যখন “জাতির জনক” কথাটা আসে, তখন অবধারিত ভাবে প্রশ্ন আসে- কোন জাতির? আর সেই সাথে আরেকটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরটাও জানার দরকার হয়ে পড়ে খুব ভালো ভাবে- জাতি কী?
উইকি বলে, “জাতি এক ধরণের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্প্রদায়।” অর্থাত এমন এক সম্প্রদায়ের মানুষ যাদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথাগত বিশেষ মিল আছে। আর এই জাতি সত্বার বিকাশ একদিনে হুট করেই হয়ে যায় না, কোন নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা বর্গের ভূমিকাও এখানে অসম্ভব। এর পিছনে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস থাকে। তবে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষের মাইগ্রেশনের ফলে সব সময় কোন ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে কোন জাতিকে আবদ্ধ করা যায় না।
এবার দেখি বাঙালি জাতি কী বা কারা-
“বাঙালি জাতি হল বঙ্গদেশ অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের অধুনা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খণ্ড ও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায় যাদের ইতিহাস অন্ততঃ চার হাজার বছর পুরোনো। এদের ভাষা বাংলা যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পূর্ব-ইন্দো-আর্য বিভাগের একটি ভাষা। নৃতাত্বিকভাবে এরা একদিকে যেমন ওড়িয়া, আসামী, বিহারী ও অন্যান্য পূর্বভারতীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নিকট আত্মীয়, তেমনই এদের মধ্যে কিয়দংশে মুণ্ডা, প্রোটো-আস্ট্রালয়েড, তিব্বতী-বর্মী, অস্ট্রো-এশীয়, এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বংশধারাও মিশে আছে। এর ফলে বাঙালি জাতি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও স্থানভেদে ভিন্ন। এই নৃগোষ্ঠীর সর্বাধিক ঘনত্ব দেখা যায় অধুনা বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। তবে এছাড়াও অনেক বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভারতের আরো নানা রাজ্যে, যেমনঃ ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দিল্লী, কর্ণাটক এবং ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তের রাজ্যগুলিতে (অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড)। এছাড়াও পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে অনেক বাঙালি আছেন।” – উইকি।
দেখা যাচ্ছে, জাতি সৃষ্টি করা যায় না। এটা যখন হয় তখন এমনিতেই হয়ে যায়। একটা আধুনিক রাষ্ট্রে এক বা একাধিক জাতির বসবাস হতে পারে। আর সেই রাষ্ট্র এবং তার মানুষগুলো সভ্য হলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করবে এবং তারা সুখে শান্তিতে মিলেমিশে বসবাস করবে। তবে আলাদা একটা রাষ্ট্র বা দেশ সৃষ্টির পিছনে দেশের মানুষজনের চাওয়া বা ভূমিকা থাকতেই হবে। আর সেই চাওয়াটাকে সামনে এগিয়ে নিতে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কেউ কেউ লীড দিতে পারেন। জনগন এই লীড দেয়ার স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে সেই দেশের রূপকার, স্থপতি, বা জনক হিসাবে ভূষিত করতে পারে।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অঞ্চল বঙ্গের মানুষদের অধিকার রক্ষার্থে রাজনীতি করতেন। সেই থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যখন দেখলেন একসাথে থেকে সেই অধিকার জনগন পাচ্ছে না তখন ধীরে ধীরে স্বায়ত্ব শাসন থেকে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পথে হাঁটলেন এবং একসময় সফল হলেন। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন ভৌগলিক সীমারেখা আমরা চিনি, সেটার জন্ম হলো। এখানে উনার ভূমিকার জন্য আমরা উনাকে এই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বা এই স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বলতে পারি। কিন্তু কোনোভাবেই বাঙালি জাতির জনক হতে পারেন না।
“জাতির জনক” কিংবা “শহীদ অমুক” টার্মগুলো একেকটা ক্ষতিকর আবেগের নাম যার কোন বাস্তব ভিত্তি নাই। বিশেষ করে এই আবেগগুলো বাংলাদেশের আবেগী জনসাধারণের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর। বাংলাদেশের জনগনের এরকম আবেগগুলা উলটা তাদের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশের মানুষের আরো সতর্ক হওয়া উচিত।
Leave a Reply