কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের ভাষা সংস্কৃত- এটাই সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলেও অনেকে অনুমান করেন যে মূল গীতগোবিন্দ লেখা হয়েছিল শৌরসেনী অপভ্রংশে বা প্রাচীনতম বাঙলায়। পরে এটাকে সংস্কৃতরূপ দেয়া হয়েছে। এই অনুমানের একটি অন্যতম কারণ হলো ডঃ সুনীতিকুমারের কিছু গবেষণা। তাতে দেখা গেছে যে বর্তমান গীতিগোবিন্দের ভাষা শব্দ ও ব্যাকরণ সংস্কৃত হলেও তাতে এমন কতগুলো পদ বা গান আছে যার সুর স্থানীয় শৌরসেনী অপভ্রংশে অর্থাৎ প্রাচীন বাঙলা ভাষার। ব্যাপারটা এমন যে স্থানীয় জনপ্রিয় সুরের সাথে নতুন কথা বসিয়ে দিয়ে এক ধরনের রিমিক্স করার মত।
ওদিকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন হলো চর্যাপদ, যার রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ এবং বিষয়বস্তু হলো বৌদ্ধধর্ম। চর্যাপদের পরে বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চতুর্দশ শতকের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য। আর এর পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির যাত্রা শুরু। (বড়ু চণ্ডীদাসের সময়কাল আনুমানিক ১৩৭০-১৪৩৩ খ্রীঃ, অর্থাৎ জয়দেবেরও অনেক পরে।)
এবার নীহাররঞ্জন রায়ের “বাঙালীর ইতিহাস” পৃঃ ৬১০ থেকে “কৃষ্ণ-রাধা কাহিনী” শীর্ষক অংশটুকু হুবহু তুলে দিচ্ছি-
“প্রাচীনতম বাঙলা ভাষা যেমন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভাবের ও তত্ত্বের বাহন হইয়াছিল, ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যেও যে সে-ভাষা একেবারে ব্যবহৃত হয় নাই, এমন নয়। প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যে রাধা-কৃষ্ণ কাহিনীর কয়েকটি নাম যে বিবর্তিত রূপে আমাদের গোচর তাহাদের ভাষাতত্ত্বগত ঈঙ্গিত খুব সুস্পষ্ট বলিয়াই মনে হয়। কৃষ্ণ-কাহ্ন-কানু বা কানাই, রাধিকা-রাহী-রাই, কংস-কাংস, নন্দ-নান্দ, অভিমন্যু-অহিবণ্ণু বা অহিমণ্ণূ-আইহণ, আইমন-আয়ান প্রভৃতি নামের বিবর্তনের মধ্যে অর্থাৎ সংস্কৃত হইতে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত হইতে অপভ্রংশের মারফৎ প্রাচীন বাঙলার রূপান্তরের মধ্যে বোধ হয় এ-তথ্য লুক্কায়িত যে কৃষ্ণ-রাধিকার কাহিনী কোনও না কোনও সাহিত্যরূপ আশ্রয় করিয়া কামরূপে ও বাঙলা দেশে প্রসার লাভ করিয়াছিল তুর্কী-বিজয়ের বহু আগেই। এই সাহিত্যরূপের প্রত্যক্ষ প্রমাণও কিছু কিছু আছে, যদিও তাহা সপ্রচুর নয়। কামরূপরাজ বনমালদেবের একটি লিপিতে, ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতে, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-গ্রন্থের কয়েকটি প্রকীর্ণ শ্লোকে কৃষ্ণের ব্রজলীলার বর্ণনার কথা তো আগেই বলিয়াছি।
“তাহা ছাড়া, চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১০৫১ শকে (১১২৯ খ্রীষ্ট বৎসরে) মানসোল্লাস বা অভিলষিতার্থচিন্তমণি নামে একটি সংস্কৃত কোষগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; এই গ্রন্থের গীতবিনোদ অংশে ভারতবর্ষের সমসাময়িক সমস্ত স্থানীয় ভাষায় রচিত কিছু কিছু গানের দৃষ্টান্ত সংকলিত হইয়াছে; ইহাদের মধ্যে কয়েকটি প্রাচীনতম বাঙলায় রচিত গানও আছে। এই বাঙলা গানগুলির বিষয়বস্তু গোপীদের লইয়া শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এবং বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার-বর্ণনা। এই গানগুলি বাঙলা দেশেই রচিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই, এবং এই প্রান্ত হইতেই মহারাষ্ট্র-প্রান্তে প্রচারিত হইয়াছিল।”
কবি জয়দেব লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন। বাংলায় সেন বংশের রাজত্বকাল ১০৯৭-১২২৫ খ্রিষ্টাব্দ। ১২২৫ সালের পর তুর্কি শাসন শুরু হয়। লক্ষ্মণ সেন ছিলেন বৈষ্ণব। এ থেকে হয়তো বুঝতে পারা যায়, কবি জয়দেব কোথা থেকে গীতগোবিন্দ লেখার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন। উপরে নীহাররঞ্জন রায়ের অংশটুকুতে যে প্রাচীনতম বাংলায় রচিত গানের কথা উল্লেখ আছে তার বিষয়বস্তু “গোপীদের লইয়া শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এবং বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার-বর্ণনা।”। কবি জয়দেব এই গানগুলা থেকেই হয়তো আইডিয়া নিয়েছিলেন এবং আগের সহস্র গোপীদের সাথে নতুন একজনকে প্রধান নায়িকা বানিয়ে রাধা চরিত্র সৃষ্টি করছিলেন।
আরেকটা কথা লক্ষ্যনীয়- “এই গানগুলি বাঙলা দেশেই রচিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই, এবং এই প্রান্ত হইতেই মহারাষ্ট্র-প্রান্তে প্রচারিত হইয়াছিল।”- অর্থাৎ সারা ভারতে রাধার চরিত্র এভাবেই ছড়িয়েছিল। আর এর পিছনে রাজস্থানের মীরাবাঈয়ের (১৪৯৮-১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ভূমিকা অনন্য। এটাও অনেক পরের কাহিনী।
গীতগোবিন্দের আগে আর কোন সংস্কৃত বা অন্য ভাষার গ্রন্থে রাধার উল্লেখ পাওয়া গেছে বলে জানা যায় না।
[বিঃদ্রঃ অসম্পূর্ণ। আরো সোর্স দেখার অবকাশ রয়েছে।]
Leave a Reply