লিখেছেন গোলাপ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০ > পর্ব ২১ > পর্ব ২২ > পর্ব ২৩ > পর্ব ২৪ > পর্ব ২৫ > পর্ব ২৬ > পর্ব ২৭ > পর্ব ২৮ > পর্ব ২৯ > পর্ব ৩০ > পর্ব ৩১ > পর্ব ৩২ > পর্ব ৩৩ > পর্ব ৩৪ > পর্ব ৩৫ > পর্ব ৩৬ > পর্ব ৩৭ > পর্ব ৩৮ > পর্ব ৩৯> পর্ব ৪০ > পর্ব ৪১ > পর্ব ৪২ > পর্ব ৪৩ > পর্ব ৪৪ > পর্ব ৪৫ > পর্ব ৪৬ > পর্ব ৪৭ > পর্ব ৪৮ > পর্ব ৪৯ > পর্ব ৫০ > পর্ব ৫১ > পর্ব ৫২ > পর্ব ৫৩ > পর্ব ৫৪ > পর্ব ৫৫ > পর্ব ৫৬ > পর্ব ৫৭ > পর্ব ৫৮ > পর্ব ৫৯ > পর্ব ৬০ > পর্ব ৬১ > পর্ব ৬২ > পর্ব ৬৩ > পর্ব ৬৪ > পর্ব ৬৫ > পর্ব ৬৬ > পর্ব ৬৭ > পর্ব ৬৮ > পর্ব ৬৯ > পর্ব ৭০ > পর্ব ৭১ > পর্ব ৭২ > পর্ব ৭৩
স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমর বিন উমাইয়া নামক তাঁর এক আদি মক্কাবাসী অনুসারীকে (মুহাজির) কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ান ইবনে হারব-কে গুপ্তহত্যার আদেশ সহকারে কীভাবে মদিনা থেকে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন এবং আবু সুফিয়ানকে হত্যায় ব্যর্থ হয়ে এই ঘাতক মদিনায় প্রত্যাবর্তনের সময় পথিমধ্যে এক এক-চোখ অন্ধ প্রতিবন্ধীসহ তিনজন মানুষকে কী কারণে খুন করেছিলেন, তার বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
ওহুদ যুদ্ধে মুহাম্মদের চরম পরাজয়, নবী-গৌরব ধূলিসাৎ এবং সমবয়সী চাচা হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব সহ ৭০ জন অনুসারীর খুন; এই যুদ্ধের মাস তিনেক পর ‘আল-রাজীদিবস’ ও তার পরের ঘটনায় তাঁর আরও ছয়জন অনুসারীর নৃশংস খুন এবং তারপর তাঁর প্রেরিত গুপ্তঘাতক কর্তৃক আবু-সুফিয়ানকে গুপ্তহত্যায় ব্যর্থতার পর মুহাম্মদের জীবনের পরবর্তী বৃহৎ বিষাদময় ঘটনাটি সংঘটিত হয় ‘বির মাউনা (Bir Mauna) নামক স্থানে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ওহুদ যুদ্ধের মাস চারেক পরে। মুহাম্মদ তাঁর মিত্র বানু আমির গোত্রের দলপতি আবু বারা আমির বিন মালিকের আমন্ত্রণে তার এলাকার জনগণকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর ৪০জন অনুসারীকে (মতান্তরে ৭০জন) প্রেরণ করেন।
দলটি যখন বির মাউনা নামক স্থানে পৌঁছে ,তখন বানু আমির গোত্রেরই আমির বিন তোফায়েল (Amir b. Tufayl) নামের এক লোক বানু সুলায়েম গোত্রের লোকদের সহায়তায় মুহাম্মদ অনুসারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়।
আমির বিন তোফায়েল ছাড়া বানু আমির গোত্রের অন্য কোনো লোক এই হামলায় জড়িত ছিলেন না। এই হামলায় তারা মুহাম্মদের মাত্র একজন অনুসারী ছাড়া বাকি সবাইকেই হত্যা করে।
এই ঘটনার পর মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন সকালের নামাজে (ফজর) এক মাস যাবত ঐ হামলাকারীদের উদ্দেশে অভিশাপ বর্ষণ করেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ সাল) ও আল-তাবারীর বর্ণনা: [1][2][3]
ইবনে হুমায়েদ হইতে < সালামাহ হইতে <মুহাম্মদ ইবনে ইশাক:
(ওহুদ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর) আল্লাহর নবী শওয়াল মাসের অবশিষ্ট দিন, যিলকদ, যিলহজ (তৃতীয় হিজরি) ও মহরম মাস (চতুর্থ হিজরি) পর্যন্ত মদিনায় অবস্থান করেন, তখন তীর্থযাত্রীদের তত্ত্বাবধায়ক ছিল মুশরিকরা (Polytheist)।
তারপর ওহুদ যুদ্ধের চার মাস পর সফর মাসে (যার শুরু হয়েছিল জুলাই ১৩, ৬২৫ সাল), তিনি তাঁর লোকদের বির মাউনায় প্রেরণ করেন; কারণটি ছিল এই:
আমার পিতা ইশাক বিন ইয়াসার < আল-মুঘিরা বিন আবদুল রাহমান বিন আল-হারিথ বিন হিশাম হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে [মুহাম্মদ ইবনে ইশাক] যা বলেছেন, যেমনটি বলেছেন আবদুল্লাহ বিন আবু বকর বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন আমর বিন হাযম এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসরা (Traditionists), তা হলো:
বানু আমির বিন সা’সাহ গোত্রের নেতা, ‘বল্লম খেলোয়াড়’ আবু বারা আমির বিন মালিক বিন জাফর, মদিনায় আল্লাহর নবীর কাছে উপঢৌকন নিয়ে আসে ও তাঁকে তা গ্রহণ করার আবেদন জানায়।
আল্লাহর নবী তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তিনি কোনো মুশরিকের দেয়া উপঢৌকন গ্রহণ করতে পারেন না এবং তিনি তাকে এই বলে আহ্বান করেন যে, যদি সে তাঁকে তা গ্রহণ করাতে চায়, তবে যেন সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
আল্লাহর নবী তাকে ইসলাম ধর্ম ব্যাখ্যা করেন ও তাকে তা গ্রহণের আহ্বান জানান। যদিও তখন সে তা গ্রহণ করে না, কিন্তু ইসলাম থেকে সে খুব দূরেও ছিল না।
সে জবাবে বলে, “হে মুহাম্মদ, নাজাদের (Najd) লোকদের কাছে যদি তুমি তোমার কিছু অনুসারীদের পাঠাতে ও তারা যদি তাদেরকে তোমার বিষয়টি বলতো, তবে আমার বিশ্বাস, তারা তোমার পক্ষে জবাব দিত।”
আল্লাহর নবী বলেন, তিনি ভীত এই কারণে যে, নাজাদের লোকেরা তাদেরকে হত্যা করতে পারে।
জবাবে আবু বারা বলে যে সে তাদের নিরাপত্তা দেবে, তিনি তাদেরকে পাঠাতে পারেন ও লোকদের তাঁর ধর্মে আমন্ত্রণ করতে পারেন।
তাই আল্লাহর নবী বানু সায়দা গোত্রের আল-মুনধির বিন আমরের সঙ্গে তাঁর সেরা অনুসারীদের মধ্য থেকে ৪০ জনকে (আল তাবারী ও ইমাম বুখারীর মতে ৭০ জনকে) প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আল-হারিথ বিন আল-সিমমা; বানু আদি বিন আল-নাজজার গোত্রের হারাম বিন মিলহান নামের এক ভাই; উরওয়া বিন আসমা বিন আল-সালত আল-সুলামি; নাফিব বিন বুদায়েল বিন ওয়ারকা আল-খুযায়ি; আমির বিন ফুহায়েরা নামের আবু বকরের মুক্তি প্রাপ্ত দাস (Freedman) ।
তারা বির মাউনা (Bi’r Ma’una) স্থানটিতে বিশ্রামের জন্য থামার পূর্ব পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত রাখে। বির মাউনা স্থানটি ছিল বানু আমির গোত্র ও বানু সুলায়েম গোত্রের দুই জেলার মধ্যবর্তী, বানু সুলায়েম গোত্রের অধিক নিকটবর্তী একটি জায়গা।
সেখানে অবতরণ করার পর তারা আল্লাহর নবীর চিঠিটি সহকারে হারাম বিন মিলহান-কে আল্লাহর শত্রু আমির বিন তোফায়েলের (Amir b. Tufayl) কাছে পাঠায়। যখন সে তার কাছে আসে, চিঠিটি দেখার আগেই সে দ্রুতবেগে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ করে ও হত্যা করে।
তারপর সে বানু আমির গোত্রের লোকদের তাদের বিরুদ্ধে আহ্বান করে, কিন্তু সে যা চায়, তা তারা প্রত্যাখ্যান করে ও বলে যে, তারা এই লোকদেরকে দেয়া আবু বারা-র নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না।
তারপর সে আবেদন করে বানু সুলায়েম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত উসেইয়া, রীল ও ধাকওয়ান (Usayya, Ri’l and Dhakwan) গোত্রের লোকদের। তারা তাতে রাজি হয় ও তাদের বিরুদ্ধে জড়ো হয় এবং মুহাম্মদ অনুসারীরা তাদের উটগুলো নিয়ে যেখানে অবস্থান করছিল, তারা সেই স্থান ঘেরাও করে।
এই অবস্থায় মুহাম্মদ অনুসারীরা তাদের তরোয়াল উঁচিয়ে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ করে। একমাত্র বানু দিনার বিন আল-নাজজার গোত্রের কা’ব বিন যায়েদ ছাড়া সকলেই নিহত হয়; তারা যখন তাকে ফেলে রেখে চলে যায়, তখনও তার শ্বাস ছিল। পরে তাকে নিহতদের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এবং খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত সে জীবিত ছিল, সেই যুদ্ধে সে শহীদ হয়।
আমর বিন উমাইয়া আল-দামরি ও বানু আমর বিন আউফ গোত্রের এক আনসার তৃণভূমিতে তাদের উট চড়াচ্ছিল শিবিরের ওপর শকুনের চক্কর দেয়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা জানতো না যে, তাদের সহচরদের হত্যা করা হয়েছে। [4]
এই দৃশ্য যে খুবই সংকটজনক কিছু একটা ঘটার আলামত, তা তারা জানতো। তাই কী ঘটেছে, তা অনুসন্ধানের জন্য তারা সেখানে যায় ও দেখতে পায় যে, তাদের লোকেরা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, আর যে অশ্বারোহীরা তাদেরকে খুন করেছে, তারা নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে।
আমরের মত ছিল এই যে, তাদের উচিত আল্লাহর নবীর কাছে ফিরে যাওয়া ও তাঁকে এই খবরটি জানানো। কিন্তু আনসারটি বলে, যে স্থানে খুন করা হয়েছে আল-মুনধিরকে, সে সেই স্থানটি পরিত্যাগ করে যেতে পারবে না; আর সে এটিও সহ্য করতে পারবে না যে, লোকেরা তার এমন একটি কাজের জন্য বলাবলি করবে; তাই সে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঐ লোকদের সাথে যুদ্ধ করে।
তারা ‘আমর’-কে বন্দী করে নিয়ে যায়, কিন্তু যখন সে বলে, সে মুদারের [অঞ্চলের] এক লোক, তখন আমির বিন আল-তোফায়েল তার মাথার চুল কেটে তাকে ছেড়ে দেয়। কথিত আছে যে, সে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল তার মায়ের দেয়া এক শপথের (Oath) কারণে।
‘আমর’ আল-কারকারা (al-Qarqara) নামক স্থানের ঐ জায়গাটি পর্যন্ত পৌঁছে যেখানে শুরু হয়েছে আল কানাত স্থানটির, সেখানে সে বানু আমির গোত্রের দুইজন লোককে দেখে; তারা সেখানকার এক ছায়াময় স্থানে তার সঙ্গে থেমেছিল।
বানু আমির গোত্রের সাথে আল্লাহর নবীর এক মৈত্রী চুক্তি ছিল, যে ব্যাপারে ‘আমর’ কিছুই জানতো না।
তাদেরকে প্রশ্ন করার পর যখন সে জানতে পারে যে, তারা বানু আমির গোত্রের, তখন সে তাদেরকে একা একাই রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ঘুমিয়ে পড়ে; তারপর সে তাদের আক্রমণ করে ও হত্যা করে।
তার ধারণা ছিল এই যে, তাদেরকে খুনের মধ্যমে সে আল্লাহর নবীর অনুসারীদের হত্যার সমুচিত প্রতিশোধ নিয়েছে।
কিন্তু যখন সে আল্লাহর নবীর কাছে আসে ও তাঁকে সে যা করেছে তা খুলে বলে, তিনি বলেন, “তুমি যে দুইজন লোককে হত্যা করেছ, তার রক্ত-মূল্য আমাকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।”
তারপর আল্লাহর নবী বলেন, “এই ঘটনাটি আবু বারার কর্মের ফল। আমি এমনটি ঘটতে পারে এই আশংকায় এই অভিযানে যেতে চাইনি।”
আবু বারা যখন এই খবরটি শুনতে পায়, তখন সে ‘আমিরের’ কারণে আল্লাহর নবীকে দেয়া তাঁর অনুসারীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও প্রাণহানির ঘটনায় মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
হাসান বিন থাবিত ও কাব বিন মালিক আবু বারার ছেলেদের [কবিতার মাধ্যমে] আমির বিন আল-তোফায়েলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকে। [এরপর সিরাতে বড় এক কবিতা–]
যখন হাসান বিন থাবিত ও কাব বিন মালিকের উত্তেজক কথাগুলো আমির বিন আবু বারার ছেলে রাবিয়ার কানে পৌঁছে, তখন সে ‘আমির বিন আল-তোফায়েলকে আক্রমণ করে। সে তার বল্লম দিয়ে তার ঊরুতে আঘাত করে, কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সে তাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়।
আমির তার ঘোড়ার ওপর থেকে পড়ে যায় এবং সে বলে, “এইটিই হলো আবুল বারার কাজ; যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে তার প্রতিশোধ নেয়ার ভার আমি আমার চাচার (অর্থাৎ, আবু বারা) ওপর ছেড়ে দেব এবং আমার মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা যাবে না; কিন্তু আমি যদি বেঁচে থাকি, তবে আমার্রেও যা ঘটেছে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেব।”’
(সম্ভবত, যে-কারণে ঐ দুইজন লোককে হত্যার জন্য মুহাম্মদকে বানু আমির গোত্রকে মুক্তিপণ দিতে হবে, কিন্তু তাঁর সহকারীদের মৃত্যুর জন্য তিনি তাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ দাবি করতে পারবেন না, তা হলো এই যে, প্রকৃতপক্ষে সুলায়েম গোত্রের লোকেরাই মুহাম্মদ অনুসারীদের খুন করেছিল; যদিও আমির বিন আল-তোফায়েল তাদেরকে আহ্বান করেছিল। খুব বেশি হলে আবু বারা-কে এই কারণে দায়ী করা যায় যে, সে তার নিজের ক্ষমতার চেয়ে বাড়িয়ে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; তার দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে সে ছিল মর্মাহত, যা হাসান বিন থাবিত তার কবিতায় উল্লেখ করেছে।) [5]
ইমাম বুখারীর (৮১০-৮৭০ সাল) বর্ণনা: [6]
‘আবদুল আজিজ হইতে উদ্ধৃত: আনাস বলেছেন, “কিছু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আল্লাহর নবী ৭০ জন লোককে পাঠান, যাদেরকে আল-কুররা (Al-Qurra) বলে অভিহিত করা হয়। বির মাউনা কূপের নিকটবর্তী একটি স্থানে বনি সুলায়েম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত রীল ও ধাকওয়ান নামের দুই গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের সামনে এসে হাজির হয়।
তারা (অর্থাৎ, আল-কুররা) বলে, “আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি, আমরা আল্লাহর নবীর জন্য কিছু কাজ করার উদ্দেশ্যে তোমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।” কিন্তু (কাফেররা) তাদের খুন করে।
তাই, আল্লাহর নবী সকালের নামাজের সময় তাদেরকে এক মাস যাবত অভিশাপ বর্ষণ করেন। সেটিই ছিল আল-কুনুত পড়ার শুরু, আমরা এর আগে আল-কুনুত বলি নাই।–’
(অনুবাদ ও [**] যোগ – লেখক)
>>> ইসলামের ইতিহাসে বির মাউনার এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর পরবর্তী সময়ে মুহাম্মদের বাণী ও কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনার পূর্বে ওহুদ যুদ্ধ ও ওহুদ যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ অত্যন্ত আবশ্যক। তাই ত্রাস-হত্যা ও হামলার আদেশের গত বিশটি পর্বের (পর্ব: ৫৪-৭৩) প্রাসঙ্গিক ঘটনা প্রবাহের দিকে অতি সংক্ষেপে আর একবার মনোনিবেশ করা যাক:
১) ওহুদ যুদ্ধে মুহাম্মদের চরম পরাজয়, নবী-গৌরব ধূলিসাৎ এবং সমবয়সী চাচা হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব সহ ৭০ জন অনুসারীর খুন।
২) বিনষ্ট নবী-গৌরব পুনরুদ্ধার ও নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার কলা-কৌশল অংশ হিসাবে মুহাম্মদের হামরা আল-আসাদ অভিযান এবং আল্লাহর নামে কমপক্ষে ৬০ টি ঐশী বাণীর অবতারণা করে বিভিন্ন কলা কৌশলে এটিই প্রমাণ করার চেষ্টা যে, “তাঁর অনুসারীদের ইমানের দুর্বলতার কারণেই এই চরম বিপর্যয় ও পরাজয় ঘটেছে! তাই তাদের উচিত এই যে, তারা যেন তাদের সেই ইমানের দুর্বলতা স্বীকার করে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয় (পর্ব: ৬৮-৭০)।
৩) এই যুদ্ধের মাস তিনেক পর ‘আল-রাজী’ ও তার পরের ঘটনায় তাঁর আরও ছয়জন অনুসারীর নৃশংস খুন (পর্ব-৭২)। আবারও চরম ব্যর্থতা!
৪) তারপর তাঁর প্রেরিত গুপ্তঘাতক কর্তৃক আবু-সুফিয়ানকে গুপ্তহত্যায় ব্যর্থতা!
৫) তারপর ওহুদ যুদ্ধের মাস চারেক পরে বির মাউনার এই বিষাদময় ঘটনায় তাঁর ৪০-৭০ জন অনুসারীর নৃশংস খুন। আবারও চরম ব্যর্থতা!
৬) আমর বিন উমাইয়া আল-দামরি কর্তৃক বানু আমির গোত্রের দুইজন লোককে খুনের রক্ত-মূল্যের অর্থ জোগাড়ের ব্যবস্থা করা!
মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ও তাঁর মুহাজির সহচররা মদিনায় হিজরত করার পরে তাদের পরিবার পরিজনদের ভরণ পোষণের নিমিত্ত কোনো সৎ জীবিকা উপার্জনের চেষ্টায় জড়িত ছিলেন, এমন ইতিহাস নির্ভরযোগ্য আদি উৎসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
নাখলা অভিযানে কুরাইশদের মালামাল লুণ্ঠন ও দুইজন বন্দীর মুক্তিপণের উপার্জন (পর্ব-২৯), বদর যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত সফলতার পর কুরাইশদের শিবির লুণ্ঠন ও ৬৩ জন বন্দীর মুক্তিপণের উপার্জন (পর্ব- ৩৭), বনি কেইনুকা গোত্রকে উচ্ছেদ ও তাঁদের সম্পত্তি লুট করার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থসম্পদ (পর্ব- ৫১), ইত্যাদি কি এতদিন অবশিষ্ট আছে?
কীভাবে জোগাড় হবে রক্ত-মূল্যের অর্থ?
কীভাবে জোগাড় হবে পরিবার পরিজনদের ভরন-পোষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা?
কীভাবে পুনরুদ্ধার হবে তাঁর বিনষ্ট নবী-গৌরব ও নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা?
গত চারটি মাসের একের পর এক এ সকল ব্যর্থতা! বিনষ্ট নবী-গৌরব পুনরুদ্ধার ও নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর সকল কলাকৌশল কি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে? মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ, তিনি তা কখনো হতে দিতে পারেন না!
তাই তিনি,
আমর বিন উমাইয়াহ কর্তৃক খুন হওয়া বনি আমির গোত্রের ঐ দু’জন নিরপরাধ লোকের খুনের রক্ত-মূল্য পরিশোধের আবেদন নিয়ে বনি নাদির গোত্রের ইহুদিদের কাছে যান।
কোনোরূপ জড়িত না থাকা সত্ত্বেও বনি নাদির গোত্রের লোকেরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীর এই অপকর্মের মাশুল দিতে রাজি থাকা সত্ত্বেও কী কৌশলে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ হিজরতের চতুর্থ বর্ষে (৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) বনি নাদির গোত্রকে তাঁদের শত/সহস্র বছরের আবাসস্থল ও ভিটে-মাটি থেকে প্রায় এক বস্ত্রে বিতাড়িত করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা “বনি নাদির গোত্রকে উচ্ছেদ ও তাদের সম্পত্তি লুট! (পর্ব- ৫২)” করা হয়েছে।
[বনি নাদির গোত্রকে উচ্ছেদ ও তাদের সম্পত্তি লুটের ঘটনাটি ঘটেছিল বির মাউনার ঘটনার পর, কিন্তু এই ঘটনাটি বনি কেইনুকা গোত্রকে উচ্ছেদ ও তাঁদের সম্পত্তি লুটের ঘটনার (পর্ব-৫১) অনুরূপ হওয়ায় তা আমি পাশাপাশি আলোচনা করেছি।]
এই আমর বিন উমাইয়াহ আল দামরিই হলো মুহাম্মদের সেই অনুসারী, যাকে মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে গুপ্তহত্যার উদ্দেশ্যে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন। এই সেই ঘাতক, যে আবু-সুফিয়ানকে হত্যায় ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে আসার সময় এক এক-চোখ অন্ধ প্রতিবন্ধী লোকের ঘুমন্ত অবস্থায় লোকটির সতেজ চোখের ভিতর তার ধনুকের আগা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর ঘাড়ের ওপাশে এফোঁড়-ওফোঁড় করে অমানুষিক নৃশংসতায় খুন করেছিল (পর্ব-৭৩); লোকটির অপরাধে ছিল এই যে, তিনি ঘুমিয়ে পড়ার আগে যে-গানটি গেয়েছিলেন, তার একটি কলি ছিল,
‘হবো না মুসলমান যতদিন থাকবো বেঁচে,
দিব না মনোযোগ তাদের ধর্মে।’
আর অন্যদিকে, স্বঘোষিত আখেরি নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বনি নাদির গোত্রের সমস্ত লোককে “বিনা অপরাধে ঐশী বাণীর অজুহাতে” তাঁদের শত-সহস্র বছরের আবাস স্থল থেকে প্রায় এক বস্ত্রে বিতাড়িত করেছিলেন।
প্রশ্ন হলো,
ইসলামের ইতিহাসের এই দুই ঘটনার কোনটি বেশি নৃশংস?
বনি নাদির গোত্রকে উচ্ছেদের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ বনি আমির গোত্রের রক্ত-মূল্যের অর্থ, তাঁর পরিবার পরিজনদের ভরন-পোষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, তাঁর অনুসারীদের ‘গণিমতের মালে জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি তাঁর বিনষ্ট নবী-গৌরব পুনরুদ্ধার ও নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সফলকাম হয়েছিলেন।
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[1] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৭,ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা (Leiden) ১৪৪২-১৪৪৮ http://books.google.com/books?id=efOFhaeNhAwC&printsec=frontcover&source=gbs_ge_summary_r&cad=0#v=onepage&q&f=false
[2] “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৪৩৩-৪৩৬
[3] অনুরূপ বর্ণনা: “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক: আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২)
ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ৩৪৬-৩৫২
[4]Ibid “সিরাত রসুল আল্লাহ”, ইবনে হিশামের নোট নম্বর ৬৭৫ – পৃষ্ঠা ৭৬২
‘সেই আনসারের নাম, আল-মুনধির বিন মুহাম্মদ বিন উকবা বিন উবায়েদা বিন আল-জুলাহ’।
[5]Ibid আল-তাবারী নোট, পৃষ্ঠা (Leiden) ১৪৪৫
[6] The Prophet therefore invoked evil upon them for a month
Volume 5, Book 59, Number 414: (to -422)
Leave a Reply