিষ্ট ইংরেজি অনুবাদকারীর ও চৌত্রিশ-টি বিভিন্ন ভাষায় পাশাপাশি অনুবাদ এখানে।]
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[1] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৮, ইংরেজী অনুবাদ: Michael Fishbein, University of California, Los Angeles, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-7914-3150—9 (pbk), পৃষ্ঠা (Leiden) ১৫৫৯-১৫৬১; বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক:
[2] অনুরূপ বর্ণনা: “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৬৫২-৬৫৩; বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক:
[3] [4] [5] – Ibid আল-তাবারী, নোট নম্বর ৪২২, ৪২৫ ও ৪৩০; পৃষ্ঠা ১৫৬০-১৫৬১।
[6] সহি বুখারী: ভলুম ১, বই নম্বর ৩, হাদিস নম্বর ০৬৫:
Narated By Anas bin Malik : Once the Prophet wrote a letter or had an idea of writing a letter. The Prophet was told that they (rulers) would not read letters unless they were sealed. So the Prophet got a silver ring made with “Muhammad Allah’s Apostle” engraved on it. As if I were just observing its white glitter in the hand of the Prophet.
[7] সহি মুসলিম: বই নম্বর ০২৪, হাদিস নম্বর ৫২১৭:
Leave a Reply